ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এবার মোবাইলসহ কাউকে কেন্দ্রের ২শ’ মিটারের মধ্যে পেলে গ্রেফতার

আদেশের সংখ্যা অর্ধ ডজন হলেও প্রশ্ন ফাঁস একই গতিতে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

আদেশের সংখ্যা অর্ধ ডজন হলেও প্রশ্ন ফাঁস একই গতিতে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পরীক্ষা আয়োজনে অর্ধ-ডজন ‘কঠোর আদেশ’ জারি করেও প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগমুক্ত করা যায়নি চলমান এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এরই মধ্যে সোমবার নতুন এক নিষেধাজ্ঞা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, পরীক্ষা কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে মোবাইল ফোন নেয়া যাবে না। ২০০ মিটারের মধ্যে মোবাইল ফোনসহ কাউকে পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশও দেয়া হয়েছে। এদিকে প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে পরীক্ষা শুরুর সময় ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে রাখার নির্দেশনা থেকে সমালোচনার মুখে সরে এসেছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এক আদেশে বলেছে, পরীক্ষা কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে মোবাইল ফোন নেয়া যাবে না। ২০০ মিটারের মধ্যে মোবাইল ফোনসহ কাউকে পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে কোনো পরীক্ষার্থী কেন্দ্রে প্রবেশ না করলে তাকে আর কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়ার নির্দেশ মনে করিয়েও দেয়া হয়েছে আদেশে। ‘জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ সংক্রান্ত’ এক আদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক (মাউশি), সব বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের এই নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়, পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে সব পরীক্ষার্থীকে হলে প্রবেশ করে আসনে বসার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কিছু কিছু কেন্দ্রে ওই সময়ের পরেও পরীক্ষার্থীরা প্রবেশ করছে। এছাড়া বিভিন্ন কেন্দ্রের আশপাশে অনেকেই স্মার্টফোন নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে এবং ‘প্রশ্ন ফাঁসের গুজবমুক্ত সুষ্ঠু পরিবেশ’ নিশ্চিত করতে জরুরী ভিত্তিতে দুটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, পরীক্ষা কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে কিংবা পরীক্ষা কেন্দ্রের অভ্যন্তরে মোবাইল ফোনসহ কাউকে পাওয়া গেলে তাকে গ্রেফতার করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এদিকে বিটিআরসি থেকে সোমবার সকালে সব ইন্টারনেট গেটওয়েকে নতুন এক নির্দেশনা পাঠিয়ে বলা হয়েছে, আইএসপি ও মোবাইল অপারেটরদের ইন্টারনেটের গতি কমানোর বিষয়ে আগের নির্দেশনা স্থগিত থাকবে। অবশ্য নতুন এই নির্দেশনা কার্যকরের আগেই সকাল ৮টা থেকে আধা ঘণ্টার মত ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়েছে গ্রাহকদের। এর আগে রবিবার রাত ১০টা থেকে আধা ঘণ্টা পরীক্ষামূলকভাবে দেশের সব ইন্টারনেট প্রোভাইডারের ব্যান্ডউইথ সেকেন্ড ২৫ কিলোবাইটের মধ্যে সীমিত রাখা হয়। ওই গতিতে কোনো ধরনের যোগাযোগ সম্ভব না হওয়ায় ওই আধা ঘণ্টা ইন্টারনেট কার্যত বন্ধই থাকে। একই সঙ্গে এসএসসির আগামী সবগুলো পরীক্ষার শুরুতে আড়াই ঘণ্টা ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে রাখতে বলা হয় বিটিআরসির নির্দেশনায়। কোন তারিখে কখন থেকে কখন ইন্টারনেটে গতি কম থাকবে, তার একটি তালিকাও দেয়া হয়েছিল। জানা গেছে, ইন্টারনেটের গতি নিয়ন্ত্রণের পথে হাঁটায় বিমান চলাচল, আউটসোর্সিং, কল সেন্টার, সংবাদমাধ্যমের কাজসহ সব ধরনের যোগাযোগে বড় ধরনের জটিলতার শঙ্কা তৈরি হয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও সরকারের এ সিদ্ধান্তের তুমুল সমালোচনা শুরু হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রশ্নফাঁস একটি জাতীয় বিপর্যয়। এটিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েই মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ রাখা কোনও সমাধান হতে পারে না। মূলত সমস্যা ও সমালোচনার প্রেক্ষাপটেই নতুন আদেশ দেয়া হয়েছে বলে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে পরীক্ষা শুরুর আগে ও পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশ পর্যালোচনা করে দেখা যায় অর্ধডজন নিষেধাজ্ঞা এরই মধ্যে দেয়া হয়েছে। তবে তার সুফল এখনও পাওয়া যায়নি বলেই অভিযোগ। পরীক্ষা শুরুর আগেই আদেশ দেয়া হয়েছিল, পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন সঙ্গে রাখতে পারবেন না শিক্ষকরা। শিক্ষামন্ত্রী নুুুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছিলেন, সকল শিক্ষার্থী পরীক্ষার হলে ঢোকার পর প্রশ্নপত্র খোলা হবে। পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বা কোন ব্যক্তি কোন মোবাইল ফোন সঙ্গে রাখতে পারবেন না। শুধু পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিব যোগাযোগের জন্য একটি সাধারণ ফোন সঙ্গে রাখতে পারবেন। পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে মোবাইল কোর্ট চালু থাকবে। পরীক্ষায় কোন অনিয়ম বা প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটলে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া পরীক্ষা সংক্রান্ত একটি কন্ট্রোল রুম চালু থাকবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অপর এক আদেশে প্রথমবারের মতো পরীক্ষার ছয় দিন আগে থেকেই সময় সারাদেশের কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখা হয়। শিক্ষামন্ত্রী আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠক করে বলেছিলেন, দেশের সব কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে। এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা চলাকালীন পর্যন্ত এ ধরনের প্রতিষ্ঠান খোলা থাকতে পারবে না। কোচিং সেন্টার হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের আখড়া। এ কারণে পরীক্ষার সাত দিন আগে থেকে এই কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেশের সব কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে। প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে আমরা মরিয়া ও কঠোর। কারণ আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমরা সবদিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি। আগে বিজি প্রেস থেকে প্রশ্নফাঁস হতো, সেটা বন্ধ করেছি। কিন্তু এখন শিক্ষকরাই প্রশ্নফাঁস করছেন। তবে সব শিক্ষক নন, কিছু শিক্ষক এসবের সঙ্গে জড়িত। পরীক্ষার চারদিন আগে এক আদেশে বলা হয়, পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে কেউ কেন্দ্রে প্রবেশ না করলে তাকে আর পরীক্ষা কক্ষে ঢুকতে দেয়া হবে না। পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে অবশ্যই পরীক্ষার হলে প্রবেশ করতে হবে। অন্যথায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এর পরেও প্রথম দিন থেকে প্রশ্ন ফাঁসের খবর আসতে থাকায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় অপরাধীদের ধরতে ঘোষণা করে পুরস্কার। ৪ ফেব্রুয়ারি বৈঠক করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দিলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। শিক্ষামন্ত্রী ও সচিব বলেন, আমরা এই যে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার যারা হোতা, যারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সে ধরনের যারা অপরাধী তাদেরকে ধরিয়ে দিতে পারলে, চিহ্নিত করে দিতে পারলে, সঠিক প্রমাণিত হলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। এখানেই শেষ নয়, সর্বশেষ রবিবার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ সংক্রান্তÍ তথ্য যাচাই-বাছাই কমিটির প্রধান ও কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মোঃ আলমগীর এক বৈঠক শেষে বলেছেন, এ পর্যন্ত ৩০০ টেলিফোন নম্বর চিহ্নিত করে ব্লক করে দেয়া হয়েছে। এই নম্বরধারীদের অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের জানিয়ে তিনি বলেন, এরা মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ে, কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ে। এদের অভিভাবকরাও আছে। তবে এত কিছুর পরেও প্রশ্ন একটাই। আর তা হলো, কেন ফল পাওয়া যাচ্ছে না? এভাবেই কি চলতে থাকবে?
×