ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাহিরপুরের শিমুল বাগান- সৌন্দর্যে নেচে ওঠে প্রকৃতিপ্রেমী

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

তাহিরপুরের শিমুল বাগান- সৌন্দর্যে নেচে ওঠে প্রকৃতিপ্রেমী

এমরানুল হক চৌধুরী, সুনামগঞ্জ ॥ আজ পহেলা ফাল্গুন। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে, বর্ষ পরিক্রমায় আবার এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। কবির ভাষায় ... ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক আজ বসন্ত। তাই সুর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গাছে গাছে ফুটেছে হাজার হাজার রক্তলাল শিমুল ফুল। এ দৃশ্য এখন সারাদেশের। গাছে গাছে ফুটে আছে শুধু রক্তিম ফুল শিমুল। সুনামগঞ্জ জেলার বিখ্যাত মানিগাঁওয়ের শিমুলবাগের চিত্রও অনুরূপ। জেলার এই বিশাল বাগান পরিদর্শনে এলে যে কোন প্রকৃতিপ্রেমীর মন নেচে উঠবে শিমুলের রক্তরাঙ্গা সৌন্দর্য দেখে। প্রকৃতির এই রূপ উপভোগ করতে হলে যেতে হবে দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগান সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে। এই ফাল্গুনে শিমুল বনের রক্তরাঙ্গা সৌন্দর্য দেখতে হলে তাহিরপুরে যাওয়ার উপযুক্ত সময় এখনই। যেখানে একসঙ্গে তিন হাজার গাছ ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে। অদ্ভুত রকমের রক্তাভ এই সৌন্দর্য দেখলে যে কোন পর্যটকদের মনে, ফাগুনের আগুন ঝরানো হিল্লোল দোলা দেবেই। প্রকৃতিপ্রেমীদের চোখের তৃষ্ণা মেটাতে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে টাংগুয়ার হাওরের স্বচ্ছ জলরাশি, ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট লেক, মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে বয়ে চলা স্বচ্ছ নীলজল খ্যাত নীলাদ্রী বীর উত্তম সিরাজ লেক, স্বচ্ছজল বা ক্রিস্টাল ক্লিয়ার ওয়টার খ্যাতি পাওয়া রূপবতী যাদুকাটা নদী আর মেঘালয়ের ঠিক মধ্যখানে বারাম নদীর তীরে ধু-ধু বালুচরে একজন প্রকৃতিপ্রেমী জয়নাল আবেদীন রেখে গেছেন তার অনন্য কীর্তি দেশের সর্ববৃহৎ বিশাল শিমুল বাগান। ফাল্গুনের অরুণ আলোয় ফোটে উঠা শিমুল বাগানের এই টুকটুকে লাল ফুলগুলো দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন শত শত পর্যটক। দুর্গম হাওড়ের সবুজ বিপ্লবের এই নায়ক জেলার বিচ্ছিন্ন জনপদ বাদাঘাট ইউনিয়নের সোহালা গ্রামে পরিবারের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন মাত্র ১২ বছর থেকে। কিশোর বয়স থেকেই তিনি ছিলেন উদ্যামী বৃক্ষপ্রেমী। গাছপালার প্রতি ছিল তার অপরিসীম মমতা। গাছ লাগাতেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন। তার এই পছন্দের সঙ্গে একাত্ম হলো তাহিরপুরের সাধারণ মানুষের ভাবনা। তার লাগানো টাংগুয়া হাওড় জুড়ে বিশাল হিজলবাগ যেন কালের সাক্ষী হয়ে আছে। তার আগে বা পরে এত বড় হিজল বাগান আর কেউ করতে পারেনি। এমনি করে কালের সাক্ষী হতে প্রকৃতির বুকে একটু অলঙ্কার জুড়ে দিতে প্রয়াত জয়নাল আবেদীন দেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগানটি গড়ে তুলেন মেঘালয়ের পাদদেশ ও অপূর্ব যাদুকাটা নদী মধ্যস্থল বিস্তীর্ণ বালি বিশাল এলাকায়। গাছ লাগানো ও পরিচর্যার পুরনো নেশাই তাকে বাগান রচনায় প্রভাবিত করে। বাগানটির নাম শিমুলবাগ। তার এ ভাবনাটি যে একেবারেই আনকোরা সে কথা স্বীকার না করে উপায় নেই। জানা মতে, আমাদের দেশে বিস্তীর্ণ পরিসরে এত বড় শিমুল বাগান দেশের আর কোথায় নেই। উত্তর বড় দল ইউনিয়নের সুদৃশ্য বারাম নদীর তীর ঘেঁষেই মানিগাঁও গ্রাম। এ গ্রামে জয়নাল আবেদীনের নিজস্ব আড়াই হাজার শতক জায়গা একেবারেই অনাবাদী ছিল। পলির পরিবর্তে এখানে উজান থেকে ভেসে আসে বালি। এই ধু-ধু বালিয়াড়িতে কীভাবে সবুজের প্রলেপ এঁকে দেয়া যায় তারই এক অনন্য উদাহরণ এটি। ১৯৯৮ সালের কথা। একদিন শূন্য জায়গাটির পাশে দুটো পরিণত শিমুল গাছ দেখে তিনি এখানে শিমুল বাগান করার পরিকল্পনা হাতে নেন! শেষমেষ ২০০২ সালের দিকে শিমুল বাগান গড়ে তোলেন। এমন ভাবনা তাকেই ২৪০০ শতক জায়গায় রোপণ করে দিলেন ৩ হাজার শিমুলের চারা। সমান ১৪ ফুট করে দূরত্ব রেখে। বাগানের যেখানে দাঁড়ান না কেন দেখবেন আপনি বনের মধ্য ভাগে। ১৬ বছরে গাছগুলো বড়সড় হয়ে যেন যৌবনে পা রেখেছে। এ যেন কোন রূপবতী ষোড়শী। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, টাংগুয়ার হাওড়ের বিশাল স্বচ্ছ জলরাশি, ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ী ঝর্ণা আর ছোট ছোট লেক, উত্তরে ভারতের মেঘালয় এবং দক্ষিণে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার ওয়টার খ্যাত রূপবতী যাদুকাটা নদী। এই দুয়ের ঠিক মধ্যখানে দেশের সর্ব বৃহৎ শিমুল বাগান। ঠিক তার কাছেই আছে সুদৃশ্য বারেক টিলা। এই টিলায় বসেও এই ফাল্গুনে শিমুল বনের রক্তরাঙ্গা সৌন্দর্য ও যাদুকাটা নদীর রূপ উপভোগ করা যায় খুব সহজেই। এ যেন প্রকৃতির এক অপরূপ লীলা ভূমি। আবার টিলার ওপর আছে কুরচি ফুলের বন। একসঙ্গে এত কুরচি গাছ খুব একটা চোখে পড়ে না। অবশ্য কুরচি গাছগুলো এখানে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মেছে। নেই একটু বিশ্রামের জায়গা, যাতায়াতের নানা অসুবিধা। পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কমনাসহ নানান অসুবিধার কথা জানিয়েও মনোমুগ্ধকর এই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের কথা এই প্রতিবেদককে তুলে ধরলেন পর্যটকরা। স্থানীয় সাংবাদিক রাজন চন্দ্র বলেন, ফাগুনের অরুণ আলোয় ফোটে বাগানের শিমুল ফুলগুলো। চোখের তৃষ্ণা মেটাতে টাংঙ্গয়ার হাওড়, মেঘলয় পাহাড়ের পাদদেশে ও রূপের নদী যাদুকাটার মধ্যস্থলের বিশাল শিমুল বাগানে ফুটে ওঠা টুকটুকে লাল শিমুল ফুলগুলো দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন শত শত পর্যটক। এই টুকটুকে লাল ফাল্গুনের আগুন ঝরা দ্যোতি ছড়িয়ে যাক সারা বাংলায়। শিমুল বাগানের প্রতিষ্ঠাতা হাজী জয়নাল আবেদীনের পুত্র ও চেয়ারম্যান বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদ মোঃ আফতাব উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিমুল বাগানের প্রতিষ্ঠাতা আমার বাবা কথাটি ভাবতেই অন্যরকম ফিলিংস আসে মনে। এক সময় যে জায়গাটি ছিল ধু-ধু বালির প্রান্তর। আজ সেখানে লাল-সবুজের বিপ্লব ঘটিয়েছেন আমার প্রয়াত বাবা জয়নাল আবেদীন। প্রতিদিন এখানে একসঙ্গে তিন হাজার গাছের লাখ লাখ শিমুল ফুল ফোটা দেখতে শত শত পর্যটকের ভিড় থাকে। আমি পারিবারিকভাবে আগন্ত পর্যটকদের যেটুকু পারি সেবা দিয়ে থাকি। এ ব্যাপারে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিকল্পনা নেয়ার পক্ষে মত দিলেন তিনি। গোটা তাহিরপুরের টাংগুয়ার হাওড়, স্বচ্ছজলরাশির পাহাড়ী ঝর্ণা, ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট লেক, মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার ওয়াটার খ্যাতি পাওয়া রূপবতী যাদুকাটা নদী, বারেকের টিলা নানান প্রকৃতি সৌন্দর্য নিয়ে এখানে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলোকে পরিকল্পনা মাফিক কাজে লাগাতে পারলে আমাদের পর্যটন শিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে।
×