ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এ মাসেই হলি আর্টিজান জঙ্গী মামলার চার্জশীট-

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

এ মাসেই হলি আর্টিজান জঙ্গী মামলার চার্জশীট-

শংকর কুমার দে ॥ চলতি ফেব্রুয়ারি মাসেই চার্জশীট দেয়া হতে পারে বহুল আলোচিত গুলশানের হলি আর্টিজানে বেকারিতে সেই ভয়ঙ্কর জঙ্গী হামলার ঘটনার মামলার। চার্জশীট দাখিল করবে মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। এ মামলার চার্জশীটে হামলাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে ২২ জঙ্গীর নাম। এর মধ্যে ১৩ জঙ্গী বন্দুকযুদ্ধে নিহত। গ্রেফতারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন ৫ জঙ্গী। পলাতক আছে ৪ জঙ্গী। চার্জশীট থেকে বাদ পড়ছেন শিক্ষক আবুল হাসনাত রেজাউল করিম। অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে কানাডা প্রবাসী তাহমিদ হাসিব খান তাহমিদকে। তদন্ত শেষ পর্যায়ে। চলতি মাসেই এই মামলার চার্জশীট দেয়ার লক্ষ্যে দ্রুততার সঙ্গে কাজ চলছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। মামলার তদন্ত সংশ্লিস্ট সূত্র জানায়, দেশীয় জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবি এ হামলা পরিচালনা করে। হামলা পরিচালনা করেই তারা আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের আদলে ঘোষণা দেয়। এটিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ‘হোম গ্রোন’ জঙ্গী সংগঠন বলে আখ্যা দিয়েছেন। এদের সঙ্গে বিদেশী আন্তর্জাতিক কোন জঙ্গী সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা মিলেনি। তবে হামলাকারীরা ভার্চুয়াল জগতে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনগুলোকে অনুসরণ করত। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, এই মামলায় হাদিসুর রহমান সাগর নামে মূল পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে একজনসহ মামুনুর রশীদ রিপন, শরিফুল ইসলাম খালিদ ও পৃষ্ঠপোষক আকরাম হোসেন নিলয় পলাতক রয়েছেন। এদের পলাতক দেখিয়ে চার্জশীট প্রদান করা হতে পারে। সন্দেহভাজন নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক আবুল হাসনাত রেজাউল করিমকে এই মামলা আসামি করার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। কানাডা প্রবাসী তাহমিদ হাসিব খানকে জিজ্ঞাসাবাদে তার কোন সংশ্লিষ্টতা মেলেনি। তাকে এই মামলার আসামির তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। প্যারা কমান্ডোদের অভিযানে নিহত ৫ জঙ্গীর সঙ্গে নিহত হলি আর্টিজানের শেফ সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। মামলা তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি) সূত্রে জানা গেছে, দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জঙ্গী হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন বা চার্জশীট (অভিযোগপত্র) চূড়ান্ত করা হয়েছে। আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী ও সাক্ষীদের জবানবন্দী থেকে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার আদ্যোপান্ত জানতে পেরেছে সিটিটিসি। ওই হামলায় তামিম ও সরোয়ার জাহান মানিকসহ ২২ জঙ্গীর জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে সিটিটিসি ইউনিট। এই ২২ জনের মধ্যে ১৩ জন নিহত হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে। হামলার পর প্যারা কমান্ডোদের অপারেশন থান্ডারবোল্টে নিহত হয় রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামীহ মোবাশ্বীর, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল। ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে অভিযানে নিহত হন আবু রায়হান তারেক। ওই বছরের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় অভিযানে নিহত হয় তামিম আহমেদ চৌধুরী। পরে রাজধানীর রূপনগরে মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম, আজিমপুরে তানভীর কাদেরী, আশুলিয়ায় সরোয়ার জাহান মানিক, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে নূরুল ইসলাম মারজান নিহত হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে অভিযানে নিহত হয় বাশারুজ্জামান চকলেট ও ছোট মিজান। গ্রেফতারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন পাঁচ জঙ্গী। তারা হলেন- রাকিবুল হাসান রিগ্যান, পরিকল্পনাকারী রাজীব গান্ধী, অস্ত্র সরবরাহকারী মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, সংগঠক সোহেল মাহফুজ ও রাশেদুল ইসলাম র‌্যাশ। চার জঙ্গী পলাতক। তারা হলেন- নব্য জেএমবির অপারেশনাল কমান্ডার হাদিসুর রহমান সাগর, মামুনুর রশীদ রিপন, শরিফুল ইসলাম খালিদ ও পৃষ্ঠপোষক আকরাম হোসেন নিলয়। এদের মধ্যে পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত খালিদ ও রিপন ভারতে পালিয়ে আছে বলে তদন্তকারীদের ধারণা। এ মামলায় কানাডার টরেন্টো ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসিব খান, তার বান্ধবী ফাইরুজ মালিহা, তাহানা তাসমিয়া, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির বিবিএ ফ্যাকাল্টির সাবেক শিক্ষক আবুল হাসনাত রেজাউল করিমের স্ত্রী শারমিনা করিম, ভারতীয় নাগরিক সাত প্রকাশ, জাপানী নাগরিকের গাড়ি চালক আব্দুর রাজ্জাক রানা, হলি আর্টিজানের নিরাপত্তা কর্মী জসিম, হলি আর্টিজান বেকারির কর্মচারী শাহরিয়ার, সহকারী কুক আকাশ খান, ওয়েটার লাজারুস সরেন, সুমন রেজা, সবুজ, শিশির, সুহিন ও সমীর বাড়ৈ প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, হামলার জন্য পাঁচজন ইসাবা (হামলাকারী) বাছাইয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় সামরিক কমান্ডার শরিফুল ইসলাম ওরফে খালিদকে। ঢাকার সামরিক কমান্ডার আবু রায়হান ওরফে তারেক তিনজনের নাম দেন। তারা হলেন রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম ও সামেহ মোবাশ্বের। আর উত্তরবঙ্গের কমান্ডার জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী দেন শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ ও খাইরুল ইসলাম পায়েল ওরফে বাঁধনের নাম। রাজীব গান্ধী দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের শরিফুল ইসলাম ওরফে ডনের নামও দিয়েছিলেন, যাকে গুলশান হামলায় না পাঠিয়ে শোলাকিয়ার হামলায় পাঠানো হয়েছিল। আহত অবস্থায় গ্রেফতার হওয়ার পর বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। আসামিদের জবানবন্দী থেকে জানা গেছে, হামলার তিনদিন আগে নিবরাস ও রোহান ইমতিয়াজ দলের নেতাদের হলি আর্টিজানের বিষয়ে তথ্য দেয়। ২৭ জুন তারা মারজানকে নিয়ে প্রথম হলি আর্টিজান রেকি করে। পরদিন রেকি করেন বাশারুজ্জামান, উজ্জ্বল ও পায়েল। ওই রাতেই তামিমসহ নেতারা বারিধারায় তানভীর কাদেরীর বাসায় বসে চূড়ান্ত ছক কষে। তামিম নিজেও হলি আর্টিজান রেকি করে ২৯ জুন সন্ধ্যায় রোহান ইমতিয়াজকে হামলার নেতা নির্বাচিত করে। এর আগে গুলশানের কাছাকাছি বারিধারায় বাসা ভাড়া নেয় তানভীর কাদেরী। ২০১৬ সালের ১ জুন সপরিবারে ওই বাসায় ওঠে। ৭ জুন সেখানে ওঠেন বাশারুজ্জামান চকলেট। ৮ জুন পাঁচ হামলাকারীকে নিয়ে সেখানে যায় মারজান ও তার স্ত্রী। ১১ জুন যান তামিম চৌধুরী। পরে মারজান পাঁচটি ব্যাগে পিস্তল, একে-২২ রাইফেল, চাপাতি ও বোমা নিয়ে যায়। ১ জুলাই পর্যন্ত তারা ওই বাসায় ছিলেন। বড় একটি কক্ষে পাঁচজনকে নিয়ে তামিম থাকত। ৩০ জুন সকালে তানভীর কাদেরীর বাসায় গিয়ে পরদিন হলি আর্টিজানে হামলার চূড়ান্ত ঘোষণা এবং কিছু নির্দেশনা দেয় সরোয়ার জাহান। তদন্তকারী সূত্রে জানা যায়, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করা হয়েছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও যশোর সীমান্ত থেকে। মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান ও রাশেদ ওরফে র‌্যাশ জবানবন্দীতে অস্ত্র সরবরাহের কথা স্বীকার করে। রাশেদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে মে মাসে চারটি পিস্তল আনে। সাগর ও ছোট মিজান পাঁচটি একে-২২ রাইফেল আনে একই সীমান্ত দিয়ে। মে মাসে যশোরের চৌগাছা সীমান্ত দিয়ে বোমাগুলো তৈরি অবস্থায় আনেন সাগর। হামলার দিন ১ জুলাই সকালে বাশারুজ্জামান প্রত্যেকের ব্যাগে একটি করে একে-২২, একটি পিস্তল, একটি চাপাতিসহ পর্যাপ্ত পরিমাণ গুলি ঢুকিয়ে দেয়। চারটি গ্রেনেড দেয় দু’জনের ব্যাগে। আসরের নামাজের পরই দুই ভাগে ভাগ হয়ে পাঁচ হামলাকারী কিছু পথ রিক্সায় এবং কিছু পথ হেঁটে ঘটনাস্থলে পৌঁছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, সাক্ষীদের জবানবন্দী ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাঁচ হামলাকারী মিলিত হয়ে হলি আর্টিজানের ফটক পেরিয়ে গুলি ছুড়তে শুরু করে। এরপর বিদেশীদের এক স্থানে জড়ো করে একে একে ২০ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। অপর একটি সূত্রে জানা যায়, তামিম ও মারজান শেওড়াপাড়ার বাসায় ইন্টারনেটে এ্যাপসের মাধ্যমে হামলার খবরের অপেক্ষায় থাকে। হামলাকারীরা হত্যাযজ্ঞ শেষ করে জিম্মীদের ফোন ও ট্যাব থেকে তামিমকে এ্যাপসে মেসেজ পাঠান। তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট উপরোক্ত এসব তথ্যের কথা উল্লেখ করে চার্জশীটটি দাখিল করবে আদালতে।
×