ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আসমা জাহাঙ্গীর

প্রকাশিত: ০৪:০২, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

আসমা জাহাঙ্গীর

চলে গেলেও তবু থেকে যায় কর্ম-কীর্তি। থেকে যায় জীবনের সারাৎসার। চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়, বিচ্ছেদ নয়। চলে যাওয়া মানে আবার ফিরে ফিরে আসা। কবি জীবনানন্দ দাশ যেমন উচ্চারণ করেছিলেন, ‘মানুষের মৃত্যু হলেও তবু মানব থেকে যায়। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে যেতে হয় ইহলোক ছেড়ে পরলোকে। পেছনে রেখে যাওয়া কর্মেরা তবু বার বার স্মরণ করায়- তিনি ছিলেন, তিনি আছেন, তিনি থাকবেন। তিনি আসমা জাহাঙ্গীর, উপমহাদেশের প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী ও বাংলাদেশের সুহৃদ। চলে গেলেন এই ধরাধাম ছেড়ে অনন্তলোকে। গত রবিবার পাকিস্তানের লাহোরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি... রাজিউন)। ১৯৫২ সালে জন্মগ্রহণকারী আসমা পাকিস্তানের বিশিষ্ট মহিলা আইনজীবী, পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও পরবর্তীকালে মহাসচিব ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তানের মানব এবং মহিলা অধিকার, সংখ্যালঘু ও শিশুদের ধর্মীয় অধিকার নিয়ে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। হলুদ অধ্যাদেশ ও ব্লাসফেমি আইনের বিরুদ্ধে ছিলেন আমৃত্যু সোচ্চার। পাকিস্তানের সুপ্রীমকোর্ট বার এ্যাসোসিয়েশনের প্রথম মহিলা সভাপতি ছিলেন। ধর্মীয় স্বাধীনতা বা বিশ্বাস সম্পর্কীয় জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ছিলেন, জাতিসংঘের প্রতিনিধি হিসেবে শ্রীলঙ্কায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তদন্তও করেন। ৬৬ বছর বয়সী আসমা স্পষ্ট কথাবার্তা ও মানবাধিকার বিষয়ে আপোসহীন ভূমিকার জন্য ছিলেন সুবিদিত। ২০০৭ সালে পাকিস্তানে আইনজীবীদের ঐতিহাসিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় তাকে গৃহবন্দী করা হয়েছিল। তার পিতা মালিক গোলাম জিলানী ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। নিজের জীবনকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দিয়ে একাত্তরে নির্যাতিত বাঙালীর পক্ষে যেসব পাকিস্তানী দাঁড়িয়েছিলেন গোলাম জিলানী ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। একাত্তরের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর তার মুক্তির দাবিতে জেনারেল ইয়াহিয়াকে তিনি খোলা চিঠি লেখেন। এ জন্য তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ করায় ১৯৬৮-৬৯ সালেও তাকে গৃহবন্দী রাখা হয়। বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে তাকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ প্রদান করে। মেয়ে হিসেবে তা গ্রহণ করেছিলেন আসমা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। আজীবন রাজপথের সৈনিক ছিলেন আসমা, লড়াই করেছেন অন্যায়, অবিচার আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে। মানবাধিকার সংক্রান্ত মামলায় লড়তে গিয়ে পেয়েছেন হত্যার হুমকি। শিকার হয়েছেন মারধরের। বরণ করেছেন বন্দিত্ব। কিন্তু ছাড়েননি হাল, যাননি পিছিয়ে, সাহসে বুক বেঁধে দাঁড়াতেন প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে। পাকিস্তান নামক বর্বর দেশটিতে নারী হয়ে তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন। নারীর প্রতি সহিংসতা, সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যও শ্রমিকদের অবস্থা পাকিস্তানে এখনও অনেক খারাপ, একটা সময় মানবাধিকার বলে সে দেশে কিছুই ছিল না। নারী অধিকারকে মনে করা হতো পশ্চিমাদের বিষয় আশয় ও ধর্মবিরোধী। আসমার নিরন্তর শ্রমে এখন রাজনৈতিক দল, জনগণও এ বিষয়ে সোচ্চার। পাকিস্তানে নাগরিকদের অনেক অধিকার আদায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তার আইনী লড়াইয়ে শ্রমিকরা মুক্তি পান ক্রীতদাসের মতো ব্যবহৃত হওয়ার পরিস্থিতি থেকে। নারীদের নিজের পছন্দে বিয়ে করার অধিকারও এসেছে তারই কল্যাণে। বার বার গোলযোগের কবলে পড়া পাকিস্তানে গণতন্ত্র আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন। ১৯৮৩ ও ২০০৭ সালে সামরিক শাসনামলে তিনি গ্রেফতার হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা ও বর্বরতার জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ক্ষমা চাওয়ানোর দাবিতে ছিলেন সোচ্চার। ঢাকায় তিনি কয়েকবারই এসেছেন। বাংলাদেশেও তিনি পরিচিত মুখ। চূড়ান্ত নিপীড়ন ও নির্যাতনের মুখেও অটল এই আইনজীবী মানবাধিকার রক্ষায় বরাবরই ছিলেন সোচ্চার। পাকিস্তানকে আরও গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করার সংগ্রামে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। বাংলাদেশের এই সুহৃদের মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
×