ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

একটি স্প্রে-ই কিডনি লিভার হার্ট জরায়ু ব্রেস্ট ক্যান্সারের নিদান

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

একটি স্প্রে-ই কিডনি লিভার হার্ট জরায়ু ব্রেস্ট ক্যান্সারের নিদান

ওয়াজেদ হীরা ॥ একটি স্প্রে দিয়েই হবে একাধিক জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা! এর জন্য কোন ডাক্তার বা কোন টেস্টেরও প্রয়োজন হবে না। কিডনি, লিভার, হার্ট, জরায়ু, ব্রেস্ট ক্যান্সারসহ শরীরে সব অসুখের সমাধান মেলে শুধু এই স্প্রে দিয়েই। এর নাম ‘বায়ো স্প্রে প্লাস’। বলা হয়েছে প্রতিদিন এই তরলটি দুইবার ব্যবহারে সুস্থ থাকে শরীর। তবে যারা এটি ব্যবহার করছেন তারা বলছে এর ফলে শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। বেড়ে গেছে অন্য অসুখের মাত্রাও। এক্ষেত্রে ভুয়া ছাড়পত্রের লগোও ব্যবহার করে প্রতারণামূলক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে একটা চক্র। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুকৌশলে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে এটি বিক্রি করা হচ্ছে। এক মাসের এই একটি স্প্রে দাম রাখা হচ্ছে সাত হাজার টাকা। বিদেশের এই তরলটি চোরাই পথে আসছে আবার বিক্রিও হচ্ছে গোপনে। যদিও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, একেকটি ওষুধ বা তরল বিভিন্ন দেশের আবহাওয়ার অনুকূলে অনেক কিছু বিবেচনা করে তৈরি হয়। পরীক্ষা ছাড়া অননুমোদিত এসব তরল ব্যবহারে দৈহিক আকার পরিবর্তন হতে পারে। এমনকি বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারে যে কেউ। তাই এসব মিথ্যা প্ররোচনায় প্রতারিত না হতেও আহ্বান বিশেষজ্ঞদের। মানুষকে প্রতারিত করা এই বায়ো স্প্রে প্রস্তুতকারক মূলত মালয়েশিয়ার একটি কোম্পানি। চীনেও এর ব্যাপক প্রচার রয়েছে বলে জানা গেছে। যার নাম নিউট্রিক ইন্টারন্যাশনাল ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ। গোপনে বিভিন্ন অল্প শিক্ষিত ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিতরণ করা এই প্রতিষ্ঠানের একটি বিজ্ঞাপন জনকণ্ঠের হাতেও এসেছে। যেখানে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে ৫ ব্যক্তির ছবিও দেয়া আছে। এই স্প্রের অনুমোদন হিসেবে বিভিন্ন দেশের সনদের স্বীকৃতির ছবিও আছে। যার একটি সনদ বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এই ছাড়পত্র দিয়েছে বলে বিজ্ঞাপনে উল্লেখ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট তা অস্বীকার করেছে। পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রথমেই বলি এই ইনস্টিটিউট কোন ধরনের ছাড়পত্র দেয় না। দেয়ার ক্ষমতাও নেই। তাই যারা আমাদের ইনস্টিটিউটের নাম জড়িয়ে ব্যবহার করে তারা ভেজাল এবং ভুয়া। তিনি বলেন, সরকারী পদ্ধতিতে কোন খাদ্য বাজারে আনতে গেলে বিএসটিআই অনুমোদিত হতে হবে। বিএসটিআইয়ে যে প্রক্রিয়া আছে তার মধ্য দিয়ে আসতে হবে। বিদেশের খাবার আমদানির ক্ষেত্রেও বিএসটিআইর অনুমতি লাগে। আমি আগেও বহুবার বলেছি, আমাদের নাম দিয়ে এই ধরনের ছাড়পত্র লেখা মানেই ভেজাল। পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক আরও বলেন, একটা সময় ছিল, সাবেক এক পরিচালক ব্যক্তিগতভাবে কিছু ছাড়পত্র দিয়েছেন। তবে তার দায় প্রতিষ্ঠানের নয়। বিষয়টি নিয়ে কনজুমার এ্যাসোসিয়েশন (ক্যাব) মামলাও করেছিল। তবে ২০০৫ থেকে ঘোষণা দিয়ে বলে দেয়া হয়েছে ছাড়পত্র নামের কিছু পুষ্টি বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট দেয় না। এখানে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করানো হয় এবং গবেষণা করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা গেছে, মালয়েশিয়া ও চীনে বিক্রির জন্য ৯টি পণ্যের নাম রয়েছে। আর অন্যান্য দেশের জন্য রয়েছে ৭টি পণ্য। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশসহ আটটি দেশের সার্টিফিকেট প্রাপ্ত হিসেব উল্লেখ রয়েছে এবং বিভিন্ন সার্টিফিকেটের ছবিও দেয়া আছে। আর এ ধরনের সার্টিফিকেটের কথাতো ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সোজা ভাষায় অস্বীকার করে দিয়েছে। পুরো বিজ্ঞাপনে মালয়েশিয়ার একটি অফিসের ঠিকানা ব্যবহার করলেও বাংলাদেশের কোন অফিস বা কারও ফোন নাম্বার দেয়া নেই। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ২৮ হাজার ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় এর উপকারিতা পাওয়া গেছে। কমপক্ষে অর্ধশত গুরুতর অসুখ ভাল হওয়ার কথা বলা হয়েছে। একটি স্প্রের মাধ্যমে এতো রোগ ভাল হবে কোন ডাক্তার, প্রেসক্রিপশন কিংবা টেস্ট লাগবে না এটি আর যাই হোক সচেতন এবং উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তি বিশ^াস করবে না। তাই শহরের মানুষের চেয়ে গ্রামের মানুষকেই টার্গেট করেছে এই প্রতারক শ্রেণী। এই স্প্রে যারা বিভিন্ন এলাকায় বা বিভিন্ন রোগীর কাছে সরবরাহ করেন এমন দুটি নম্বর জনকণ্ঠের কাছে এলে তাদের সঙ্গে রোগী সেজে যোগাযোগও করা হয়। এই স্প্রে ব্যবহার করা টাঙ্গাইল জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের একটি মেয়ের আত্মীয় স্বজন জানান, এই স্প্রে এক মাস ব্যবহার করার ফলে তার পুরো শরীরে নানা ইনফেকশন হয়েছে। আবার স্প্রে যারা দিয়েছেন তারা বলেছেন আরও দু’এক মাস ব্যবহার করতে। কিডনি রোগী শিখা নামের একটি শিশুকেও দেয়া হয়েছে এই স্প্রে। কিডনি ইনস্টিটিউট থেকে ফেরত নেয়া ওই শিশুকে প্রতিদিন এই স্প্রে ব্যবহারের ফলে উন্নতির লক্ষণ হিসেবে প্রথম দিকে একটু খাবার দাবার ভাল থাকলেও ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছে মেয়েটির শরীর। তাতে অভিভাবকরা আশঙ্কা করছেন স্প্রের খারাপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তবে বন্ধও করতে পারছেন না। বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে এই স্প্রে চলে যাচ্ছে হাতে। কেউ এই ওষুধ নামের স্প্রে অন্যকে কিনে দিলে বা কোন রোগী এনে দিলে তাকেও কমিশন হিসেবে একহাজার টাকা করে দেয়া হয় বলেও জানা গেছে। মানুষকে প্রতারিত করা এই বায়ো স্প্রের বিজ্ঞাপনে সতর্কতা হিসেবে লেখা হয়েছে, এটি প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে তবে হরমোন ঘাটতিজনিত কারণে অপ্রাপ্ত বয়স্করাও ব্যবহার করতে পারবে। তবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। অথচ বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে এই স্প্রে বাচ্চাদের ওপরও হরহামেশাই প্রয়োগ হচ্ছে। ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার কয়েকজন রোগীর সঙ্গেও কথা হয়েছে যারা এই স্প্রে ব্যবহার করছেন। কেউ ঠা-াজনিত কারণে স্প্রে ব্যবহার করেছে এখন তার চুলকানির মাত্রা বেড়ে গেছে। এক জন শরীরের মেদ কমাতে গিয়ে টানা ব্যবহার করেও কোন ফল পাচ্ছেন না উপরন্তু তার শরীর দুর্বল থাকে। মানুষের কাছে আকর্ষণ করতে বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এই স্প্রে ব্যবহারে তারুণ্য থাকে অটুট, মেদ কমে, চুল গজায়, চোখের দৃষ্টি বাড়ে, হাড় ও দাঁতের ক্ষয়রোধ করে, স্মৃতিশক্তি-যৌন শক্তি বাড়ে, চর্ম রোগ দূর করে ইত্যাদি। আর অসংখ্য এসব লোভনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ঢাকা মেডিক্যাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ অন্তত পাঁচ জন ডাক্তার এই ধরনের ফাঁদে পা না দেয়ার কথা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলেন, আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞান ক্রমশই এগিয়ে যাচ্ছে তাই বলে অলৌকিক কিছুতে পা দেয়া যাবে না। পরীক্ষা নেই, শুধু একটি বিষয় এতো জটিল রোগের চিকিৎসা এতেই বুঝা যাচ্ছে বিষয়টা কি! ঢাকা মেডিক্যালের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শহীদুল বাশার জনকণ্ঠকে বলেন, একজাতের ওষুধ অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহারের উদ্দেশ্য ভিন্ন হতে পারে। তবে আমাদের দেশে মানুষকে সহজেই যে কোন বিষয়ে বিশ্বাস আনা যায়। আর মানুষও ফাঁদে পড়ে। এ থেকে অনেক বড় ক্ষতিও হতে পারে। অন্যদিকে, বিজ্ঞাপন দেখে প্রলুব্ধ হওয়া একাধিক রোগীর থেকে দুটি নম্বর পাওয়া গেছে। যারা এই বায়ো স্প্রে সরবরাহ করে থাকে। একটি নম্বরে রোগী হিসেবে কথা বললে জামগড়া, বাইপেল বা সাভার আসতে বলেন। আবুল কাশেম নামের ওই ব্যক্তি নিজেকে এই স্প্রের একজন উদ্যোক্তা পরিচয় দিলে বলেন, এটি আমেরিকার ওষুধ। এটি ছয় মাসের কোর্স। ছয় মাসেই সব ধরনের রোগই ভাল হবে বলেও আশ^স্ত করেন তিনি। তবে প্রথম কোর্স হিসেবে সাত হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেন। এর পর সাংবাদিক শোনার পর থেকেই ফোন ধরেন না ওই ব্যক্তি। পরবর্তী আরেকটি নম্বরে যোগাযোগ করলেও একই ব্যক্তি ফোন ধরে বলেন, আমি একজন মার্কেটিং কমর্কর্তা। মালিবাগ আয়েশা শপিং কমপ্লেক্সের কথা বলেন। তবে কারও নাম বা মালিক কে সে বিষয়ে কিছুই না বলে কাশেম নামের ওই ব্যক্তি বলেন, আমাদের কাগজ সব রেডি। আমরা ছয় বছর ধরে এভাবেই ব্যবসা করছি। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক কমিউনিকেশন বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আসলে দেশে প্রতারক চক্র নানাভাবে নানা নামে মানুষকে ঠকায়। এর জন্য প্রশাসনের সঙ্গে মানুষের সচেতনতাও প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
×