ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাকে ভালবাসার স্বীকৃতি- নাগরিকত্ব পাচ্ছেন লুসি

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বাংলাকে ভালবাসার স্বীকৃতি- নাগরিকত্ব পাচ্ছেন লুসি

খোকন আহম্মেদ হীরা বরিশাল থেকে ॥ ‘স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কাছ থেকে দেখার খুব স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কাছে পেয়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখার স্বপ্ন আমার পূরণ হয়েছে’। সোমবার বিকেলে আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন, ব্রিটিশ নাগরিক লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া আশ্বাসের চার দিনের মধ্যেই সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় ব্রিটিশ নাগরিক লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্টকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ খবর পেয়েই লুসিকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও মিষ্টিমুখ করাতে নগরীর অক্সফোর্ড মিশনে ছুটে যান বরিশালের জেলা প্রশাসক মোঃ হাবিবুর রহমান। জেলা প্রশাসক জানান, লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্টকে বাংলাদেশ নাগরিকত্ব দেয়ার সিদ্ধান্তের কারণে খুব দ্রুতই এ সংক্রান্ত কাগজপত্র তিনি হাতে পাবেন। এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশালের ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু উদ্যানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে ১৫ বছরের জন্য ভিসা ফি মুক্ত পাসপোর্ট গ্রহণ করেছেন ব্রিটিশ নাগরিক লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্ট। এ সময় তাকে (লুসি) স্থায়ীভাবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া যায় কিনা সে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাসপোর্ট হস্তান্তরের সময় প্রধানমন্ত্রী ৮৭ বছর বয়সী মানবতাবাদী লুসি হেলেনের সঙ্গে কথা বলেন। লুসি হেলেন বরিশাল শহরে অক্সফোর্ড মিশনে বসবাস করছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময় লুসি হেলেন অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। সূত্রমতে, ৫৭ বছর আগে অক্সফোর্ড মিশনের একজন কর্মী হিসেবে ব্রিটিশ নাগরিক লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্ট বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের প্রতি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন জীবনের মায়া ত্যাগ করে। দেশ স্বাধীনের পরেও তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে যাননি। তিনি ভালবেসেছেন এখানকার মানুষকে। তাইতো মৃত্যুর পরেও যেন তাকে বরিশালের মাটিতে সমাধিস্থ করা হয়, সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন লুসি। প্রতিবছর ভিসা নবায়ন ফি দিতে সমস্যা হওয়ার ফলে ভিসা নবায়ন ফি মওকুফসহ বাংলাদেশী নাগরিকত্বের জন্য দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান লুসির এ আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে লুসি হল্টের ভিসা ফি মওকুফ করে ১৫ বছরের অগ্রিম ভিসা প্রদান করা হয়। জন্ম ১৬ ডিসেম্বর ॥ লুসির জন্ম ১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের সেন্ট হ্যালেন্সে। লুসির বাবা জন হল্ট ও মা ফ্রান্সিস হল্ট। ১৯৪৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা লুসির বড় বোন রুট এ্যান রেভা ফেলটন স্বামী ও তিন ছেলে নিয়ে ব্রিটেনেই বসবাস করেন। লুসি বলেন, ‘আমার জন্ম তারিখ নিয়ে বিষয়টি আমাকে খুব ভাবায়। বাংলাদেশের সঙ্গে আমি বাঁধা পড়েছিলাম বুঝি আমার জন্মের দিন থেকেই। ১৯৬০ সালে লুসি বাংলাদেশে আসেন। যোগদান করেন বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের পড়ানোর কাজ নেন। এরপর থেকে ঘুরেফিরে বাংলাদেশেই আছেন। যশোর, খুলনা, নওগাঁ, ঢাকা ও গোপালগঞ্জে কাজ করেছেন তিনি। অবসরে গিয়েছেন ২০০৪ সালে। ফিরে এসেছেন বরিশালে। মিশন প্রাঙ্গণের একটি ছোট্ট টিনের ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা। সেখানে আসবাবপত্র বলতে ছোট একটি কাঠের চৌকি আর কাঠের ছোট দুটি টেবিল। একটিতে কিছু বই ও পুরনো ডায়েরি। মুক্তিযুদ্ধের কাল ॥ ১৯৭১ সালে যশোর ক্যাথলিক চার্চ স্কুলে ইংরেজীর শিক্ষক ছিলেন লুসি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর লুসি ছাড়া অন্য সবাই স্কুল বন্ধ করে দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে খুলনায় চলে যায়। ভয়ঙ্কর ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তিনি (লুসি) পাশের ফাতেমা হাসপাতালে যান এবং যুদ্ধাহত বেসামরিক নাগরিকদের সেবা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। হাসপাতালের চিকিৎসকরা বিদেশী নারী লুসির এমন আগ্রহ দেখে অবাক হন এবং তাকে এ ব্যাপারে সম্মতি দেন। এরপর থেকে তিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিতে শুরু করেন। লুসি বলেন, আমি ডাক্তার না হওয়া সত্ত্বেও তখন অনেক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছি। লুসি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসম্ভব একজন ভক্ত ছিলেন। তাই যুদ্ধ শুরুর সময়ই ব্রিটেনে তার বন্ধু ও স্বজনদের চিঠি লিখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতেন। লুসি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করতাম। ১৯৭২ সালে আমি নিজ হাতে ডাইনিং টেবিলের ম্যাট বানিয়ে তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে উপহার পাঠিয়েছিলাম। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ রেহানা মায়ের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমাকে ফিরতি চিঠি দিয়েছিলেন। লুসি বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখতে পারায় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি।’ ইচ্ছা হয় ॥ লুসি লজ্জাবোধ করেন এজন্য যে তার পূর্বপুরুষরা এই সোনার দেশটিকে দখল করে রেখে মানুষকে কষ্ট দিয়েছেন। এ মানুষটার মনে শুধুই বাংলাদেশ। তার ইচ্ছা, এখানেই দেহ রাখবেন। এই বাংলাদেশে, এই বরিশালে। লুসি বলেন, এই দেশের সঙ্গে আমার আত্মার যোগ হয়ে গেছে। এখানেই শেষ শয্যা নিতে পারলে শান্তি পাব। মিশনের ভেতরের কবরস্থানের দিকে অঙ্গুলির নির্দেশ করে লুসি বলেন, এইখানে দেহ রাখতে চাই। আমি বাংলাকে ভালবাসি। ভালবাসি বরিশালকে।’
×