ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

বসন্ত উদ্্যাপন ॥ উৎসবে ভেসেছে দেশ

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বসন্ত উদ্্যাপন ॥ উৎসবে ভেসেছে দেশ

হিন্দী-বাংলা সিরিয়াল, বহুজাতিক পণ্যের বিজ্ঞাপন, গ্লামার ওয়ার্ল্ডের গলি-ঘুপসির অহর্নিশ তত্ত্বতালাশ, বিশ্লেষণ ও বিস্তার যে সাংস্কৃতিক উপনিবেশ তৈরি করেছে তার দুর্ভেদ্য দেয়াল ভাঙ্গার শক্তিশালী অস্ত্র হতে পারে নিজেদের ঐতিহ্যময় উৎসবের ঘনঘন উদ্যাপন। পয়লা বৈশাখ বা বসন্ত উদ্যাপনের ব্যাপ্তি সেই ভরসার জায়গাটিকে অনেক বেশি স্পষ্ট করে। পয়লা বৈশাখের মতোই সর্বজনীন রূপ নিয়ে বসন্ত উৎসবও ছড়িয়ে পড়েছে শহরের কেন্দ্র থেকে প্রান্তে। হিজাব নেকাব বোরকার চাপে কোণঠাসা শাড়ি চুড়ি ফুলের গয়না মুক্তির শ্বাস নিয়েছে শহরময়। এক সময় বাঙালী মুসলমান মধ্যবিত্তের এক অংশ বিভ্রান্ত ছিলেন তারা বাঙালী না মসুলমান- এ প্রশ্নে। নিজেদের বাঙালী বলে পরিচয় দিতে দ্বিধাবোধ করেছেন। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন নিজের বাঙালী সংস্কৃতি থেকে। ভেবেছেন ধর্মের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্রের পত্তন তার নাগরিক হিসেবে নিজেদের বাঙালী বলে পরিচয় দেয়া অধর্মের কাজ শুধু নয়, তাতে রাষ্ট্রের ভিত্তি নড়বড়ে হবে। ভাবতে পারেননি চর্যাপদ, পদাবলী, মঙ্গল কাব্য বাঙালী তাদেরও সম্পদ। বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে বাদ দিলে বাঙালীর অস্তিত্বের তল খুঁজে পাওয়া যায় না। বাতিলের কাজটি তারা সযতেœ করতে চেয়েছিলেন। হয়ত সেজন্যই এক সময় প্রগতিশীল বলে পরিচিত কবি ফররুখ আহমদ পাকিস্তানের জন্য লড়ে আমূল বদলে গিয়েছিলেন। নিজের সমৃদ্ধ সাহিত্যিক ঐতিহ্য উপেক্ষা করে ভিন দেশী সাহিত্য সংস্কৃতিতে ভরসা করতে চেয়ে রচনা করেছিলেন ‘নৌফেল ও হাতেম।’ ছদ্ম নাম নিয়েছিলেন ‘হায়াত দরাজ খান পাকিস্তানী।’ কিন্তু ভুল পথে পা বাড়িয়ে বিস্মৃতির চোরাবালিতে তলিয়ে গেছেন পুরোপুরি। আর আরেক বাঙালী মুসলমান সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ দেশের সীমার বাইরে থেকেও আজীবন বুকে ধারণ করেছেন নিজের দেশ ও সংস্কৃতিকে। নিজের সৃষ্টিতে অমর হয়ে আছেন। বাঙালী মুসলমানের অগ্রসর অংশের প্রতিনিধি ছিলেন বলেই সমাজের মূল স্রোতের গতি-প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলেন তীক্ষè চোখে। যে রাষ্ট্রের ভিত নড়বড়ে হবে বলে বাঙালী মুসলমানের কূপম-ূক অংশ নিজেদের বাঙালী পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত ছিল, সে রাষ্ট্রের চারিত্র্য বৈশিষ্ট্য তিনি প্রায় শুরুতেই বুঝেছিলেন। ‘লাল সালু’র মজিদকে তিনি উপস্থাপন করেছেন অনেকটা ওই কূপম-ূক শিকড়হীনদের অবয়বে। শস্যহীন এক এলাকা থেকে সুজলা সুফলা অঞ্চলে এসেছিল মজিদ। যেখান থেকে সে এসেছে সেখানে ‘শস্যের চেয়ে টুপি বেশি।’ সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়েছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বাধীন দেশে ফেরার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। বেঁচে থাকলে হয়ত স্বাধীন বাংলা দেশের সামাজিক মনস্তত্ত্বে¡র একটি রূপরেখা তাঁর কালোত্তীর্ণ অন্য কোন রচনায় পাওয়া যেত। যেমন পেয়েছি লাল সালুতে। যে পটভূমি সাতচল্লিশ এনেছিল সেখান থেকে জাতীয়তাবাদী চেতনা দানা বাঁধতে বাঁধতে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের জন্ম অনিবার্য করেছিল, সে রাষ্ট্র মধ্য বয়সের কাছাকাছি পৌঁছলেও টুপি তো এখনও পিছু ছাড়েনি!! মজিদের সময় টুপি ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে সোনায় সোহাগার মতো হিজাবের বেপরোয়া সংক্রমণ ছিল না। মুসলমান সমাজে পর্দা কমবেশি সেকালে থাকলেও কখনও শুনতে হয়নি ‘শাড়ি হিন্দুয়ানী পোশাক।’ অতএব মুসলমান নারীর জন্য এ পোশাক না জায়েজ। ইংরেজী মাধ্যম স্কুল, যেখানে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আরবীও শেখানো হয়, নাগরিক মধ্যবিত্ত মা-বাবা পরম নির্ভরতায় সন্তানের নাম লেখান সে স্কুলে। তৃতীয় ভাষা যদি শিখতেই হয় তবে আরবী কেন? ফ্রেঞ্চ, জার্মান, স্প্যানিশ নয় কেন? তবে কি পুণ্যের লোভ? তা খানিক আছে তো নিশ্চয়ই, তবে মনে হয় সেটাই সব নয়, এক ধরনের ব্যালান্স করার অক্ষম চেষ্টাই মুখ্য। ইংরেজী মাধ্যম শিক্ষার নানা ধরনের অপপ্রচারে ভীত অভিভাবক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে বখে যাওয়ার স্রোতে বাঁধ দিতে আরবীর ছলে ধর্ম শিক্ষাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজেন। সন্তানটি মেয়ে হলে লেভেল থ্রিতে হিজাবে মুড়ে যাবে মাথা ও শরীর। আপাদমস্তক হিজাবে মোড়া শরীরের মনটি কি মুক্ত থাকে? সম্পন্ন শহুরে মধ্যবিত্তের একাংশের ঝোঁক এখন এদিকেই। আন্তর্জাতিক চেন অর্গানাইজেশনের অঙ্গ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাঙালীর আত্মপরিচয়ের শিকড় সন্ধান কোথায় করবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সাতচল্লিশের পরের সঙ্কটটির দেশীয় ভার্সনের নাম ছিল সাম্প্রদায়িকতা। এখনকার ভার্সন আগের মতো সরল রৈখিক নয়, অনেক বেশি সর্পিল। জটিলতার পরত এত বেশি যে, সঠিক শিক্ষা ও যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণী ক্ষমতা না থাকলে সমস্যার শিকড় চিহ্নিত করা কঠিন। মধ্যবিত্ত সব সময়ই দোদুল্যমান। কখন কোন্দিকে দুলবে অনেক সময় প্রেডিক্ট করা সম্ভব হয় না। এই দোদুল্যমানতাকে পুঁজি করে এ অঞ্চলে অনেক বড় বড় নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। মধ্যবিত্তের মধ্যে এখন সাম্প্রদায়িক বিভাজন না থাকলেও চেতনাগত নানা বিভ্রান্তিতে আচ্ছন্ন সে। এই বিভ্রান্তির বিচ্ছিন্ন সুতোগুলোয় ঐক্যের ঝঙ্কার তুলতে সাংস্কৃতিক সূক্ষ্মতাকে লালন করা জরুরী। যদিও অসুস্থ অর্থনীতির দৌরাত্ম্যে বাস করে সাংস্কৃতিক সুস্থতা আশা করা অবান্তর। পয়লা বৈশাখ বা পয়লা বসন্ত সব অবান্তর আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে নিজস্ব দর্পণে মুখ দেখার ভরসা জোগায় বলেই এ দুয়ের আবেদন এত বেশি। বৈশাখ কিংবা ফাল্গুনের উদ্যাপন সামন্ত সমাজে এভাবে হতো না, এখন যেভাবে হচ্ছে। এই শহুরে আয়োজনের পেছনে বাণিজ্যিক কারসাজি রয়েছে ঠিকই, তবে সেখানেও নিজস্ব বাণিজ্যের পরিসর অনেক বেড়েছে। বসন্ত উদযাপন, ভালবাসা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারিÑ পর পর এ তিন উৎসবে শুধু ফুল ব্যবসায়ীরাই টার্গেট করেন কোটি কোটি টাকা। পোশাক, এক্সেসরিজ, কসমেটিকস ব্যবসায়ীদের মুনাফার হিসাবও নিতান্ত কম নয়। লেনদেনের এ পুরো প্রক্রিয়ার অংশীদার দেশীয় ব্যবসায়ীরা। এটাও এ উৎসবের অন্যতম দিক। ঈদ, পুজায় ভারতীয় পণ্যের ভিড়ে কোণঠাসা হয়ে মার খান দেশী পোশাক উৎপাদন ও বিপণনকারীরা। ফাল্গুন ও বৈশাখে এ উৎপাত থেকে তারা মুক্ত। সব দিক থেকে স্বতন্ত্র এ উৎসবকে ভর করে বাঙালিয়ানা এগিয়ে যেতে পারে বহুদূর। অন্য সংস্কৃতির কতটুকু নেব, কতটুকু নেব না সে বোধ অর্জনের জন্যও নিজের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থাবান থাকা জরুরী। নিজের শিকড় শক্ত না হলে বিশ্বনাগরিক হওয়া দূরের কথা সাংস্কৃতিক উদ্বাস্তু হয়ে আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে পথ হাতড়ানোর দুর্ভাগ্য মেনে নিতে হয়। আমরা যেন সে পথে পা না বাড়াই।
×