ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশকে লজ্জায় ডুবিয়ে জয় শ্রীলঙ্কার

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বাংলাদেশকে লজ্জায় ডুবিয়ে জয় শ্রীলঙ্কার

মিথুন আশরাফ ॥ তিনদিনও পুরো খেলতে পারল না বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে আড়াই দিনেই ঘায়েল! যে ফাঁদে শ্রীলঙ্কাকে ফেলতে চেয়েছিল, সেই পাতা ফাঁদে নিজেরাই ডুবল। দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে ২১৫ রানের বিশাল ব্যবধানে হারও হলো। লজ্জার হার মিলল। আর তাতে করে চট্টগ্রাম টেস্টে ড্র করে মিরপুর টেস্টে হারায় ১-০ ব্যবধানে সিরিজ হারও হলো বাংলাদেশের। এর আগে এমন টার্নিং উইকেটে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে হারানো গেছে। কিন্তু এবারের দলটি উপমহাদেশের বাইরের কোন দল নয়। দলটি শ্রীলঙ্কা। যে দলটি টেস্টে শক্তিশালী। উপমহাদেশের দল। এমন টার্নিং উইকেটে খেলেই যারা অভ্যস্ত। যাদের অভিজ্ঞ স্পিনারের সঙ্গে উইকেট শিকারি স্পিনারে ভরা। এমন দলের বিপক্ষে যখন স্পিননির্ভর উইকেট বানানো হয়েছে, তখনই ম্যাচে বাংলাদেশের বিপদ বোঝা গেছে। এমনই বিপদ এসেছে যে দুই ইনিংস মিলিয়ে বাংলাদেশ যে রান (প্রথম ইনিংসে ১১০ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ১২৩ রান) করল, তা শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংস (২২২ রান) থেকেও মাত্র ১১ রান বেশি। শ্রীলঙ্কা দ্বিতীয় ইনিংসে শেষ পর্যন্ত ২২৬ রান করায় বাংলাদেশের সামনে জিততে ৩৩৯ রানের টার্গেট দাঁড় হয়। সেই টার্গেট অতিক্রম করতে গিয়ে ৩০ ওভার পুরো খেলতে পারল না বাংলাদেশ। এক সেশনে ৩০ ওভার খেলা যায়। সেই একটা সেশন পুরোও খেলতে পারল না বাংলাদেশ। আড়াই দিনেই ৪০ উইকেট পড়ল। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কার দুই ইনিংসে বাংলাদেশ স্পিনাররা ১৫ উইকেট নিলেন। বাংলাদেশের দুই ইনিংসে শ্রীলঙ্কান স্পিনাররাও ১৫ উইকেট তুলে নিয়েছেন। পার্থক্য গড়া হয়ে গেছে শুধু ব্যাটিংয়ে। আর সেই ব্যাটিং নৈপুণ্য রোশেন সিলভার ব্যাট থেকে এসেছে। প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কার বিপদের সময় হাল ধরে ৫৬ রান করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ৭০ রানে থাকেন অপরাজিত। তাতে করে টার্নিং উইকেটে শ্রীলঙ্কান স্পিনাররা যতই ঝলক দেখান না কেন, একজন ব্যাটসম্যানই (সিলভা) ম্যাচের নায়ক হয়েছেন। ব্যাটিং করার জন্য কঠিন উইকেটে যে নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছেন সিলভা। দ্বিতীয়দিন যখন দ্বিতীয় ইনিংসে ২০০ রান করে শ্রীলঙ্কা, তখনই বাংলাদেশের সামনে ৩১২ রানে টার্গেট দাঁড় হয়ে যায়। বাংলাদেশের হারের সম্ভাবনা তখনই দেখা হয়। এরপরও আশা থাকে। যদি ব্যতিক্রম কিছু ঘটে। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটসম্যানরা যদি কিছু করে দেখাতে পারেন। কিন্তু সেই একই অবস্থা হয়। প্রথম ইনিংস থেকে আর ২৩ রান বেশি দ্বিতীয় ইনিংসে করতে পারে বাংলাদেশ। দ্বিতীয়দিন ৫৮ রানে অপরাজিত থাকা সিলভার সঙ্গে ৭ রানে অপরাজিত থাকা সুরঙ্গা লাকমাল তৃতীয়দিন ব্যাট করতে নামেন। খুব বেশিদূর আর এগিয়ে যেতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। আর ২৬ রান স্কোরবোর্ডে যোগ হতেই এই ইনিংসেও ৪ উইকেট নেয়া তাইজুল ইসলাম বল করতে এসে চতুর্থ ও পঞ্চম বলে লাকমাল ও রঙ্গনা হেরাথকে আউট করে দেন। শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় ইনিংসও শেষ হয়। তৃতীয়দিন ১১.৫ ওভার খেলতে পারে শ্রীলঙ্কা। তবে সিলভা অপরাজিত থাকেন। এরপরই শুরু হয় বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের টিকে থাকা এবং ৩৩৯ রানের টার্গেটে জেতার লড়াই। সেই লড়াইয়ে মধ্যাহ্ন ভোজের আগে তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েস আউট হয়ে যান। দ্বিতীয় সেশন শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই যখন মুমিনুল হক আউট হয়ে যান তখনই সবার মনের ভেতর তৃতীয়দিনেই খেলা শেষ হয়ে যেতে পারেÑ সেই শঙ্কাটা জেগে ওঠে। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের ভিআইপি গেটে সিরিজের ট্রফি দ্রুত আনা নিয়ে তোড়জোড়ও দেখা যায়। কখন খেলা শেষ হয়ে যায়, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। ওয়াকিটকিতে এরকমও বলতে শোনা যায়। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল দ্বিতীয় সেশন পুরোও খেলতে পারল না বাংলাদেশ। দলের ৬৪ রানে সর্বোচ্চ রান করা মুমিনুল (৩৩) আউট হওয়ার পর ৭৮ রানে লিটন কুমার দাসও সাজঘরে ফেরেন। তিন স্পিনার দিলরুয়ান পেরেরা, হেরাথ ও আকিলা ধনঞ্জয়া মিলে এমনই ঘূর্ণি জাদু দেখাতে থাকেন, বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা আতঙ্কে পড়ে যান। চোখে যেন অন্ধকারই শুধু দেখতে থাকেন। মুশফিকুর রহীম ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ মিলে পঞ্চম উইকেটে একটু আশা দেখান। কিন্তু যেই ১০০ রানে মাহমুদুল্লাহ ও ২ রান যোগ হতে মুশফিক আউট হয়ে যান তখন টপাটপ উইকেট পড়তে থাকে। ১২৩ রানের মধ্যে ব্যর্থতার ষোলোকলা পূর্ণ করা সাব্বির রহমান রুম্মন, আবদুর রাজ্জাক, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাইজুল ইসলাম আউট হয়ে যান। শেষ ২৩ রানেই ৬টি উইকেট হারায় বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে ১০৭ থেকে ১১০ রানের মধ্যে ৫ উইকেট হারিয়েছিল। এবার একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হয়। অভিষিক্ত আকিলা (৫/২৪) ও অভিজ্ঞ হেরাথ (৪/৪৯) মিলে একেক ওভারে বল করতে আসেন। টানা উইকেট নিতে থাকেন। বাংলাদেশের বড় হারের পথও তৈরি হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত বড় হারও হয়। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ দেশের মাটিতে এত বড় হার বরণ করে নিল। টি২০ স্টাইলে খেলতে থাকা ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় নাজেহাল হলো। লজ্জাই মিলল। ২০১৫ সালের ৮ মে মিরপুরে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩২৮ রানে হেরেছিল বাংলাদেশ। এরপর দেশের মাটিতে দুই বছর নয় মাসে এত বড় হার দেখতে হয়নি। এমনকি এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মিরপুর টেস্টটির আগে ৮ টেস্ট খেলে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিপক্ষে একটি করে টেস্টে জয়, চার টেস্টে ড্র ও দুই টেস্টে হারে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্টটি শেষে দেশের মাটিতে উপমহাদেশের বাইরের দলগুলোর বিপক্ষে খেলে বাংলাদেশ। স্পিন উইকেটে তাতে সাফল্যও মিলে। কিন্তু এবার স্পিন উইকেটে পারদর্শী দল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলে বড় ব্যবধানে হারে। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা স্কোর কার্ড বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা দ্বিতীয় টেস্ট টস ॥ শ্রীলঙ্কা (ব্যাটিং)। ভেন্যু ॥ মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম। শ্রীলঙ্কা প্রথম ইনিংস ২২২/১০ (মেন্ডিস ৬৮, সিলভা ৫৬, পেরেরা ৩১; রাজ্জাক ৪/৬৩, তাইজুল ৪/৮৩, মুস্তাফিজ ২/১৭) ও দ্বিতীয় ইনিংস দ্বিতীয়দিন শেষে ২০০/৮ (সিলভা ৫৮*, করুনারতেœ ৩২, লাকমাল ৭*; মুস্তাফিজ ৩/৩৫)। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস ১১০/১০ (মিরাজ ৩৮, লিটন ২৫; আকিলা ৩/২০, লাকমাল ৩/২৫)। শ্রীলঙ্কা দ্বিতীয় ইনিংস রান বল ৪ ৬ সিলভা নটআউট ৭০ ১৪৫ ১০ ০ লাকমাল ব তাইজুল ২১ ৪১ ৪ ০ হেরাথ এলবি. ব তাইজুল ০ ১ ০ ০ অতিরিক্ত (লেবা ৪) ৪ মোট (অলআউট; ৭৩.৫ ওভার) ২২৬ উইকেট পতন ॥ ৯/২২৬ (লাকমাল), ১০/২২৬ (হেরাথ)। বোলিং ॥ রাজ্জাক ১৭-২-৬০-১, মুস্তাফিজ ১৭-৩-৪৯-৩, তাইজুল ১৯.৫-২-৭৬-৪, মিরাজ ২০-৫-৩৭-২। বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস (টার্গেট ৩৩৯) রান বল ৪ ৬ তামিম এলবি. ব পেরেরা ২ ৭ ০ ০ ইমরুল ক ডিকভেলা ব হেরাথ ১৭ ২২ ১ ১ মুমিনুল ক ডিকভেলা ব হেরাথ ৩৩ ৪৭ ৩ ০ মুশফিক স্টা. ডিকভেলা ব হেরাথ ২৫ ৫১ ৪ ০ লিটন ক মেন্ডিস ব ধনঞ্জয়া ১২ ২০ ০ ০ মাহমুদুল্লাহ ক করুনারতেœ ব ধনঞ্জয়া ৬ ৮ ১ ০ সাব্বির ক মেন্ডিস ব ধনঞ্জয়া ১ ২ ০ ০ মিরাজ ক ডিকভেলা ব ধনঞ্জয়া ৭ ৬ ০ ১ রাজ্জাক স্টা. ডিকভেলা ব ধনঞ্জয়া ২ ৩ ০ ০ তাইজুল ক গুনাথিলাকা ব হেরাথ ৬ ৮ ১ ০ মুস্তাফিজ নটআউট ৫ ৩ ১ ০ অতিরিক্ত (বা ৬, লেবা ১) ৭ মোট (অলআউট ২৯.৩ ওভার) ১২৩ উইকেট পতন ॥ ১/৩ (তামিম), ২/৪৯ (ইমরুল), ৩/৬৪ (মুমিনুল), ৪/৭৮ (লিটন), ৫/১০০ (মাহমুদুল্লাহ), ৬/১০২ (মুশফিক), ৭/১০২ (সাব্বির), ৮/১০৪ (রাজ্জাক), ৯/১১৩ (মিরাজ), ১০/১২৩ (তাইজুল)। বোলিং ॥ লাকমাল ৩-০-১১-০, পেরেরা ১০-০-৩২-১, হেরাথ ১১.৩-১-৪৯-৩, ধনঞ্জয়া ৫-১-২৪-৫। ফল ॥ বাংলাদেশ ২১৫ রানে পরাজিত। ম্যাচসেরা ॥ রোশেন সিলভা (শ্রীলঙ্কা)। সিরিজ ॥ বাংলাদেশ ১-০ ব্যবধানে পরাজিত। সিরিজসেরা ॥ রোশেন সিলভা (শ্রীলঙ্কা)।
×