ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন

বাঙালী জাতির মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা ভাষা ও এর চর্চাকারীদের ওপর ঔপনিবেশিক আমল থেকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সংস্কৃত, ইংরেজী, উর্দু চাপানো হয়েছে বা চেষ্টা চলেছে। রাষ্ট্রভাষা নিয়ে মতবিরোধ দেশ বিভাগের পূর্বেই শুরু হয়। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সাল থেকে বাঙালীদের ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। ধীরে ধীরে বিস্ফোরিত হয়ে চূড়ান্ত বিজয় আসে ১৯৫২ সালে। মাতৃভাষাকে রক্ত দিয়ে রক্ষা করার ইতিহাস শুধু বাঙালীরই আছে। ১৯৪৭ সালে ১৪ ও ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ ভারত থেকে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান জন্মের পর ১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর করাচীতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ সংবাদটি ঢাকার ছাত্র-ছাত্রীদের মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় (আমতলার অদূরে) একটি প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয় তারা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে আরো সোচ্চার করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. নূরুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক নির্বাচিত করে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে তমুদ্দিন মজলিসের উদ্যোগে গঠিত হয় প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন পাকিস্তান গণপরিষদের অধীনে গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক গণপরিষদের ভাষার তালিকায় ইংরেজী ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। পাকিস্তানের তৎকালীন মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ লোকের ভাষা ছিল বাংলা। বাঙালীদের যৌক্তিক দাবি উপেক্ষিত হলে স্বকীয়তা ও অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা আন্দোলনমুখর হতে থাকে। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় ও জেলা শহরেও ভাষা আন্দোলন ধাপে ধাপে গতি সঞ্চার করতে থাকে। ভাষা আন্দোলনে ঢাকার পরেই রাজশাহীর স্থান। রাজশাহীতে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, মিছিল, স্লোগান ও প্রতিবাদ শুরু হয়। রাজশাহী শহরের ভুবন মোহন পার্কে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় লোকনাথ হাই স্কুলের শিক্ষক তুখোর বক্তা আবদুস সাত্তার মাস্টারের বক্তব্যে জেগে উঠেছিল রাজশাহীর ছাত্র-জনতা। ’৪৮ সালে ১১ মার্চ দেশব্যাপী ‘ভাষা দিবস’ উদযাপন হয়েছিল। এ উপলক্ষে রাজশাহী কলেজের ছাত্রদের একটি মিছিল শহর প্রকম্পিত করে ফায়ার বিগ্রেডে পৌঁছাতেই সরকারের মদদপুষ্ট পুলিশ বাহিনী মিছিলে অতর্কিত হামলা করে। এতে গোলাম রহমান, আবদুল লতিফ, ব্রতিষ ঘোষ, ফজলুল রহমান, এমএজি তওয়াবসহ আরও অনেকেই আহত ও রক্তাক্ত হন। আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে সাদা কাগজে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ লিখে ছোট ছোট টিনের কৌটায় আঠা দিয়ে লাগিয়ে মিছিলের মধ্যেই অর্থ সংগ্রহ চলত। ভাষা আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন ছিল, তাই সাধারণ মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে কৌটায় টাকা পয়সা দিত। স্কুলে গোপনে কালো পতাকা উত্তোলন, কালো কাপড় বা কাগজ কেটে ব্যাচ বানিয়ে জনগণের জামায় লাগানো হতো। জননেতা মো. একরামুল হক, আতাউর রহমান, কাশেম চৌধুরী গ্রেফতার হন আর হাবিবুর রহমান শেলী পড়াশোনার জন্য ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে ভর্তি হলে ভাষা আন্দোলনে সাময়িক স্থিতি আসে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মোহম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স মাঠে ও ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এতে ছাত্র জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ১৯৪৯ সালে রাজশাহীতে আন্দোলনে নতুন নেতৃত্বে আসেন গোলাম আরিফ টিপু, মোঃ আনসার আলী, এসএ বারী এটি, মহসীন প্রামণিক, এসএমএ গাফ্ফার, আহমদুল্লাহ্ চৌধুরী, আনোয়ার জাহিদ প্রমুখ ছাত্রনেতাগণ। তাঁদের সাহসী নেতৃত্বে আন্দোলন নতুন উদ্যোমে আরও গতি পায়। ১৯৫০ সালের ২ এপ্রিল রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশনরত বন্দি ছাত্রনেতাদের উপর পুলিশের অকস্মাৎ গুলিবর্ষণে সাতজন ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। রাজশাহীর মাটি আবার রঞ্জিত হয় রক্তে। সরকারের এমন আচরণে বিবেকবান মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে বিস্ফোরণের অপেক্ষায়। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টন ময়দানে পুনরায় ঘোষণা করেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। এরই প্রতিবাদে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট, ১১ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে আন্দোলনের প্রস্তুতি দিবস এবং ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সে সময় ঢাকার পর রাজশাহীসহ সারাদেশের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। এই ঘোষণার পর সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হলে হাবিবুর রহমান শেলী ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার ঐতিহাসিক বৈঠকে ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন। ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও মিছিলে গুলি চালানো হলে তৎক্ষণাত রফিক, শফিউর, জব্বার, বরকতসহ অনেক ছাত্র-জনতা শহীদ হন। এ বার্তাটি রাজশাহীসহ সারাদেশে বিদ্যুতবেগে ছড়িয়ে পড়ে। রাজশাহীর ছাত্রসমাজ ও জনতাকে এটি আবেগ তাড়িত করে। তাৎক্ষণিকভাবে রাজশাহী কলেজের ‘এ’ ব্লকের সামনে একসভায় ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয় । এতে সভাপতি হন মেডিকেল স্কুলের ছাত্র এসএম এ গাফ্ফার এবং যৌথভাবে সম্পাদক হন গোলাম আরিফ টিপু ও হাবিবুর রহমান শেলী। এ পরিষদ ঢাকায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য পুরনো ইট ও কাদামাটি দিয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন রাজশাহী কলেজ হোস্টেলের গেটের সামনে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ বাহিনী ওই স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙ্গে ফেলে। শহীদদের আত্মার মাগফিরাত এবং জনগণকে আরও সংগঠিত করার জন্য ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ভুবন মোহন পার্কে প্রতিবাদ সভা করে। এই দিন রাজশাহীতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। জনগণ কালো ব্যাজ ধারণ করে। অনেক বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা প্রদর্শিত হয়। এ সভায় এমএলএ মাদার বকশ্ সরকার দলীয় প্রাদেশিক সদস্য হওয়া সত্ত্বেও বলিষ্ঠ ও প্রতিবাদী বক্তব্য প্রদান করেন। যার প্রেক্ষিতে তিনি রাজশাহীর জনগণের কাছে ভাষা আন্দোলনের সাহসী ভূমিকার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদদের আত্মার মাগফিরাত ও জনগণকে আরও উদ্দীপ্ত সংগ্রামী করার লক্ষ্যে ২২ ফেব্রুয়ারি একটি দীর্ঘ মৌন মিছিল সারা শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণ করে ভুবন মোহন পার্কে এসে প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়। এ সভাকে কেন্দ্র করে রাজশাহী শহর পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল। এ প্রতিবাদ সভা ও ভাষা আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণার কারণে মাদার বকশ, সামশুল হক, এ্যাডভোকেট মজিবর রহমানসহ আরও বেশকিছু নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। রাজশাহীর ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন খবর প্রকাশে দৈনিক আজাদ পত্রিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ১৯৫০ সালে প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার প্ল্যাটফরমে দিশারী সাহিত্য মজলিস গড়ে উঠে। এই পত্রিকারও বিশেষ ভূমিকা ছিল ভাষা আন্দোলনে। মূলত ছাত্র সংগঠনের কর্মীরাই সেসময় সংবাদগুলো সংগ্রহ করে গোপনে পাঠাতেন। রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনে সাহসী ভূমিকার জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন অনেকে। ভাষা আন্দোলনে বাঙালী বীর শহীদদের রক্ত বৃথা যায়নি। হাজার বছরের ঐতিহ্য ও গৌরবম-িত বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা বিশ্ব ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার ও সম্মান রক্ষার সংগ্রামে বাঙালী জাতির সুমহান ত্যাগ বিশ্ব ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এই আন্দোলনে ঢাকার পর রাজশাহীর অবদান অবিস্মরণীয় ও অপরিসীম। লেখক : ডেপুটি কিউরেটর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
×