ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান

ফুটবলে ফিরতে মরিয়া মনিকা

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ফুটবলে ফিরতে মরিয়া মনিকা

ছোটবেলায় ছেলেদের মতো চুলের ছাঁট এবং প্যান্ট-শার্ট পরতো ফুটফুটে চেহারার পাহাড়ি শিশুকন্যাটি। সবাই ডাকতো ‘মুন্না’ বলে! যদিও তার নাম মনি। পুরো নাম মনিকা চাকমা। পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন, আমি হয়তো বাংলাদেশ জাতীয় অ-১৫ মহিলা ফুটবল দলের মিডফিল্ডার মনিকা চাকমার কথা বলছি। না, এই মনিকা আরেক মনিকা। মনিকা চাকমা সিনিয়র। আজ থেকে ছয় বছর আগে জাতীয় বয়সভিত্তিক দলের অন্যতম সেরা ফুটবলার ছিল মনি। দাপটের সঙ্গে খেলেছিল বছর তিনেক। তারপরই হঠাৎ করেই যেন বেমালুম গায়েব হয়ে গেল মেয়েটি। একসময় সবাই যেন ভুলেই গেল তার কথা। ভুলে গিয়েছিলাম আমি নিজেও। কিন্তু ছয় বছরে আগের সেই মনিকাকে মনে করিয়ে দিল বর্তমান মনিকা, অ-১৫ দলের মনিকা। গত ডিসেম্বরে সাফ অ-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপে দারুণ খেলে সবার নজর কেড়েছে সে। তাকে একাধিকবার ইন্টারভিউও করেছি। তারপরই হঠাৎ মনে পড়ে গেল, ওর নামেই তো আরেকজন ছিলÑ যাকে একবার ইন্টারভিউ করেছিলাম সেই ২০১৪ সালের অক্টোবরে। কোথায় গেল মেয়েটা? তার আর কোন খোঁজই নেই! ঠিক করলাম হারিয়ে যাওয়া মনিকার সন্ধান পেতে হবে। কিন্তু কেউই বলতে পারে না তেমন কিছু। যখন হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেবার মতো অবস্থাÑ তখনই খুঁজে পেলাম অতীতের সেই মনিকাকে। কিভাবে জানেন? বর্তমানের মনিকার মাধ্যমেই! বর্তমানের মনিকাকে অতীতের মনিকা সম্পর্কে একদিন জিগ্যেস করলাম। বললো, ‘মনিকা আপু তো আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড।’ ব্যস, ফেসবুক আইডির লিংক নিয়ে মেসেজ দেয়া, ফোন নম্বর নেয়া এবং একসময় কথা বলতে সক্ষম হওয়া। শুরতে অবশ্য কথা বলতে অনীহাই ছিল মনিকার। পরে অবশ্য মন খুলেই বলেছে সবকিছু। সমাধান হয়েছে অমীমাংসিত রহস্যের। জানা গেছে সবকিছু। অপরিণত বয়সের অপরিণামদর্শী- আবেগী-ভুল সিদ্ধান্ত, খেলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলা এবং মায়ের আপত্তিই ছিল মূল কারণ। বাবা ধীরেশ চাকমা। আগে জুম চাষ করতেন। এখন অবসরে। মা রেনুকা চাকমা, একটি এনজিওতে চাকরি করেন। তাদের এক ছেলে, এক মেয়ে। মনিকাই বড়। ছোটভাই পান্না লাল চাকমা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। ১৯ বছরের সুদর্শনা-তন্বী তনুলতা মনিকার (১৯৯৮ সালের ২৪ মে জন্ম) ফুটবল আসার গল্পটা কেমন? ‘শৈশবে শান্ত-শিষ্টই ছিলাম। তখন থেকেই ফুটবল খেলার প্রতি আগ্রহ ছিল। এছাড়া টিভিতে বিশ্বকাপের খেলা দেখে খেলাটার প্রতি আরও আকর্ষিত হয়ে পড়ি। ছেলেদের সঙ্গেই খেলতাম।’ এখন চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে কম্পিউটার বিষয় নিয়ে মনিকা পড়ছে প্রথম বর্ষে। তাকে অনুরোধ করলাম ফুটবল থেকে সরে দাঁড়ানোর কাহিনীটা শোনাতে। সঙ্গে সঙ্গেই মনিকা ফিরে গেল ২৩ অক্টোবর, ২০১৪ সালের সেই দিনটায়। এএফসি অনুর্ধ-১৬ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বের খেলা। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে নিজেদের শেষ ম্যাচে ইরানের মুখোমুখি হয় স্বাগতিক বাংলাদেশ। ম্যাচে ১-২ গোলে হেরে যায় লাল-সবুজরা। ওই ম্যাচেই খেলতে গিয়ে ডান পায়ের পেশীতে মারাত্মক চোট পায় বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মনিকা। তারপরের ঘটনা এরকম : ক্যাম্প ক্লোজ হয়ে যায়। ফুটবলাররা যে যার বাড়ি চলে যায়। মনিকাও চলে যায় রাঙামাটি। পায়ের চোট সারাতে শরণাপন্ন হয় স্থানীয় এক কবিরাজের। পরে অবশ্য ডাক্তার দেখায়। তিনি জিম এবং সুইমিং করার এবং ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন। যাহোক, মনিকার ইনজুরি সারতে লেগে যায় দেড় মাস। এই সময়ের মধ্যেই ঢাকায় আবারও ক্যাম্প শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু মনিকা আর ফিরে যায়নি। কেন? ‘মায়ের জন্য। তিনি বলেন, তোর আর খেলতে হবে না, আমার কাছেই থাক। তোকে ছাড়া থাকতে পারব না। আমিও তখন খুবই ঘরকুনো হয়ে গিয়েছিলাম। মাকে ছাড়া ঢাকায় গিয়ে থাকার কথা চিন্তা করতে পারতাম না। তাই আর ঢাকায় ক্যাম্পে ফিরে যাইনি।’ অবশ্য এই সময়ে বাফুফেও কোন খোঁজ-খবর নেয়নি বলে জানায় মনিকা। ফলে ফিরে যেতে তাগিদ-আগ্রহ পুরোপুরিই হারিয়ে ফেলে সে, ‘তবে কোচ ছোটন স্যার ব্যক্তিগতভাবে একবার খবর নিয়েছিলেন। কিন্তু আমি না বলে দিয়েছিলাম!’ এখন অবশ্য সেই সিদ্ধান্তের জন্য আক্ষেপ করে সাবিনা খাতুন ও মাইনু মারমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মনিকা। আরও আফসোস করে এই ভেবেÑওই সময়ে খেলা চালিয়ে গেলে মাসুরা, রাজিয়া, সানজিদা, কৃষ্ণা, রতœা, নার্গিস, মৌসুমী, শিউলীদের মতো সে-ও তো বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলগুলোর হয়ে সাফল্যের স্বাদ নিতে পারত। ২০১৫ সালে অবশ্য একবার ঢাকা ব্যক্তিগত কাজে গিয়ে ক্যাম্পে গিয়েছিল মনিকা। দল তখন পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য সাফ ফুটবলে খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ক্যাম্পের সবার সঙ্গে দেখা করে এসেছিল মনিকা। এখন কি জাতীয় দলে ফিরতে মন চায় না? অনেকক্ষণ নীরব থেকে মনিকার জবাব, ‘চাই। ভীষণ ইচ্ছে করে আবারও জাতীয় দলের হয়ে খেলতে। এজন্য অবশ্য আমাকে ফিটনেস ফিরে পেতে হবে। ফুটবলে ফিরতে হবে। গত জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ইন্টারভিউ দিয়ে পুলিশে চাকরি পেয়েছি কনস্টেবল পদে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে চট্টগ্রামে পোস্টিং হবে। আমি খুব খুশি পুলিশে চাকরির পাশাপাশি তাদের হয়ে নিয়মিত আবারও ফুটবল খেলতে পারব বলে। এভাবে যদি ধাপে ধাপে ভাল খেলে আবারও যদি বাফুফের নজরে পড়তে পারি।’ যদি ফুটবলে আর ফিরতে না পারে, তাহলে পরবর্তী করণীয়ও ভেবে রেখেছে মনিকা, ‘ডিএফএতে কোচ হব। ফুটবলের সঙ্গেই থাকতে চাই।’ রাঙামাটির মেয়ে হয়ে জাতীয় দলে খেলার গর্ব এখনও ছুঁয়ে যায় মনিকাকে। বর্তমানে অ-১৫ জাতীয় দলে ঋতুপর্ণা চাকমাও রাঙামাটির মেয়ে। ঋতুর খেলার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে মনিকা। চার বছর ধরে ফুটবলের বাইরে থাকলেও নিজের ফিটনসে ধরে রাখতে নিয়মিত ভলিবল খেলে বলে জনকণ্ঠকে জানায় মনিকা, ‘এখন চট্টগ্রামে থাকি পড়াশোনার সুবাদে। সেখানেই ভলিবল খেলি নিয়মিত। আমরা সহপাঠীরা আগে জানতো না আমি জাতীয় দলের ফুটবলার ছিলাম। যখন জানল, তখন বলেছে তুই সেই মনিকা? তোর খেলা তো আমরা টেভিতে কত দেখেছি!’ লেখার শুরতেই বর্তমান অ-১৫ দলের এ্যাটাকিং মিডফিল্ডার মনিকা চাকমার কথা বলেছিলাম। তার বাড়ি খাগড়াছড়ি। এ প্রসঙ্গে রাঙামাটির মনিকা চাকমা সিনিয়রের ভাষ্য, ‘ও আমার জুনিয়র। আমরা জাতীয় দলে একসঙ্গে না খেললেও রাঙামাটিতে একটা সময় একসঙ্গে স্থানীয়ভাবে অনুশীলন করেছি। গোলরক্ষক রূপনা চাকমাও করেছে (বর্তমানে অ-১৫ জাতীয় দলের খেলোয়াড়)।’ যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে মনিকা (রাঙামাটির মঘাছড়ি প্রাইমারি সরকারী বিদ্যালয়), তখন ২০১০ সালে ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট’ দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু তার। সেবার তার স্কুল বিভাগীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। দলের ক্যাপ্টেন ছিল মনিকা। তারপর খেলে চট্টগ্রাম বিভাগের হয়ে। সেবার ওই আসরে হয়েছিল টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। তারপর ধাপে ধাপে উঠে এসে সুযোগ পায় জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে। প্রথমে ডাক পায় অ-১৪ দলে। ওই দলের সবচেয়ে জুনিয়র প্লেয়ার ছিল মনিকাই। তাদের দলটি ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত এএফসির টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে তৃতীয় স্থান (কোচ ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক) এবং ফেয়ার প্লে ট্রফি জিতেছিল। ওই আসরে মনিকা গোল করেছিল তিনটি। এর দু’বছর পরেই ২০১৪ সালে স্বীয় নৈপুণ্যে প্রজ্বলিত হয়ে অ-১৬ দলের অধিনায়ক হয়ে যায় মনিকা (এর মধ্যেই বাংলাদেশ আনসারের হয়ে ২০১৩-১৫ সাল পর্যন্ত খেলে)। ঘরের মাটিতে এএফসি অ-১৬ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বের খেলায় অংশ নেয়। প্রথম ম্যাচেই বাংলাদেশ মোকাবেলা করে তাদের চেয়ে র‌্যাংকিংয়ে অনেক এগিয়ে থাকা জর্দানের। ফুটবলপ্রেমীরা ধরেই নিয়েছিলেন ম্যাচে বাংলাদেশ দল গো-হারা হারবে। কিন্তু প্রি-ম্যাচ কনফারেন্সে অধিনায়ক মনিকার কথা শুনে হতবাক হয়ে যান সবাই, ‘জানি জর্দান আমাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী দল। কিন্তু আমরা হারার আগে হারতে চাই না। লড়াই করব। জেতার জন্য দরকার হলে জান দিয়ে দেব!’ কিন্তু জান নয়, গোল দিয়েই জর্দানের বিরুদ্ধে ১-০ গোলে (সানজিদার গোল) ঐতিহাসিক জয় কুড়িয়ে নেয় মনিকাবাহিনী। ওই ম্যাচের ঘটনা রোমন্থন করে এখনও নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়, ‘ওটা ছিল আমার ক্যারিয়ারের সেরা ম্যাচ। কোচ ছোটন স্যার বলেছিলেন ভালমতো খেল। মোটেও ডিফেন্স করে খেলা যাবে না। তারপরও খুবই স্নায়ুচাপে ছিলাম।’ জাতীয় দলে ফুটবল খেলে নিজের এলাকায় কেমন সাড়া পেতে? ‘দারুণ। এলাকায় আসলে তো আমাকে সবাই ফুল দিয়ে বরণ করে নিত। এমনকি দাওয়াত করেও খাওয়াতো। এবার স্থানীয় একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলি। আমাদের চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় খেলা দেখতে এসেছিলেন। খেলা শেষে আমার অনেক প্রশংসা করেছিলেন। এটা ছিল আমার জন্য অনেক বড় সম্মান।’ মনিকা সম্পর্কে জাতীয় নারী ফুটবল দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন বলেন, ‘খুবই ভাল ফুটবলার ছিল মনিকা। একটু ধীরগতি সম্পন্ন হলেও আক্রমণ তৈরিতে ছিল দক্ষ-কুশলী। দলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ও ছিল। সবদিক বিবেচনা করেই তাকে অ-১৬ দলের অধিনায়ক নির্বাচিত করেছিলাম। খেলাটা চালিয়ে গেলে এখন নিশ্চয়ই আরও উন্নতি করতো সে। তার এভাবে হারিয়ে যাওয়াটা সত্যিই দুঃখজনক।’ একসময় সাবিনা খাতুন ও লিওনেল মেসির ভক্ত মনিকার এখন ভাল লাগে আঁখি খাতুনের খেলা। ‘বাংলাদেশ দলে আঁখির মতো এমন লম্বা খেলোয়াড় আরও দরকার।’ দেশের কোন পুরুষ ফুটবলারের খেলা ভাল লাগে? ‘কাউকেই না। কারণ তারা তো জাতীয় দলের হয়ে কোন রেজাল্টই করতে পারে না!’ অবসরে টিভি দেখা, ফেসবুকিং করা, বই পড়া এবং ভ্রমণ করা মনিকার সাফ জবাব। কদিন আগে বাফুফে সভাপতি কাজী মোঃ সালাউদ্দিন ঘোষণা দিয়েছেন ২০১৮ সালে আবারও চালু হবে মহিলা ফুটবল লীগ। এছাড়া জাতীয় মহিলা ফুটবলারদের বেতনের আওতায় আনা হবে। এ প্রসঙ্গে মনিকার অভিমত, ‘এসব কথা যখন খেলতাম, তখনও শুনেছি। যদি এবার সেগুলো বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে আর কোনদিনই হবে না।’ স্থানীয় পর্যায়ে মনিকার মা-ও একসময় ফুটবল খেলতেন। কিন্তু কখনই জাতীয় দলের হয়ে খেলার স্বপ্নপূরণ হয়নি তার। তার সেই অপূর্ণ স্বপ্নপূরণ করা মনিকা একসময় পথ হারিয়ে ফেলে। এখন আবার ফিরতে চায় সেই চিরচেনা ফুটবল-ভুবনে। তার ফেরার এই আকুলতা কি শুনবে বাফুফে?
×