ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষি জমি সুরক্ষায়

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

কৃষি জমি সুরক্ষায়

দেশে কৃষি জমির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। তার প্রভাব পড়ছে ফসল উৎপাদনে। সেই সঙ্গে অপরিকল্পিত নগরায়ন, বাড়িঘর নির্মাণ, জলাভূমি ভরাট, চিংড়ি চাষ, তামাক চাষ, দোকানপাট নির্মাণ, হাউজিং সোসাইটি, ইটভাঁটি, বনভূমি ধ্বংস করার আত্মবিনাশী প্রক্রিয়া চলছে। এভাবে চলতে থাকলে বসবাস উপযোগী পরিবেশই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, নিকট-ভবিষ্যতে সমগ্র জনগোষ্ঠীই এক বিপর্যয়কর অবস্থায় গিয়ে পড়বে। বাংলাদেশ ছোট একটি ভূখণ্ড। অথচ জনসংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ১৬ কোটি। এখনই মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ অতি সামান্য তারপরও যদি কৃষি জমি এমন দ্রুত হারে কমতে থাকে তাহলে এই জনসংখ্যার খাদ্যের যোগান দেয়া এক সময় কষ্টকর নয়, রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়বে। এমনিতে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমেই বাড়ছে। আর সে কারণে সাগরতীরের অপেক্ষাকৃত নিচু জমি লোনা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিতেও তার বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ২০৫০ সাল নাগাদ উপকূলীয় অঞ্চলের একটি বড় অংশই লোনা পানিতে তলিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নদী ও ভূখ- দিয়েও লোনা পানি ক্রমে দেশের মধ্যাঞ্চলের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ফসল, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যে তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর মরুকরণের প্রভাব ক্রমেই বেশি করে দেখা যাচ্ছে। ভূ-গর্ভের পানির স্তর অত্যাধিক নিচে নেমে যাওয়ায় এখনই অনেক জায়গায় গভীর নলকূপে পানি ওঠে না। খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি ভূ-গর্ভে যেতেও পারছে না। দেশে মোট ভূমির ষাট শতাংশ কৃষি কাজে ব্যবহৃত হলেও প্রতিবছর এক শতাংশ হারে ফসলি জমি হ্রাস পাচ্ছে। যার পরিমাণ ৬৯ হাজার হেক্টর বলে ধারণা করা হচ্ছে। ধ্বংসের হাত থেকে কৃষি জমি রক্ষা ও কৃষকের অধিকার রক্ষা করা যাচ্ছে না। ফসলি জমি সুরক্ষায় কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন ২০১৬ কিতাবে রয়েছে। বাস্তবে যা দৃশ্যমান নয়। আইন অনুযায়ী বাড়িঘর বা স্থাপনা তৈরির জন্য আগাম ছাড়পত্র নেয়ার বিধান বাধ্যতামূলক। গ্রামাঞ্চলে ইউনিয়ন পরিষদ এ ছাড়পত্র প্রদানের কর্তৃপক্ষ। আইন অমান্য করলে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদ- ও পঞ্চাশ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। এটি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। তবে আইনের প্রয়োগের ব্যর্থতা সীমাবদ্ধতা এবং এ কারণে জনজীবনে ভোগান্তি সৃষ্টির আশঙ্কা ছিল আইন পাসের পর। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয় না। ফলে আশঙ্কাজনক হারে কৃষি জমি কমছে। কৃষি জমি রক্ষার জন্য ভূমির যথেচ্ছ ব্যবহার রোধ করা জরুরী। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই ১২ বছরে দেশে প্রতিবছর ৬৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর আবাদি জমি অকৃষিখাতে চলে গেছে। অথচ আগের তিন দশকে প্রতিবছর ফসলি জমি কমেছে গড়ে ১০ হাজার ৪১২ হেক্টর। একই সঙ্গে প্রতিবছর আবাসন খাতে ৩০ হাজার ৮০৯ হেক্টর, নগর ও শিল্পাঞ্চলে চার হাজার ১২ হেক্টর এবং মাছ চাষে তিন হাজার ২১৬ হেক্টর জমি যুক্ত হচ্ছে। ইটভাঁটির জন্য কৃষি জমিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইট তৈরির মাটি সংগ্রহ করা হচ্ছে কৃষি জমির সবচেয়ে উর্বর অংশ জমির উপরিভাগের মাটি। কৃষি জমি যথাসম্ভব কৃষিকাজে ব্যবহার নিশ্চিত করা ভূমি ব্যবহার নীতির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলেও বাস্তব অবস্থা এর বিপরীত। কিন্তু এ নীতির বাস্তবায়ন চোখে পড়ে না। গ্রামীণ বাড়িঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে বহুতল ভবন হতে পারে কৃষি জমি রক্ষার অন্যতম উপায়। অপরিকল্পিত ঘরবাড়ি, অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ করা জরুরী। অবশ্য কেবল আইন তৈরি করে বা তা প্রয়োগ করে না। প্রয়োজন গণসচেতনতা ও গণআন্দোলনের। সুনির্দিষ্ট আইনী বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও কীভাবে দিন দিন কৃষি জমি লোপ পাচ্ছে, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অজানা থাকার কথা নয়। তারপরও কেন লাগাম টেনে ধরা হচ্ছে না, তা অস্পষ্ট। দেশের ভবিষ্যতকে গুরুত্ব প্রদান করা না হলে ধ্বংস অনিবার্য।
×