ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিলুপ্তির পথে সম্ভাবনাময় পাম অয়েল শিল্প

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বিলুপ্তির পথে সম্ভাবনাময় পাম অয়েল শিল্প

শংকর পাল চৌধুরী, মাধবপুর, হবিগঞ্জ ॥ সিলেট বন বিভাগের মাধ্যমে মাধবপুরের সাতছড়ি তেলমাছড়াতে প্রতিষ্ঠিত পাম অয়েল শিল্পটি বিলুপ্তির পথে। বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, মাধবপুর উপজেলার রঘুনন্দন পার্বত্য এলাকায় সাতছড়ি, তেলমাছড়াতে ১৯৮২-৮৪ সালে বন বিভাগের মাধ্যমে মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করে ২০০ একর জমিতে পাম গাছের চারা রোপণ করা হয়। প্রায় চার হাজার গাছের চারা রোপণ করা হয়। বর্তমানে জীবিত গাছের সংখ্যা ৩৭০০ । এর মধ্যে প্রায় ৩০০০ গাছে ফল আসে। প্রায় আট মাস ফল আসে। প্রতিগাছে ফল আসে ১৫-২০ থোকা। প্রতি থোকাতে ফল আসে আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ কেজি। গাছগুলো থেকে যে ফল পরে তা থেকে নতুন চারা সৃষ্টি হয়। ফলে দিন দিন নতুন গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাম অয়েল গাছগুলো দেখতে খেজুর গাছের মতো। কোন পাতা ঝরে না। দেখতে অনেক সুন্দর। অথচ সাড়ে ৭ লাখ টাকা খরচের পাম অয়েল প্রকল্প অবহেলায় অযতেœ পড়ে রয়েছে। পাম অয়েল গাছের ডালপালাগুলো জ্বালানো হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সঠিক পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্তমানে ফলগুলো পশু-পাখি বানরের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেন দেখার কেউ নেই। পাম অয়েল নামক গাছটি ভোজ্যতেলের একটি বিশুদ্ধ ও সমৃদ্ধ উৎস। এ মহাদেশে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সর্বপ্রথম পাম গাছ লাগানো হয়। ১৯১৭ সালে মালয়েশিয়ায় স্যালাঙ্গর বার্জুন্টাই- এর বাতাং এর তেন্নামারান রোপণ করেন। এভাবে মালয়েশিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে পাম অয়েল শিল্পের ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপিত হয়। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভোজ্যতেল এখন পাম ওয়েল। বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া পাম চাষের অত্যন্ত উপযোগী। চাষাবাদ ও সঠিক পরিচর্যা, বিক্রয়, বিপনন, পরিবহনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান হতে পারে কয়েক লাখ লোকের। বর্তমানে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বেকারত্ব দূরীকরণে ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নতকরণে পাম চাষ হতে পারে একটি অপার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। বাংলাদেশে একটি কাদি ২৫ থেকে ৩০ কেজি ওজন হয়। যা বাণিজ্যিকভাবে যে কোন ভোজ্যতেলের ফসল থেকে প্রাপ্ত তেল হতে অনেক বেশি। পাম অয়েল গাছ পরিবেশ অনকূলনীয় জাতীয় উদ্ভিদ। উপকূলীয় ও পাহাড়ি এলাকায় পাম অয়েল গাছ চাষ করলে পাহাড় ধস, মাটির ক্ষয়রোধ, ঝড়-জলোচ্ছাস রোধ করে। পাম অয়েলের শিকড় অনেক দীর্ঘ এবং অসংখ্য। এর ফল সংগ্রহ করে তেল আহরণ সম্ভব হবে। এই পাম অয়েল অন্যান্য উদ্ভিদের চেয়ে বেশি কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে এবং বেশি অক্সিজেন ছাড়ে। পাম অয়েল ফলকে প্রক্রিয়াজাত করে দু’ধরনের তেল পাওয়া যায়। ফলটির মাংসল অংশ থেকে পাম তেল আহরণ করা যায়। বীজ বা শাঁস থেকে পাওয়া যায় কার্নেল। প্রতিটি ফল থেকে ১ ভাগ তেল ১ ভাগ পাম কার্নেল পাওয়া যায়। একটু পানিতে পাকা পাম ফল সিদ্ধ করে হাত দ্বারা চাপ দিলে রস বের হয়, সেই রসে পানি মিশ্রিত থাকে। এজন্য পানি মিশ্রিত তেল পাত্রে জ্বাল দিলে পানিবাষ্প হয়ে চলে যায়। তারপর বোতলজাত করে রান্নার কাজে ব্যবহার করা যায়। এই তেল স্বাদযুক্ত এবং গন্ধহীন। এছাড়া এতে ভিটামিন-ই এর পরিমাণ অধিক। পাম অয়েল খাদ্য ছাড়াও কসমেটিক , সাবান, মিল্ক পাউডার ইত্যাদিতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। হাতে তৈরি তেল দ্বারা ডিজেল ইঞ্জিন চালানো সম্ভব। সাতছড়ি বন্যপ্রাণী রেঞ্জ অফিসার মাহমুদ হোসেন জানান, বর্তমানে পাম অয়েল গাছে যে পরিমাণ ফল আসে তা বন্যপ্রাণীর একটি উৎকৃষ্ট খাবার। বিশেষ করে বানর জাতীয় প্রাণী এবং বন্য শুকরের। পাম অয়েল গাছগুলো সৌন্দর্য বর্ধক হিসেবে ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে প্রিয়। পাম শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে পাম অয়েল গাছগুলোর পরিচর্যা একান্ত প্রয়োজন। বিশ্বে সবচেয়ে কম জমি ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় পাম তেল। বিশ্বে মোট ২৫ কোটি ৮৯ লাখ হেক্টর জমিতে ভোজ্যতেল চাষ হয়। এর মধ্যে সয়াবিন তেল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় ৪০ শতাংশ জমি, কটনসিড উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় প্রায় ১৪ শতাংশ জমি, সূর্যমুখী তেল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় ১০ শতাংশ জমি, সরিষা উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় প্রায় ১৩ শতাংশ জমি এবং পাম তেল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় মাত্র ৫.৫ শতাংশ জমি। আরও আশ্চর্যজনক তথ্য হলো, ১ টন সেয়াবিন তেল উৎপাদনে যেখানে ২.২২ হেক্টর জমির প্রয়োজন, সেখানে পাম তেল উৎপাদনে প্রয়োজন মাত্র দশমিক ২৬ হেক্টর জমি। এছাড়া ১ টন সরিষার তেল উৎপাদনে প্রয়োজন ১.৫২ হেক্টর এবং সূর্যমুখী তেল উৎপাদনে প্রয়োজন ২ হেক্টর জমি। বিশ্বে প্রতিবছর ভোজ্যতেলের যোগান আসে ১৮ কোটি ৬৪ লাখ টন। এর মধ্যে ৩২ শতাংশ পাম তেল, ১৩ শতাংশ সয়াবিন তেল, ৮ শতাংশ সূর্যমুখী তেল, ৩ শতাংশ কটনসিড তেল এবং ২.২ শতাংশ বাদাম তেল। এছাড়া অন্যান্য তেলের যোগান আসে ১৯ শতাংশ। ভেজিটেবল তেল উৎপাদনেও পাম তেল এগিয়ে। বিশ্বেব মোট উৎপাদিত ভেজিটেবল তেলের মধ্যে পাম তেল হচ্ছে ৫৩.৬৭ শতাংশ, সয়াবিন তেল ৪১.৬৬ শতাংশ, সরিষার তেল ২৮.৪৮ শতাংশ, সূর্যমুখী তেল ১৪.৮০ শতাংশ এবং পাম কার্নেল ৫.৯২ শতাংশ। এছাড়া বাদাম তেল ৪ শতাংশ, কটনসিড তেল ৫ শতাংশ, অলিভ তেল ৩.৩৬ শতাংশ এবং নারকেল তেলের অংশ হচ্ছে ৩.২৪ শতাংশ। বিশ্বে মোট তেল বাণিজ্যের ৩২ শতাংশই পাম তেলের দখলে, যার ৮৫ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। অন্যদিকে বিশ্বে প্রতিবছর ১৮ কোটি ৩৬ লাখ টন ভোজ্যতেল ব্যবহৃত হয়। এরমধ্যে ৫৬ শতাংশই পাম তেল। আবার বিশ্বে মোট উৎপাদিত পাম তেলের মধ্যে ৪১ শতাংশ মালয়েশিয়া এবং ৪৬ শতাংশ ইন্দোনেশিয়া উৎপাদন করে। উল্লেখ্য ২০১৬ সনে মালেশিয়া প্রায় ১ কোটি ৯৩ লক্ষ টন পাম ও পাম কার্নেল তেল উৎপাদন করে এবং প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ টন রফতানি করে। প্রধান আমদানিকারক দেশগুলো হলো- ভারত, চীন, নেদারল্যান্ড, পাকিস্তান, তুরস্ক, ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, জাপান এবং ইতালি। বিশ্বের পাম তেলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিবছর গড়ে এই বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ। ১৯৯৭ সালে যেখানে এক কোটি ৭৭ লাখ টন পাম তেলের চাহিদা ছিল, সেখানে ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ কোটি ২১ লাখ টনে। ২০২০ সালে এই চাহিদা ৬ কোটি ৮০ লাখ টনে বেড়ে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাম তেলের সবচেয়ে বড় ভোক্তা হচ্ছে ভারত। দেশটি প্রতিবছর প্রায় ৭৬ লাখ টন পাম তেল ব্যবহার করে। এরপর চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান। উভয়ে প্রতিবছর প্রায় ৬১ লাখ টন করে পাম তেল ব্যবহার করে। অপার সম্ভাবনাময় সাতছড়ি তেলমাছড়াতে অবস্থিত পাম অয়েল শিল্পকে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিলে কর্মস্থানের পাশাপাশি বেকার সমস্যার সমাধানসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে এলাকাবাসী মনে করেন। সাতছড়ি তেলমাছড়াতে গুরুত্বপূর্ণ পাম অয়েল গাছগুলোকে রক্ষা করতে সরকারের সংশিষ্ট বিভাগের সুদৃষ্টি কামনা করছে এলাকাবাসী।
×