ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দশ বছর পর আবার নুরুল ইসলাম মৃত্যু মামলার তদন্ত শুরু

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

দশ বছর পর আবার নুরুল ইসলাম মৃত্যু মামলার তদন্ত শুরু

গাফফার খান চৌধুরী ॥ প্রায় দশ বছর পর আবারও আলোচনায় এসেছে একমাত্র পুত্রসহ গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি নুরুল ইসলামের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা। এ সংক্রান্ত ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটির নতুন করে তদন্ত শুরু হয়েছে। ঢাকার সিএমএম আদালতের নির্দেশে মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মঙ্গলবার নতুন করে নুরুল ইসলামের স্ত্রী সাবেক এমপি রুবি আক্তারের জবানবন্দী গ্রহণ করেছে পিবিআই। নিহত নুরুল ইসলাম নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। নোয়াখালী-১ আসন থেকে তার নির্বাচন করার কথা ছিল। নির্বাচনের আগেই বাসায় রহস্যজনক অগ্নিকা-ের ঘটনায় একমাত্র ছেলেসহ তার মৃত্যু হয়। ঘটনার সময় স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ে কাকতালীয়ভাবে বাসার বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রোর অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মোঃ বশির আহমেদ এ তথ্য নিশ্চিত করে জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকার সিএমএম আদালতের নির্দেশে দীর্ঘ সময় পর মামলাটির তদন্ত শুরু করেছেন তারা। ইতোমধ্যেই মামলার যাবতীয় নথিপত্র তাদের কাছে এসেছে। মামলার আলামতও সংরক্ষিত রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে ৮৬৪ পৃষ্ঠার বিভিন্ন প্রতিবেদন। এসব প্রতিবেদনের পর্যালোচনা চলছে। ইতিপূর্বে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি, র‌্যাব ও ডিবি পুলিশ মামলাটির তদন্ত করেছে। তদন্তকারী সংস্থাগুলো আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডও ঘটনাটির পৃথক তদন্ত করে। আদালতে দায়েরকৃত চূড়ান্ত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে নিহতের পরিবার অসন্তোষ প্রকাশ করে। তারই প্রেক্ষিতে আদালত পিবিআইকে মামলাটির নতুন করে তদন্তের নির্দেশ দেয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তদন্তকারী সংস্থাগুলোর তদন্ত রিপোর্ট মোতাবেক পিতা-পুত্রের মৃত্যুর পেছনে কোন রহস্য নেই। তাদের তদন্ত মোতাবেক বাসায় থাকা ফ্রিজের কম্প্রেসার বিস্ফোরিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে। তদন্তকারী সংস্থাগুলোর এমন তথ্যের সঙ্গে গরমিল হয় বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের তদন্তে। ফায়ার সার্ভিসও ঘটনাটির তদন্ত করে। পিডিবির তদন্ত মোতাবেক কোন বৈদ্যুতিক গোলযোগ বা শর্টসার্কিট থেকে বা ফ্রিজের কম্প্রেসার বিস্ফোরিত হয়ে ঘটনাটি ঘটেনি। তবে কি কারণে ঘটনাটি ঘটেছে তা পিডিবি নিশ্চিত করতে পারেনি। পিডিবির তদন্ত মোতাবেক সামান্য একটি ফ্রিজের কম্প্রেসার বিস্ফোরিত হয়ে এতবড় অগ্নিকা- হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। আগুন লাগলেও তা এতই দ্রুত ঘরে ছড়িয়ে পড়ে যে, ভেতরে থাকা দুইজন ব্যক্তি ঘরের দরজা দিয়ে বের হতে পারল না। এমন যুক্তি অমূলক। এরই প্রেক্ষিতে নিহতের পরিবার আদালতে তদন্তে অসন্তোষ প্রকাশ করে নারাজি আবেদন করে। এজন্য মামলাটির নতুন করে তদন্ত শুরু হয়। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক নাসির উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, অত্যন্ত আলোচিত এ মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। মঙ্গলবার ঢাকার ধানম-ির ২৮ নম্বরের ভাড়া বাসায় নিহতের স্ত্রী আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক এমপি রুবি রহমানের (৬৫) জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়েছে। রুবি রহমান পিবিআইকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিচ্ছেন। এজন্য নতুন করে প্রয়োজনে ঘটনাস্থল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পরিদর্শন করা হবে। পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ২ ডিসেম্বর রাত সাড়ে তিনটার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানাধীন লালমাটিয়ার বি ব্লকের ২৩/২৪ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলার এ/৪ নম্বর ফ্ল্যাটে ঘটনাটি ঘটে। ওই রাতে নুরুল ইসলাম (৬৬) ও তার ছেলে তমোহর ইসলাম পূঁচি (৩৫) রাতের খাবার খেয়ে যথারীতি ঘুমিয়ে পড়ে। রাত সাড়ে তিনটার দিকে আশপাশের লোকজন বাড়িতে আগুন দেখতে পান। আর ঘটনার সময় বাড়ির ভেতরে থেকেও চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসছিল। স্থানীয় লোকজন ও ফায়ার সার্ভিস দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ওই ফ্ল্যাটের দরজার কাছ থেকে তমোহরের লাশ উদ্ধার করে। আর গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় নুরুল ইসলামকে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলতে থাকে। সেখানে তিনি তার জবানবন্দীও দেন তদন্তকারী সংস্থার কাছে। এমন রহস্যজনক অগ্নিকা-ের বিষয়ে তিনিও সন্দেহ পোষণ করেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য পরে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিন দিন পরে সিএমএইচেই তার মৃত্যু হয় বলে বলছেন মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক নাসির উদ্দিন। নুরুল ইসলাম ওই সময় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরীক দল গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি ছিলেন। তিনি নোয়াখালী-১ আসন থেকে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত এমপি প্রার্থী ছিলেন। নৌকা মার্কায় তার নির্বাচন করার কথা ছিল। আর তার ছেলে নিহত পূঁচি একটি বেসরকারী কোম্পানিতে চাকরি করতেন। নুরুল ইসলামের স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ে কাকতালীয়ভাবে ওইদিন বাসার বাইরে থাকায় বেঁচে যান। মেয়েটি বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। এমন ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। নিহতের ভায়রা জিএম হাসান এ ব্যাপারে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় কাউকে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়নি। বছর পাঁচেক আগে বার্ধক্যজনিত কারণে মামলার বাদীর মৃত্যু হয়। মামলা দায়েরের পরপরই বাড়িটির নিরাপত্তাকর্মীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। কিন্তু সন্দেহজনক কোন কিছু পাওয়া যায়নি। থানা পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট দেয়। থানা পুলিশের পর পর্যায়ক্রমে মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি, র‌্যাব ও ডিবি তদন্ত করে। তদন্তকারী সংস্থাগুলো আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দেয়। রিপোর্টে বলা হয়, পুত্রসহ নুরুল ইসলামের মৃত্যু দুর্ঘটনাজনিত কারণে হয়েছে। সেখানে ফ্রিজের কম্প্রেসার বিস্ফোরণের ওপর জোর দেয়া হয়। কিন্তু এমন রিপোর্টে আপত্তি করে নিহতের পরিবার। এরপর মামলাটির কার্যক্রম প্রায় পাঁচ বছর স্থগিত ছিল। চলতি মাসেই বিষয়টি নজরে এলে ঢাকার সিএমএম আদালত নতুন করে মামলাটির তদন্তের ভার দেয় পিবিআইকে।
×