ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গণমাধ্যমের প্রতি তথ্যমন্ত্রী

বিচারের পর অপরাধীকে বীর না বানিয়ে তাকে বর্জন করুন

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বিচারের পর অপরাধীকে বীর না বানিয়ে তাকে বর্জন করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিচারের পর অপরাধীকে বীর না বানিয়ে, তাকে বর্জনের জন্য গনমাধ্যমকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। বুধবার সকালে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দিবস ২০১৮ উপলক্ষে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে এ আহ্বান জানান। প্রেস কাউন্সিল মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে আদালতে বিচার হলো না তার আগেই গণমাধ্যম একটা মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করে দিল। আদালতের আগেই, মিডিয়া বিচার করে দিল। এটা মিডিয়া ট্রায়াল। মিডিয়া ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে একটা মানুষের চরিত্র হনন হয়ে গেল। কিন্তু দেখা গেল আদালতের রায়ে তিনি কিছুদিন পরে খালাস পেলেন। এটা খারাপ কাজ। তিনি আরও বলেন, বিচারের আগে মিডিয়া ট্রায়াল যেমন খারাপ কাজ, তেমনি বিচারের পর অপরাধীকে মহিমান্বিত করা, অপরাধকে বীর বানানো, আপরাধীকে মহান বানানোটাও একটা খারাপ কাজ। বিচারের পর অপরাধীদের প্রতি সংবেদনশীলতা তৈরি করা, সহানুভূতি তৈরি করা গণমাধ্যমের কাজ নয়। অপরাধী বিচারের পর অপরাধীদের বর্জনেই করতে হবে। সোচ্চার হতে হবে, যাতে অপরাধীরা সমাজ, রাজনীতি রাষ্ট্রীয় কাজ থেকে দূরে থাকে, বাইরে থাকে। সুতরাং প্রেস কাউন্সিল দিবসে গণমাধ্যমের বন্ধুদের প্রতি আমার একটাই আহ্বান থাকবে, যেমন বিচারের মিডিয়া ট্রায়াল খারাপ জিনিস তেমন বিচারের পরে অপরাধীকে মহিমান্বিত করা গণমাধ্যমের কাজ নয়। তাহলে সমাজ আরও শক্তিশালীভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতির দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। অপরাধীদের বর্জন করায় সোচ্চায় হতে গণমাধ্যমকে আহ্বান জানাই। তথ্য আইন তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করেছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এই সরকারের আমলে গণমাধ্যমের জন্য কর্মীদের স্বাচ্ছন্দ্য যাতে বসবাস করতে পারে সেজন্য ওয়েজ বোর্ড করা হয়েছে। ওয়েজ বোর্ডের কাজ শুরু“ হয়েছে। আইন করে সাংবাদিকদের কল্যাণ ট্রাস্ট করে দিয়েছেন। সেখানে তহবিল তৈরি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা কিছু পুরনো আইন, প্রেস কাউন্সিল আইন, সংবাদ পত্রের ৭৪ সালের বঙ্গবন্ধুর আইন, যেটাকে খালেদা জিয়ার সরকার বাতিল করে একটু বিকৃত করেছিল, সেগুলো সব ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ শুরু করেছি। এছাড়াও বিকশিত ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবস্থাপনার জন্য সম্প্রচার নীতিমালা, সম্প্রচার আইন, সম্প্রচার কমিশন- বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। আমরা চাই যে গণমাধ্যম জনগণের কন্ঠস্বর হিসেবে ভূমিকা পালন করবেন কিন্তু জনগণকে অত্যাচার করেন না। খ-িত তথ্য এবং মিথ্যাচার করবেন না। হাসানুল হক ইনু বলেন, আমরা যখন গণমাধ্যমের প্রসার এবং বিকাশের জন্য কাজ করছি এবং আপনারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন শেখ হাসিনার সরকারের আমলে সাতশ’র মতো পত্রিকার নতুন নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। এটা একটা বিরাট ব্যাপার। অনেক টেলিভিশন বেসরকারী খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। নতুনভাবে কমিউনিটি রেডিও বেসরকারী খাতে চালু হয়েছে। নতুনভাবে বাংলাদেশ বেতারের বাইরে বেসরকারী খাতে অনেক এফএম রেডিওর লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এটা আগে ছিল না। সুতরাং এফএম রেডিও, কমিউনিটি রেডিও এবং টেলিভিশন লাইসেন্সের মধ্য দিয়ে এই খবরটাই শেখ হাসিনা সরকার আপনাদের দিচ্ছে যে, গণমাধ্যমের প্রসার ও বিকাশে আমাদের সরকার বিশ্বাসী। আমরা চাই গণমাধ্যম জীবন্ত থাকুক, সক্রিয় থাকুক এবং নজরদারির ভূমিকায় থাকুক। সেদিক থেকে আমরা এখনও গণমাধ্যমের ব্যবস্থাপনায় সব রকম সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করলাম। তিনি বলেন, আমার একটা উত্তরণ পর্বের মধ্যে আছি। ৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পরে সামরিক শাসন, সাম্প্রদায়িকতা অন্ধকার থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িকতার পথে, গণতন্ত্রের পথে, চার নীতি পথে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে ও আলোর পথে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হচ্ছে। এই যে আলোর পথে যাত্রা, একদিকে যেমন চার নীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে সমাজটাকে সাজাতে হচ্ছে অপরদিকে সামরিক শাসন ও সাম্প্রদায়িকতার জঞ্জালগুলো রাজনীতি ও সমাজের বুক থেকে আস্তে আস্তে সরিয়ে দিতে হচ্ছে। এটা একটা বিরাট কাজ। আমি স্বীকার করছি, আমরা সব রাজনৈতিক, সামরিক এবং সাম্প্রদায়িক প্রতিবন্ধকতা পরিষ্কার করতে এখনও পারিনি। এখনও অনেক জঞ্জাল আছে। এই জঞ্জাল থাকার ফলে অনেক সময় আমাদের যারা রাজনীতির অঙ্গনে আছি, সমাজনীতি করি, তারা এই জায়গাটায় একটা ভারসাম্য তৈরি করার চেষ্টা করে। অন্যদিকে, নিরপেক্ষতার নামে অনেক সময় গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমে অনেকেই সম দূরত্ব বজায় রাখার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে এক পাল্লায় মাপার চেষ্টা করেন। কি কারণে? উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, এটা ঠিক না এই জন্যে যে শেখ হাসিনা হচ্ছেন, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষের ব্যক্তি। আর বেগম খালেদা জিয়া হচ্ছে, রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গী সন্ত্রাস, আগুন সন্ত্রাস ও অপরাধীদের নেত্রী। গণমাধ্যমের প্রতি বার বার আমি বলেছি, আপনারা বস্তুনিষ্ঠ হবেন। নিরপেক্ষতার নামে রাজাকারকে হালাল করার চেষ্টা করবেন না। খুনীদের রেহাই দেয়ার চেষ্টা করবেন না। আমাদের আদালত আস্তে আস্তে শক্তিশালী হচ্ছে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসছি। মুখ দেখে দল দেখে আদালত আর চলে না। যারাই অপরাধ করেছে তাদেরই বিচারে সোপর্দ করা হচ্ছে এবং আদালত উন্মুক্ত অধিবেশনের মধ্য দিয়ে সে বিচার কার্য পরিচালনা করে মামলা নিষ্পত্তি করছেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তারানা হালিম বলেন, আমরা যে অনুষ্ঠানই করি না কেন, যে দিবসেই যাই না কেন, আমার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, আমাদের সবকিছুই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই করে দিয়ে গেছেন। আমরা কেবল প্রতিটি বছর তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করি মাত্র। বঙ্গবন্ধুর সময়ের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে বলেন, আজকের বিটিভি, এফডিসি তারই হাতে সৃষ্টি। এই প্রেস কাউন্সিল এ্যাক্টটিও তিনিই করেছিলেন। সেজন্যই বলি আমাদের শুধু কাজ করে যেতে হবে। আমাদের ভিত্তিপ্রস্তর ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু স্থাপন করে দিয়েছেন। আমাদের কাজ হবে সেগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমি খুবই আনন্দিত হবো যদি আমাদের তথ্য ভবনে প্রেস কাউন্সিলের জন্য দুটি ফ্লোর বরাদ্দ দিতে পারি। তিনি আরও বলেন, আমার অনেকগুলো কাজ হাতে নিয়েছি। কিছুদিন আগে কিছু মিটিং করেছি। আমরা এমন কাজ করছি, আমি মনে করি যে সেই কাজগুলো সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের জন্য মাইল ফলক হয়ে থাকবে। সেগুলো একুট বড়সড় করে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করতে চাই। সে জন্য আপাতত তা প্রকাশ করছি না। অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল পদক ২০১৮ সালের জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিতদের নাম ঘোষণা করেন। ছয় ক্যাটাগরিতে এ পদক দেয়া হচ্ছে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারির গানের রচয়িতা হিসেবে আজীবন সম্মাননা ক্যাটাগরিতে পদকের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী, বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে একটি ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠানিক সম্মাননা পাচ্ছে দৈনিক সংবাদ। উন্নয়ন সাংবাদিকতায় ‘যোগাযোগে বিপ্লব’ শিরোনামে সংবাদের জন্য দৈনিক জনকণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার রাজন ভট্টাচার্য, গ্রামীণ সাংবাদিকতা ‘হাওড়ের দুঃখ’ শিরোনামে সংবাদের জন্য দৈনিক সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি রাজীব নূর, নারী সাংবাদিকতা ‘সুযোগের অভাবে উমা বিশ্বাসের স্বপ্নগুলো বাক্সবন্দী’ শিরোনামে সংবাদের জন্যম দৈনিক বরিশাল সময় এর চীফ রিপোর্টার মর্জিনা বেগম, আলোকচিত্রে ‘রেললাইনের দুপাশে অবৈধ স্থাপনা’, ‘রোহিঙ্গা বৃদ্ধের বাঁচার আকুতি’ ও ‘ভাঙ্গাচোরা সড়কে নাগরিক দুর্ভোগ’ এই ক্যাপশনের তিনটি ছবির জন্য দৈনিক আমাদের সময় এর নিজস্ব ফটোসাংবাদিক আল আমিন লিয়ন নির্বাচিত হয়েছেন। আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে এই সম্মাননা পদক তুলে দেবেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেস কাউন্সিল এ্যাক্ট প্রণয়ন করেন। এই এ্যাক্ট গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেই দিনটি স্মরণ করে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো দিবসটি উদ্যাপিত হয়।
×