ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে প্রয়োজনের মাত্র ২ শতাংশ কিডনি প্রতিস্থাপন করা যায়

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

দেশে প্রয়োজনের মাত্র ২ শতাংশ কিডনি প্রতিস্থাপন করা যায়

নিখিল মানখিন ॥ দেশে কিডনি বিকল রোগীদের জন্য কিডনিদাতার সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠেছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষমাণ রোগীদের মাত্র শতকরা ২ ভাগ রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়। অন্যরা নিজেদের মতো চেষ্টা করে রোগী নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। বাকিরা ডায়ালাইসিস দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকা দিয়েও কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিডনি দেয়ার পর ফলোআপ চিকিৎসা ও বিভিন্ন কারণে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন জীবিত কিডনিদাতারা। পাশাপাশি রয়েছে কিডনি সার্জনের সঙ্কট। আইনী জটিলতাসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কারণে কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রমে অংশ নিতে চান না সার্জনরা। এভাবে ব্যয়বহুল চিকিৎসা, উন্নত চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের জটিলতার কারণে শত শত কিডনি বিকলরোগী অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। মৃত্যুর মুহূর্ত দেখার অপেক্ষা করা ছাড়া বিকল্প কোন উপায় থাকছে না রোগীর স্বজনদের। কিডনিদাতা ও গ্রহীতার ওষুধের মূল্যহ্রাস এবং মস্তিষ্কের মৃত্যুর (ব্রেইন ডেথ) পর তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসুস্থ ব্যক্তির দেহে সংযোজন করার সুযোগ রেখে আইন তৈরির ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে মোঃ শহীদ মিয়ার (৪০)। ডায়ালাইসিস দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। দুটি ডায়ালাইসিস ও ওষুধের পেছনে প্রতি সপ্তাহে খরচ লাগে প্রায় ১০ হাজার টাকা। জরুরী ভিত্তিতে কিডনি প্রতিস্থাপন করানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু রোগীর পরিবারের পক্ষে এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরিবারটির আর্থিক অবস্থা ভাল না। কয়েক বছর আগে তার বাবা মারা যান। মা, ছোট তিন ভাই-বোন, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে শহীদ মিয়ার সংসার। চিকিৎসার খরচ মেটানোর পেছনে ইতোমধ্যে সহায় সম্বল ফুরিয়ে গেছে। অসহায় হয়ে পড়েছে মোঃ শহীদ মিয়ার পরিবার। টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার জলছত্র গ্রামের ৩০ বছর বয়সী হাসান মিয়ার দুটি কিডনি অকেজো হয়ে গেছে। কিডনি প্রতিস্থাপন করাতে তাগিদ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু কিডনিদাতা পাওয়া যাচ্ছে না। তার বড় ভাই হেলাল মিয়া জনকণ্ঠকে জানান, সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে ৬ লাখ টাকা যোগাড় করেছি। কিন্তু কিডনিদাতা পাওয়া যাচ্ছে না। সরাসরি রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে কিডনি গ্রহণ নিষিদ্ধ বলে জানিয়ে দিয়েছেন দেশের চিকিৎসকরা। রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়ের কারও কিডনি মিল পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব দেশে অবাধ কিডনিদাতা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, সেসব দেশে যেতে হলে আরও টাকা লাগবে। এভাবে চিকিৎসার নানা জটিলতায় পড়ে তার ভাই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে জানান মোঃ হেলাল মিয়া। টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে সিরাজগঞ্জের রবিউলের চিকিৎসা। তার দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। জরুরী ভিত্তিতে কিডনি প্রতিস্থাপন করানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু রোগীর পরিবারের পক্ষে এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। রবিউলের বাড়ি সিরাজগঞ্জ শহরের ধানবান্ধী মহল্লার জিএম হিলালী রোডে। তিনি সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বিভাগের অস্থায়ী ভিত্তিক পিয়নের চাকরি করেন। পরিবারটির আর্থিক অবস্থা ভাল না। বর্তমানে টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। রবিউল ও সেলিনা পারভিনের সংসারে রয়েছে তিন সন্তান। চিকিৎসার পেছনে সহায় সম্বল ফুরিয়ে গেছে। এভাবে কিডনি বিকল হলেই রোগীর মৃত্যু যেন ঠেকানো যাচ্ছে না! দেশে কিডনি রোগী ॥ দেশে প্রায় ২ কোটি লোক কোন না কোন ধরনের কিডনি রোগে ভুগছে। আক্রান্তের শতকরা ৭৫ ভাগ রোগী কিডনি নষ্ট হওয়ার আগে এ মরণব্যাধির অস্তিত্ব ধরতে পারেন না। কিডনি বিকল রোগীর চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, মাত্র শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ লোকের চিকিৎসা চালিয়ে যাবার সামর্থ্য আছে। চিকিৎসা ব্যয় ॥ দেশে কিডনি রোগ চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও খুব ব্যয়বহুল। প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু থাকলেও সফলতার মাত্রা সন্তোষজনক নয়। দেশের সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা নেই। সীমিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু রয়েছে। কিডনি রোগের উপসর্গ ও চিকিৎসা সম্পর্কে অধ্যাপক ডাঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগ ও প্রতিকার নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। তিনি জানান, বিভিন্ন কারণে কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে কারও কারও কিডনি হঠাৎ করে অকেজো হয়ে যায়। বাংলাদেশে ডায়রিয়া, অতিরিক্ত বমি, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, বিভিন্ন রকম ইনফেকশন, ম্যালেরিয়া, প্রসবকালীন জটিলতা, সাংঘাতিক ধরনের নেফ্রাইটিস, বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও কিডনির পাথরের কারণে হঠাৎ করেও কিডনি অকেজো হয়ে যায়। এ ধরনের কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়ার ভাল দিক হচ্ছে, এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ করা যায়। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা করলে অনেকের কিডনি পুনরায় স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরে পায়। এদেশে প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার লোকের কিডনি বিভিন্ন কারণে অকেজো হয়ে যায়। সঠিক চিকিৎসা করলে প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ রোগীর কিডনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। হঠাৎ করে কিডনি অকেজো হওয়াকে প্রতিরোধ করতে হলে বিশুদ্ধ খাবার ও পানি পান করতে হবে। রক্তক্ষরণ হলে সঙ্গে সঙ্গে রক্ত দিতে হবে। ইনফেকশন হলে তার সঠিক সময়ে চিকিৎসা করতে হবে। তিনি আরও জানান, প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে কিডনি প্রতিস্থাপন খুবই ব্যয়বহুল। প্রাইভেট হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতেই প্রায় ৩ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেলে কিডনি প্রতিস্থাপনের আগ পর্যন্ত রোগীকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। প্রতি সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করাত হয়। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে প্রতি ডায়ালাইসিসের খরচ ৮শ’ টাকা হলেও প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে লাগে ৩ হাজার টাকা থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, নিজেরা কিডনি দেয়ার পরও সিঙ্গাপুরে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা, থাইল্যান্ডে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং ভারতে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা লাগে সংযোজনের জন্য। অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম জানান, কিডনি প্রতিস্থাপনের দুদিন আগে থেকে পরবর্তী সারাজীবন ধরে রোগীকে নিউরাল ও সেলসেপ্ট নামে দুটি ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। ওই দুটি ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। কিডনি প্রতিস্থাপন ভালভাবে সম্পন্ন হলেও ওই দুটি ওষুধ নিয়মিত না খেলে রোগীর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়ে। আর প্রতিটি নিউরাল (১০০ এমজি) দাম ১৫০ টাকা এবং প্রতিটি সেলসেপ্টের দাম ১১০ টাকা। জটিল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ ॥ বিধিমালা চূড়ান্ত না হওয়ায় কিডনি বিকল রোগীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বর্তমানে অঙ্গ-প্রতঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন ১৯৯৯ নামে রাষ্ট্রীয় গৃহীত একটি আইন আছে। ওই আইনে সরাসরি রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে কিডনি গ্রহণ নিষিদ্ধ। অপেক্ষাকৃত বেশি টাকার মালিকরা কিডনি বিকল রোগী বাঁচাতে অনাত্মীয় দাতা নিয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। যাদের টাকা নেই, রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়ের মধ্যে দাতা নেই, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে নির্মম মৃত্যু। কিডনি বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, আত্মীয় ছাড়া কিডনি দান করা আইন ও নীতিগতভাবে ঠিক নয় এবং অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কিডনি দাতার জেনেটিক্যাল সম্পর্ক যেসন মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, মামা, চাচা হতে হবে। রক্তের গ্রুপ ও টিস্যু একই হলে ভাল হয়। কিডনি দাতার বয়স অবশ্যই ১৫ বছর উপরে এবং ৬৫ বছরের নিচে হতে হবে।
×