ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জনকণ্ঠের সঙ্গে সাক্ষাতকারে কোস্টগার্ডপ্রধান রিয়ার এ্যাডমিরাল আওরঙ্গজেব চৌধুরী

মা ইলিশ রক্ষা করে প্রতিটি মানুষের জন্য ইলিশ খাওয়া নিশ্চিত করেছি

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

মা ইলিশ রক্ষা করে প্রতিটি মানুষের জন্য ইলিশ খাওয়া নিশ্চিত করেছি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ কোস্টগার্ড বাহিনীতে নিজস্ব জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। ইতোমধ্যেই বাহিনীর তরফ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। বাহিনীকে আরও শক্তিশালী ও বিশেষায়িত বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার কাজ চলছে। প্রযুক্তিগতভাবে বাহিনীটিকে আধুনিক করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে দেশের বৃহৎ স্বার্থে কোস্টগার্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশ কিছু আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারের সবোর্চ্চ পর্যায়ও এসব বিষয়ে ইতিবাচক বলে জানা গেছে। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি কোস্টগার্ডের ২৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে একান্ত আলাপকালে বাহিনীটির মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল আওরঙ্গজেব চৌধুরী জনকণ্ঠকে এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, কোস্টগার্ড দেশের পুরো সমুদ্র এলাকা ও অভ্যন্তরীণ জলসীমার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে। এ জন্য কোস্টগার্ডকে বলা হয় ‘গার্ডিয়ান এ্যাট সি’ অর্থাৎ সুমূদ্রের অভিভাবক। জলজ সম্পদ, চোরাচালান দমন, মানবপাচার রোধ, উপকূলের নিরাপত্তা নিশ্চিত, পরিবেশ দূষণ রোধ, জীববৈচিত্র রক্ষা, জলদস্যু ও বনদস্যুতা এবং মাদকদ্রব্য প্রতিরোধই বাহিনীর প্রধান কাজ। সমূদ্র ছাড়াও দেশের সব নৌপথ, সুন্দরবনের ভেতরের সব নদ-নদী, খাল-বিল ও বঙ্গোপসাগরে পতিত সব নদ-নদীর মোহনা থেকে উজানে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালন করে বাহিনীটি। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সমূদ্র এলাকা পাওয়া যায়। জলসীমানায় নতুন অংশ যুক্ত হওয়ায় বাহিনীটির দায়িত্বও বেড়েছে বহুগুণ। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগেই গত ৮ বছরে বাহিনীতে যুক্ত হয়েছে ছোট বড় জাহাজ, বোট, প্রশিক্ষণ ঘাঁটি সিজি বেইজ অগ্রযাত্রাসহ অনেক কিছুই। এছাড়া বাহিনীটির অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে অনেক। সেইসঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে প্রযুক্তি। আগে গভীর সমূদ্রগামী জাহাজের অভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেত না। হালে আর সেই অবস্থা নেই। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে কয়েকটি অত্যাধুনিক অফশোর পেট্রোল ভেসেল যুক্ত হয়েছে। আরও যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। যা বাহিনীটিকে অনেক শক্তিশালী করেছে। আরও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের প্রক্রিয়া চলছে। এসব যন্ত্রপাতি আমদানি করা হলে গভীর সূমুদ্রের তেল-গ্যাস রক্ষা ও এসব সম্পদের খোঁজার কাজ করা যাবে। এতে করে দেশের অনেক অর্থ সাশ্রয় হবে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও আহরণের জন্য বিদেশ থেকে জাহাজ ও যন্ত্রপাতি আনতে হয়। এ খাতে দেশের অনেক অর্থ ব্যয় হয়। নিজেরাই তা করতে পারলে অর্থ বাঁচবে। সেইসঙ্গে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। দেশ দুই দিক থেকে লাভবান হবে। কোস্টগার্ড দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরণের অবদান রাখছে জানিয়ে তিনি বলেন, অন্যান্য সম্পদ বাদ দিয়ে শুধু মৎস সম্পদের ক্ষেত্রেই বাহিনীটি দেশকে সরাসরি অর্থনীতিতে ব্যাপক লাভবান করে দিচ্ছে। যদি ইলিশ মাছের কথাই বলা হয়, তাহলে এ বাহিনীর সাফল্য চোখে পড়ার মত। বিগত ২০১৬-১৭ বছরে ইলিশের উৎপাদন ২৬ শতাংশ বেড়ে প্রায় পাঁচ লাখ টনে পৌঁছে। ইলিশের মাধ্যমে দেশের ২৫ লাখ লোকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। জিডিপিতে এর অবদান এক শতাংশ। আজ দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষ ইলিশ মাছ খেতে পারছেন। এর পেছনে মূখ্য ভূমিকা পালন করছে বাহিনীটি। কারণ সারাবছর ধরে বাহিনীটি মা ইলিশ মাছ রক্ষা ও জাটকা নিধনে অভিযান চালায়। এ জন্য নিজেরা খেয়েও বিদেশে রফতানি করা যাচ্ছে রূপালি ইলিশ। যা থেকে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মূদ্রা আসছে। এছাড়া সমূদ্রবন্দর রক্ষায় বাহিনীটি বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। ২০১১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সমূদ্র বন্দর অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিশ্বের কাছে তালিকাভূক্ত ছিল। ঝুঁকিপূর্ণ বন্দরে মালামাল খালাস থেকে শুরু করে সবকিছু করতে গেলেই তার ঝুঁকিভাতাও বেশি। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারায় সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। হালে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর আন্তর্জাতিকমানের স্বাভাবিক সমূদ্রবন্দর হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এ থেকে দেশ অনেক সুবিধা পাচ্ছে। যা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে। বাহিনী প্রধান বলছিলেন, জল সীমানার দূষণ রোধে বাহিনীটি সর্বদা সর্তক রয়েছে। কোন গোষ্ঠী যাতে জলসীমানায় অবৈধ অনুপ্রবেশ করতে না পারে এবং জলে যাতে দূষণ ঘটাতে না পারে এ জন্য টহল জোরদার করা হয়েছে। মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন এলাকার জল বা অন্যান্য সম্পদ দূষিত হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করা হচ্ছে। অনেক সময় মানুষও অজান্তেই জল ও জল সীমানায় দূষণ ঘটিয়ে থাকে। তাদের সচেতন করার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। জলসীমানায় যাতায়াতসহ অন্যান্য কর্মকা- চালানোর ক্ষেত্রে বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করতে নির্দেশ জারি করা হয়েছে। বাহিনীটিতে দূষণ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ তৈরির কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। সরকার মাদক নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রী ইয়াবার আগ্রাসন বন্ধে মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলেছেন। বাহিনীটি মাদক বিরোধী অভিযান চালিয়ে আসছে। তারপরেও দেশের ভেতরে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে ইয়াবা রোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের তরফ থেকে কোন প্রকার সহযোগীতা পাওয়া যাচ্ছে না। ইয়াবা পাচার হয় মাছ ধরার ট্রলারের মাধ্যমে। তালিকাভুক্ত প্রায় লক্ষাধিক ট্রলারের ওপর নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মাদক ব্যতিত জব্দকৃত অন্যান্য মালামাল ধ্বংস না করে আইন পরিবর্তন করে অন্য কাজে লাগানো যায় কিনা সে বিষয়ে মহাপরিচালন বলেন, গত বছরের অভিযানে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা মূল্যের কারেন্ট জাল জব্দ হয়েছে। আইন অনুযায়ী সেগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। জব্দকৃত হরিণের মাংস, শিং ও চামড়া পুঁতে ফেলতে হয়েছে। এর ফলে পরিবেশ দূষিত হয়। আইন পরিবর্তন করে জাল গলিয়ে প্লাস্টিক বানিয়ে তা দিয়ে অন্যান্য সামগ্রী তৈরি করা যেতে পারে। যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর জাটকার মত হরিণের মাংস গরীব দুঃখীদের মাঝে বিতরণ করা যেতে পারে। আর হরিণের চামড়া পুঁতে না ফেলে তা দিয়ে তৈজস সামগ্রী তৈরি করে বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করা যেতে পারে। এ সংক্রান্ত আইন পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলছে। সরকারের সবোর্চ্চ পর্যায় থেকে এ সংক্রান্ত আইন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো হয়েছে। বাহিনীটিতে নিজস্ব জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাহিনীটিতে নিজস্ব জনবল নিয়োগ দেয়ার জন্য সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা সংবলিত চিঠি দেয়া হয়েছে। কারণ নিজস্ব জনবল নিয়োগ না করলে বাহিনীটি বিশেষায়িত বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা কঠিন হবে। বাহিনীটির অধিকাংশ সদস্যই নৌ-বাহিনী থেকে প্রেষণে নিযুক্ত। ফলে বাহিনীতে যোগ দেয়ার পর একজন সদস্য চাইলেও বাহিনীটিতে নিজেকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে তৈরি করতে পারছেন না। নানা প্রশিক্ষণ শেষে ওই সদস্য যখন বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠছেন, দেখা গেল সে সময় তাকে মূল বাহিনীতে ফেরত যেতে হলো। এতে করে তার দক্ষতা বাহিনীটির জন্য কোন কাজে আসতে পারলো না। আবার নিজ বাহিনীতে যে প্রশিক্ষণ নিয়ে ওই সদস্য ফেরত গেলেন, সেই প্রশিক্ষণও মাতৃ বাহিনীতে কোন কাজে এল না। বিশেষায়িত বাহিনী না হওয়ায় এর জনবল তৈরি করতে অনেক সময় লেগে যায়। এ বাহিনীর জন্য একজন নাবিক ভর্তি করার পর বিভিন্ন পেশাগত প্রশিক্ষণ শেষ করে তার কাছ থেকে সার্ভিস পেতে কমপক্ষে তিন বছর আর কর্মকর্তার ক্ষেত্রে ছয় বছর সময় লাগে। বাহিনীটির গোয়েন্দা সংস্থার আকার বাড়ানোর কাজ চলছে। বর্তমানে থাকা গোয়েন্দা পরিদফতরের আকার প্রয়োজনের তুলনায় অনেক ছোট। জনবলের অভাব পূরণ করে বাহিনীটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশেষায়িত বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছে। কারণ জনবল না থাকার কারণে বাহিনীটির অপারেশনালসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সদস্য ও কর্মকর্তাদের অনেক সময়ই ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। যা একজন মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করলে, ওই সদস্যের কাছ থেকে আশাতীত সাফল্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বাহিনীতে দূষণ সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে একটি পরিপূর্ণ বিশেষায়িত বাহিনী হিসেবে বিশ্বের কাছে আত্মপ্রকাশ করবে কোস্টগার্ড। থাকবে অত্যাধুনিক যব যন্ত্রপাতি। বাহিনীর কার্যক্রম হবে পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব ও আন্তর্জাতিকমানের। বাহিনীটিতে নারী-পুরুষ সমান অধিকার পাবে।
×