ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গীদের ৮২ ভাগই উদ্বুদ্ধ হচ্ছে ইন্টারনেট থেকে

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

জঙ্গীদের ৮২ ভাগই উদ্বুদ্ধ হচ্ছে ইন্টারনেট থেকে

শংকর কুমার দে ॥ গ্রেফতার হওয়া ৭০০ জঙ্গীর ওপর চালানো এক জরিপে দেখা গেছে ইন্টারনেট ভিত্তিক জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছে ৮২ ভাগ তরুণ-যুবক। পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক মোঃ মনিরুজ্জামান এই পরিসংখ্যান তুলে ধরেন আন্তর্জাতিক পুলিশ সম্মেলনে। গত সোমবার র‌্যাব-২ এর একটি অভিযানিক দল রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে মোঃ নুরুজ্জামান লাবু ও নাজমুল ইসলাম শাওনকে গ্রেফতারের পর তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলেছে, তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনলাইনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে প্রায় ৪০-৫০ জন সমমনা উগ্রবাদীদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে জঙ্গী তৈরি করেছে। পুলিশ সদর দফতর ও র‌্যাব সূত্রে এ খবর জানা গেছে। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানে জঙ্গী সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক ক্রমশ দুর্বল ও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জঙ্গীরা পুনরায় একত্রিত হয়ে নেটওয়ার্ক দৃঢ় করার চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্যে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সমমনাদের একত্রিত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এই ধরনের প্রেক্ষাপটে র‌্যাব তাদের গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে জঙ্গীরা অনলাইনে উগ্রপন্থা চর্চা ও জঙ্গী তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে। জঙ্গীবিরোধী অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে অনলাইনে নানা ধরনের প্রচারণা। ইন্টারনেটে নানা নামে ওয়েবসাইট-ব্লগ খুলে জঙ্গীবাদের প্রচার চলছে। ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ এবং ইউটিউবে ভিন্ন ভিন্ন নামে চ্যানেল খুলেও এ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। জঙ্গীদের ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে যেসব কনটেন্ট রয়েছে তার বেশিরভাগ সরাসরি জঙ্গী কার্যক্রমকে উসকে দিচ্ছে। এভাবে অনলাইন কার্যক্রমের মাধ্যমে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে উগ্রপন্থা চর্চা এবং জঙ্গীবাদে ধাবিত করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যানুযায়ী, দেশের ভেতর ও বিদেশ থেকে অনলাইনে জঙ্গীবাদ উসকে দেয়া হচ্ছে। পাকিস্তানসহ বিভিন্ন বিদেশী থেকেও জঙ্গীবাদের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে বলে তথ্যাদি পেয়ে তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে জঙ্গীবাদ দমনে পরামর্শ করতে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল ও বাংলাদেশ পুলিশ আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করে ঢাকা। ঢাকায় আয়োজিত এ সম্মেলনে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোসহ মোট ১৪টি দেশের পুলিশ প্রধান ও শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেন। এতে অংশ নেন পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), অস্ট্রেলিয়ার অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পুলিশ (এএফপি)সহ আসিয়ান পোল, অপরাধ তদন্ত নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারপোল গ্লোবাল কমপ্লেক্স ফর ইনোভেশন (আইজিসিআই), ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ট্রেনিং এ্যাসিসটেন্স প্রোগ্রাম কর্মকর্তারা। সেই সম্মেলনে পুলিশের ডাকে সাড়া দিয়েছে ফেসবুকও। ইন্টারনেট ভিত্তিক অনলাইনে জঙ্গী তৎপরতা দমনে ফেসবুকের সাহায্য চাওয়া হয়। বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক মোঃ মনিরুজ্জামান বাংলাদেশ পুলিশের জরিপ চালানো পরিসংখ্যান তুলে ধরেন সম্মেলনে। তিনি বলেন, ৭০০ জঙ্গীর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে ৮২ ভাগ তরুণ নিজেরাই নিজেদের উদ্বুদ্ধ করেছে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এ সমস্যা সমাধানে ফেসবুকের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ। র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানে জঙ্গী সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়লেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জঙ্গীরা পুনরায় একত্রিত হয়ে নেটওয়ার্ক দৃঢ় করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সমমনাদের একত্রিত করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করার পর গোপন তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-২ এর একটি আভিযানিক দল অভিযান পরিচালনা করে গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায়। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সোনালী ব্যাংক মোড় হতে জেএমবি সদস্য (১) মোঃ নুরুজ্জামান লাবু ও নাজুমল ইসলাম শাওনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত দুই জনের কাছে ০২টি চাপাতি, জঙ্গীবাদী বই, ৭২৪ ইউএস ডলার এবং অন্যান্য সামগ্রী উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে, তারা জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সক্রিয় সদস্য হয়ে কাজ করছে। র‌্যাব সূত্র জানান, গ্রেফতারকৃত মোঃ নুরুজ্জামান লাবু’কে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, সে প্রথম জীবনে বাসের হেলপার, ট্রাকের হেলপার, লন্ড্রি দোকানে কাজ করত। বর্তমানে সে একজন দিনমজুর ও রিক্সাচালক হিসেবে জীবনযাপন করছে। সে ২-৩ মাসের জন্য মাদ্রাসায় ভর্তি হলেও পড়ালেখা শেষ করা সম্ভব হয়নি। সে ইতিপূর্বে জামায়াত ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। এরপর ২০১৫ সালে জনৈক সাইফ, রুবেল, রবিন, সাগর, মারুফ, সোহাগ শিহাব এর মাধ্যমে ধর্মীয় উগ্রবাদীতায় প্রবেশ করে। এসব জঙ্গীদের মধ্যে একজনের ভিন্ন নামে পরিচিত আছে। তারা তাকে (লাবু) জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করে বিধর্মীদের হত্যা ও আক্রমণ করতে অনুপ্রাণিত করত। বিভিন্ন সময়ে সে ঝিনাইদহ এলাকায় স্কুল মাঠে ও একটি গ্যারেজে সমমনাদের নিয়ে গোপনে বৈঠক করত। তাকে স্থানীয় জেএমবি’র পক্ষ থেকে একটি অটোরিক্সা ক্রয় করে দেয়া হয়। উক্ত রিক্সা চালানোর অজুহাতে সে বিভিন্ন এলাকায় রেকি করত এবং মুসলিম হতে ধর্মান্তরিত খ্রীস্টানদের অনুসরণ করত। ইতোমধ্যে জনৈক এক খ্রীস্টান যিনি সম্প্রতি মুসলিম ধর্ম হতে ধর্মান্তরিত হয়েছিল তাকে কুপিয়ে হত্যা করার জন্য সে প্রতিনিয়ত অনুসরণ করত বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। সে বর্তমানে ঝিনাইদহ অঞ্চলের জেএমবি’র আঞ্চলিক পর্যায়ের নেতা বলে জানায়। এছাড়াও সে বোমা বানাতে বিশেষভাবে পারদর্শী বলে স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছে নুরুজ্জামান লাবু। র‌্যাব সূত্র জানান, গ্রেফতারকৃত অপর জেএমবি সদস্য নাজমুল ইসলাম শাওন’কে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সে পেশায় একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। ২০১৫ সালে তার মধ্যে উগ্রবাদী ধর্মীয় মতাদর্শের প্রতি আসক্তি সৃষ্টি হয়। অতঃপর উগ্রবাদী সংক্রান্ত বিভিন্ন বই পুস্তিকা পড়ার মাধ্যমে ধর্মীয় উগ্রবাদী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে সে ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন উগ্রবাদী পোস্ট শেয়ার করত। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে ফেসবুকের মাধ্যমে আবু আব্দুল্লাহ নামক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। উক্ত আব্দুল্লাহর মাধ্যমে সে জেএমবিতে অন্তর্ভূক্তি হয়। ২০১৫ সালে আব্দুল্লাহর সূত্র ধরে জেএমবির অপর সদস্য মোঃ সুলায়মান ওরফে আজাহারের সঙ্গে পরিচয় হয়। উক্ত সুলায়মানের নির্দেশক্রমে সে একই পেশাজীবীদের ছাড়াও অন্যান্য পেশায় কর্মরতদের মাঝে উগ্রবাদী মতাদর্শ প্রচারের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে অন্তর্ভূক্ত করত বলে জানিয়েছেন নাজমুল ইসলাম শাওন। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গীদের ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেলে ইংরেজী, আরবী, উর্দুর পাশাপাশি সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে বাংলায়ও বিভিন্ন কনটেন্ট আপলোড করা হচ্ছে। বিশেষ করে অডিও-ভিডিও এবং ধর্মীয় বিভিন্ন অপব্যাখ্যা সংবলিত প্রচারণা। অনলাইনে প্রচারণায় সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। তারা আনসার আল ইসলাম, তিতুমীর মিডিয়া, আস সাহাব মিডিয়া, দাওয়াহ ইলাল্লাহ ফোরাম, সালাউদ্দিনের ঘোড়াসহ বেশ কয়েকটি মিডিয়ার মাধ্যমে জঙ্গীবাদ উসকে দিচ্ছে। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি পরিচালিত ‘আত-তামকীন’ নামে একটি জঙ্গী ওয়েবসাইটের সঙ্গে সম্পৃক্ত ৬ জনকে ইতোপূর্বে আটক করে র‌্যাব। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে র‌্যাব-পুলিশ অনলাইনে জঙ্গীবাদ কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে জড়িত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অন্তত ১০ জনকে গ্রেফতার করে জঙ্গীদের অনলাইন কার্যক্রম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যেসব ফেসবুক আইডি বা পেজ, ব্লগ, ওয়েবসাইটে ধর্মীয় উসকানিমূলক উগ্র মতবাদ ছড়ানো হচ্ছে কার্যকর পদক্ষেপ চলমান রয়েছে সেগুলো বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।
×