ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দরিদ্রের আয় বাড়ানো কর্মসূচী থাকছে আগামী বাজেটে

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

দরিদ্রের আয় বাড়ানো কর্মসূচী থাকছে আগামী বাজেটে

এম শাহজাহান ॥ বৈষম্য কমাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় বাড়ানোর মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী নেয়া হবে আগামী বাজেটে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন ও যুব সম্প্রদায়ের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি করা। গত নয় বছরে বিএনপি’র তুলনায় ছয়গুণের অধিক বাজেট দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বে নতুন রোল মডেল সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। বাজেটের ৫৪ শতাংশ এখন দারিদ্র্য সংবেদনশীল খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগের ৮০ শতাংশ বেসরকারী ও ২০ শতাংশ সরকারী খাতে হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে অতিদারিদ্র্যের হার ৩ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। তবে প্রবৃদ্ধির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে অতিদারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত নামিয়ে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে গড়ে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে বাংলাদেশকে। যদিও দারিদ্র্য নিরসনে বদ্ধপরিকর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সম্প্রতি দারিদ্র্য বিমোচন সংক্রান্ত এক আলোচনা শেষে তিনি জানান, দারিদ্র্য নিরসনে আমরা অনেক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি এবং এটাকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছি। আগামী ২০৩০ সালে দেশে কোন দারিদ্র্য মানুষ থাকবে না। এছাড়া আগামী ২০২৪ সালে বাংলাদেশে আর কোন হতদরিদ্র মানুষ থাকবে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি। এদিকে, তৎকালীন বিএনপি সরকারের শেষ সময় অর্থাৎ ২০০৫-০৬ সালে দেশের মানুষের মাথাপিছু মাসিক গড় আয় ছিল ৫৪৩ ডলার। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিভিন্ন পদক্ষেপে আয় বৈষম্য কমে আসার পাশাপাশি মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এরপরও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বাড়লেও দেশে ধনী-গরিবের বৈষম্য বেড়েছে। ফলে প্রবৃদ্ধির সুফল সমানভাবে সবাই পাচ্ছে না। সুবিধা তুলনামূলক বেশি পাচ্ছে সমাজের সচ্ছল শ্রেণী। গরিব শ্রেণীর কাছে দেশজ প্রবৃদ্ধির সুফল কম পৌঁছাচ্ছে। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য সিনিয়র সচিব ড. শামসুল আলম বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও এখনও মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। আর এজন্য প্রয়োজন সঠিক নীতিনির্ধারণ ও জোরালো বাস্তবায়ন। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠনে মহাজোট সরকারের উন্নয়ন দর্শন ‘রূপকল্প ২০২১’ অনুযায়ী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচী, প্রকল্প ও নীতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করছে। এ পরিকল্পনাগুলোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে- উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও আয় বৈষম্য দূরীকরণ এবং অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো, ডিজিটাল বাংলাদেশ ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা। এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও প্রতীয়মান হয়, তার ন্যায্য বণ্টন হচ্ছে না। দেশের মোট আয়ে ধনিক শ্রেণীর অংশটি অনেক স্ফীত হয়েছে। অন্যদিকে গরিবের ছোট অংশটি আরও ছোট হয়েছে। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, ২০১০ সালে জনগোষ্ঠীর নিম্নতম ৫ শতাংশের জাতীয় আয়ে অংশ ছিল দশমিক ৭৮ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে নেমে এসেছে দশমিক ২৩ শতাংশে। জনগোষ্ঠীর নিচের দিকের ৫ শতাংশের আয় ক্রমাগত কমছে। স্ফীত হচ্ছে মধ্যবিত্ত, আরও স্ফীত হচ্ছে উচ্চবিত্ত। আয় বৈষম্য বাড়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুবিধা কম পাচ্ছে দারিদ্র্য মানুষ। বৈষম্য কমাতে দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর আয় বাড়াতে হবে। এজন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষার পরিধি আরও বিস্তৃত করা প্রয়োজন। জানা গেছে, ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে হ্রাস পেয়ে তা ২২ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র্য হ্রাসে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অর্জিত গতিশীলতা ও হতদরিদ্রদের জন্য টেকসই নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা, অতিদারিদ্র্য ও দুস্থদের জন্য বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ, কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও টেস্ট রিলিফ, জিআর ছাড়াও সরকার উদ্ভাবিত একটি বাড়ি একটি খামার, আশ্রয়ণ, গৃহায়ন, আদর্শ গ্রাম, গুচ্ছ গ্রাম, ঘরে ফেরা প্রভৃতি কর্মসূচীর পাশাপাশি ওএমএস, ফেয়ার প্রাইস কার্ড, ভিজিডি, প্রতিবন্ধীদের জন্য ভাতা, বিধবা, স্বামী নিগৃহীতা ও দুস্থ মহিলা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা, চর জীবিকায়ন প্রভৃতি কর্মসূচী বাস্তবায়ন হচ্ছে। এছাড়া দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্রঋণ, ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত গোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচী বাস্তবায়ন হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, সবক্ষেত্রে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় দেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে এবং উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতায় ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে একটি নিরক্ষরতামুক্ত ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করবে। এ কারণে বেকারত্ব দূরীকরণে উৎপাদনমুখী কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকার বাজেটে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। দেশের অদক্ষ জনগোষ্ঠীকে আধা দক্ষ ও দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের নানামুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ইতোমধ্যে নেয়া সরকারী কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় জোরদার, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ও পূর্তকাজকে গতিশীল করার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প খাত উৎসাহিত, প্রশিক্ষিত যুবক, যুবমহিলাদের সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, দুই বছরের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এরই মধ্যে প্রচলিত ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচীকে পর্যায়ক্রমে সব জেলায় সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে জনশক্তি রফতানি এবং কৃষি ও সেবা খাতে কর্মসংস্থানের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা আরও সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে দেখা যায় দেশে এখন দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। সংখ্যায় হিসাব করলে তিন কোটি ৮৮ লাখ মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। কর্মসংস্থান বাড়াতে আগামী বাজেটে আত্মকর্মসংস্থানের দিকে গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে সরকারীভাবে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান ও ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচীর মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণে জোর দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বহিঃবিশ্বে শ্রম বাজার সম্প্রসারণের জন্য কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
×