ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ফাদার গৌরব জি.পাথাং

ভালবাসা, ভাল থেকো

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ভালবাসা, ভাল থেকো

আজ বিশ্ব ভালবাসা দিবস। এই ভালবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইন ডে অনেকের কাছে, বিশেষ করে যুবক-যুবতীদের কাছে এক প্রত্যাশিত এবং প্রতীক্ষিত দিন। কারণ যুবক-যুবতীরা এ দিনের প্রতীক্ষায় ব্যাকুল হয়ে থাকে। বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় তাদের কাছে এ দিনের গুরুত্ব অনেক। এ দিন শুধু ভালবাসার দিন। বছরের যে কোন দিনই ভালবাসা যায়। তারপরও এ দিনটি বিশেষ একটি দিন। এ দিন ভালবাসাকে অনুভব করার দিন, এ দিন ভালবাসাকে ভালবাসার দিন। এ দিন নতুন করে বলবার দিন- আমি তোমায় ভালবাসি। ভালবাসা, ভাল থেকো। বর্তমানে ভালবাসা দিবস পালনের আরও তাৎপর্য রয়েছে। ভালবাসার মহত্ত্ব যেন মানুষ বুঝতে পারে, ভালবাসার মর্যাদা যেন দিতে পারে এবং ভালবাসা যেন দিন দিন সবার হৃদয়ে বৃদ্ধি পায় সেজন্য দিনটিকে পালন করা উচিত। প্রেমিক প্রেমিকা পরস্পরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাবে শুধু তা-ই যেন মুখ্য না হয় বরং ভালবাসা যেন তারা হৃদয়ে উপলব্ধি করে। প্রকৃত ভালবাসা উপলব্ধির জন্যই ভালবাসা দিবসের প্রয়োজন। কারণ, প্রকৃত ভালবাসার জন্যই এ দিবসের সূচনা। এ দিবসের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাব যে, ভালবাসাকে কেউ থামিয়ে বা দমিয়ে রাখতে পারে না। বিপুল জলরাশি এসেও ভালবাসার অগ্নি নিভিয়ে দিতে পারে না। তাই ভালবাসার অপর নাম শক্তি। যে শক্তি দূরকে নিকট, পরকে আপন করে তুলে। ভালবাসা দিবসের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে অনেকেই মনে করেন যে, ভ্যালেন্টাইনস ডে বা বিশ্ব ভালবাসা দিবস রোমান পাদ্রি সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারে এ দিবসে নাম ভ্যালেন্টাইনস ডে। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন একজন পাদ্রি ও চিকিৎসক। রোমান রাজ্যে খ্রিস্টের বাণী প্রচারিত হওয়ার আগে রোমানরা দেব-দেবীর পূজা করত। রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস খ্রিস্টের বাণী প্রচার করার অভিযোগে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদ-ের আদেশ দেন। সম্রাটের কাছে অপ্রিয় হলেও ভ্যালেন্টাইন ছিলেন সবার কাছে অতিপ্রিয়। ভ্যালেন্টাইন কারাগারে থাকার সময় কারারক্ষীর অন্ধ মেয়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয় এবং তাকে সারিয়ে তোলেন। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন মৃত্যুর আগে একটি চিঠি লিখে যান। সেখানে লেখা ছিল ‘লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। সেই কাহিনী অনুসারে সে দিন থেকে যুবক-যুবতীদের মধ্যে ভালবাসার বাণী পাঠানোর রীতি চালু হয়। অপরদিকে আরেকটি প্রচলিত কাহিনী আছে। ভ্যালেন্টাইন নামে এক পাদ্রি ছিলেন। তার সময় রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও জনবিরোধী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এ সময় তিনি দক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তোলার বাসনাও পোষণ করেছিলেন। কিন্তু রোমানরা স্ত্রী-কন্যা, পুত্র, পরিবার ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। সম্রাট তাই রাগান্বিত হয়ে যুবকদের বিয়ে নিষিদ্ধ করেন। ভ্যালেন্টাইন এ অমানবিক নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ করেন এবং গোপনে অনেক প্রেমিক জুটির বিয়ে দেন। এ রকম একটি গোপন বিয়ের অনুষ্ঠানে ভ্যালেন্টাইন ধরা পড়েন। সম্রাট তাকে কারাগারে বন্দী করেন। ভ্যালেন্টাইন সম্রাটের রোষানলে পড়লেও মানুষের ভালবাসার অভাব ছিল না। প্রতিদিন তাকে শত শত নর-নারী জানালা দিয়ে ফুল দিয়ে যেত। তিনি তার মৃত্যুর আগে শুভাকাক্সক্ষীদের কাছে চিরকুট রেখে যান। তাতে লেখা ছিল- ‘লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। সে দিন থেকে প্রিয়জনকে ভালবাসার বাণী পাঠানো শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় আজ সারা বিশ্বে বিশ্ব ভালবাসা দিবস পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও ভালবাসা দিবস মহাসমারোহে ও জাঁকজমকভাবে পালিত হচ্ছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন পার্ক, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের টিএসটি, হাতিরঝিল, রবীন্দ্র সরোবর, বিভিন্ন হোটেল রেস্টুরেন্টে যুবক-যুবতীদের ভালবাসায় মুখর হয়ে ওঠে। সেই ভালবাসা উপলব্ধি করতে হলে সেসব স্থানে যেতেই হবে। গত কয়েক বছর ঢাকা শহরে থেকে ভালবাসার একটা রহস্য গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি। হাতিরঝিলে আসা যাওয়ার পথে ছেলে মেয়ের ভালবাসা দেখে মুগ্ধ হয়েছি ও অবাক হয়েছি। সকালে ক্লাসে যাওয়ার সময় দেখতাম এক জায়গায় বসে ছেলে-মেয়ে গল্প করছে। ফেরার পথেও দেখতাম, সেই একই ছেলে-মেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই জায়গায় বসে আছে। শুধু তাই নয়, প্রখর রৌদ্রে বসে আছে। মাথায় ছাতা নেই, টুপি নেই, ছায়া নেই, তবুও তাদের মধ্যে কোন বিরক্তি নেই ও ঘৃণা নেই। লেকের পানিতে পঁচা আবর্জনার দুর্গন্ধ। তবুও তাদের জন্য এ কোন দুর্গন্ধই নয়। বসার জন্য কোন ভাল চেয়ার, বেঞ্চ কিংবা উপযুক্ত ঘাসও নেই। তবুও তাদের মধ্যে কোন তুচ্ছভাব নেই। ভালবাসার কাছে সবই যেন হার মেনে যায়। তীব্র রোদ, পঁচা আবর্জনা, ডাস্টবিনের দুর্গন্ধ, ধুলাবালি, ভিক্ষুকের বিরক্তি কোন কিছুই তাদের ভালবাসাকে ম্লান করতে পারে না, বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে না। তাদের এমন ভাব দেখে মনে পড়ে, ‘দোহাই তোদের, একটুকু চুপ কর, ভালবাসিবারে দে আমারে অবসর।’ তাদের ভালবাসায় কেউ বেঘাত সৃষ্টি করতে পারে না। তাদের সেই ভালবাসা দেখে আমি মুগ্ধ। এই ছেলে মেয়েকেই যদি রৌদ্রে কাজ করতে বলা হয়, কোন অনুষ্ঠানে মাটিতে বসতে বলা হয় নিশ্চিত করে বলতে পারি কোন মতেই ওরা মাটিতে বসবে না, রৌদ্রেও কাজ করবে না। তাই ওরা ভালবাসার জন্য যা পারে তা দেখে অভিভূত না হয়ে থাকা যায় না। ভালবাসার শক্তি তাদেরকে এসব করতে শক্তি যোগায়। তবে নিরাশার কথা হলো, ভালবাসা দিবস পালিত হলেও তার গুরুত্ব উপলব্ধি করছে না অনেকেই। আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে, শুভেচ্ছার মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হলেও প্রকৃত ভালবাসা প্রকাশিত হচ্ছে না। তাই দেখি আজও ভালবাসা মানুষের কামনার আগুনে জ্বলে-পুড়ে মরছে, ভালবেসে কেউ হারিয়ে যাচ্ছে, কেউবা ধর্ষিত হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত ভালবাসা তো হারিয়ে যাওয়ার কথা না, ধর্ষিত হওয়ার কথা না। ভালবাসা তো ভালবাসারই কথা। তবে কেন ভালবাসার এই বিপরীত অবস্থা? একথা সত্য যে, ভালবাসলেই সবার সাথে ঘর বাঁধা যায় না। ভালবাসলেই তাকে পেতে হবে এমনও নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের নায়ক অমিত লাবণ্যকে পায়নি, ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ উপন্যাসের নায়ক দেবদাস পার্বতীকে পায়নি, ‘লা লুই বেঙ্গলী’র লেখক ও নায়ক মির্চা এলিয়াড ‘ন হন্যতে’র লেখিকা ও নায়িকা মৈয়ত্রী দেবীকে পায়নি। কিন্তু আজীবন ভালবেসেছেন। তাই ‘শেষের কবিতা’র নায়ক অমিত না পাওয়া ভালবাসার গভীরতা উপলব্ধি করে বলেছেন, ‘যে ভালবাসা ব্যপ্তভাবে আকাশে মুক্ত থাকে, অন্তরের মধ্যে সে দেয় সঙ্গ; যে ভালবাসা বিশেষভাবে প্রতিদিনের সবকিছুতে যুক্ত হয়ে থাকে সংসারে সে দেয় আসঙ্গ।’ সে জন্য ভালবাসার মানুষকে কাছে না পেলেও দূর থেকে ভালবাসা উচিত, তার মঙ্গল কামনা করা উচিত। কারণ, ভালবাসা কারও ক্ষতি করে না, ভালবাসা সর্বদাই মঙ্গল করে। তাই বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘যদি আর কারে ভালবাস/ যদি আর ফিরে নাহি আস/ তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও/ আমি যত দুঃখ পাই গো। তুমি সুখ যদি নাহি পাও/যাও সুখের সন্ধানে যাও/ আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয় মাঝে/ আর কিছু নাহি চাই গো।’ আজ সেই ভালবাসার দিন। আজ নতুন করে একে অপরকে বলার দিন-আমি তোমায় ভালবাসি। ভালবাসা, ভাল থেকো। লেখক : ক্যাথলিক ধর্মযাজক [email protected]
×