ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নির্বাচন সামনে রেখে নাজুক পরিস্থিতি

বিএনপির কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ার আশঙ্কা

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বিএনপির কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ার আশঙ্কা

শরীফুল ইসলাম ॥ খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি বিএনপি। তিনি বেশি দিন কারাগারে থাকলে নির্বাচনের প্রস্তুতিসহ সব দলীয় কর্মকা- স্থবির হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই খালেদা জিয়ার জামিনের অপেক্ষায় বিএনপি। তিনি কখন জামিন পাবেন বা আদৌ পাবেন কি না, আর জামিন পেলেও নির্বাচন করতে পারবেন কি না এ নিয়ে খোদ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেই চলছে নানামুখী জল্পনা-কল্পনা। জানা যায়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৫ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলেও এখনই কঠোর কর্মসূচী দেবে না বিএনপি। আপাতত আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জামিনের চেষ্টা করার পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালন করবে। তবে কোন কারণে জামিন না হলে কিংবা উচ্চ আদালতে মামলার সাজা বহাল থাকলে এক পর্যায়ে কঠোর কর্মসূচী ঘোষণা করে রাজপথ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করবে বিএনপি। আর এসব কিছু বিবেচনায় নিয়েই খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে শনিবার বিএনপি তিন দিনের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। এ কর্মসূচী অনুসারে সারাদেশে সোমবার মানববন্ধন, মঙ্গলবার অবস্থান ও বুধবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অনশন করবে বিএনপি। এদিকে খালেদা জিয়া বেশি দিন কারাগারে থাকলে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের প্রস্তাব কিভাবে ও কখন দেয়া হবে এবং দলের নির্বাচনী প্রস্তুতি কিভাবে এগিয়ে নেয়া হবে সে বিষয়টিও এখন দলের নেতাকর্মীদের ভাবিয়ে তুলেছে। তারা মনে করছেন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে লন্ডন প্রবাসী সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও তিনি এখন নেতাকর্মীদের সামনে উপস্থিত থেকে সরাসরি কোন নির্দেশনা দিতে পারবেন না। এ ছাড়া তারেক রহমানের মাথার ওপরও ১০ বছরের কারাদ- ঝুলে আছে। সহসা তার দেশে ফিরে আসারও কোন সম্ভাবনা নেই। এ পরিস্থিতিতে যতই বলা হোক দল পরিচালনায় কোন সমস্যা হবে না বাস্তবে সমস্যা থেকেই যাবে। কারণ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কিছু বিষয় আছে যা সরাসরি সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। খালেদা জিয়া কারাগারে ও তারেক রহমান লন্ডনে থাকায় অন্য নেতারা নির্ভেজালভাবে সেরকম সিদ্ধান্ত দিতে হিমশিম খাবেন। তাই নেতাকর্মীদের মধ্যে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সূত্র মতে, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুসারে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সমন্বয়ে দলীয় কর্মকা- পরিচালনার সুযোগ থাকলেও খালেদা জিয়ার অবর্তমানে সমস্যা থেকেই যাবে। দলীয় যে কোন সিদ্ধান্তের বিষয়ে খালেদা জিয়ার নির্দেশ যেভাবে সর্বসম্মতভাবে মেনে নিয়ে পালন করা হয় সেভাবে অন্য কারও নির্দেশনা পালন হয় কি না এ নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। কারণ ওয়ান-ইলেভেনের সময় এই বিএনপি নেতারাই পরস্পরবিরোধী গ্রুপে বিভক্ত হয়ে দলকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। অবশ্য বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুসারে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়া খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান দেশে থাকলে হয়ত এ বিষয়ে কোন সমস্যা হতো না। অভিজ্ঞ মহলের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির জন্য আরেকটি সমস্যা দেখা দিতে পারে দলে তারেক রহমানের কাছের জন হিসেবে পরিচিত কিছু নেতাকে নিয়ে। কারণ খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর তাদের তৎপরতা বেড়ে গেছে। যদি দলকে সঙ্কটমুক্ত রাখতে তাদের তৎপরতা বেড়ে থাকে তাহলে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আর যদি তারেক রহমানের কাছের জন হিসেবে পরিচয় দিয়ে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করেন তাহলে সমস্যা হতেই পারে। তাই তারেক রহমান ও বিএনপির সিনিয়র নেতাদের এ বিষয়ে সজাগ থাকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন অভিজ্ঞ মহল। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দলের সংস্কারপন্থী নেতাদের মধ্যে কাউকে কাউকে কমিটিতে স্থান দিয়ে আবার কাউকে কমিটিতে স্থান না দিয়েও দলের পক্ষে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর অনুপস্থিতিতে সেটা কোন দিকে মোড় নেয় তাও দলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ সংস্কারপন্থী বেশির ভাগ নেতা খালেদা জিয়ার প্রতি তেমন ক্ষোভ না থাকলেও তারেক রহমানের প্রতি ক্ষোভ ছিল। তারেক রহমান দেশে থাকলে হয়ত কাছে ডেকে তাদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নিতে পারতেন। কিন্তু সুদূর লন্ডনে থেকে তিনি বিষয়টিকে কিভাবে মোকাবেলা করতে পারবেন তাও এখন দেখার বিষয়। অবশ্য খালেদা জিয়ার সহসাই জামিন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শুক্রবার রাতে বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার জামিনের ব্যাপারে রবিবার থেকে কার্যক্রম শুরু হবে। আমরা রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পরই আদালতে জামিনের আবেদন করব। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালন করছি। সেই সঙ্গে তাঁর জামিনের জন্য আইনী প্রচেষ্টাও চলছে। খালেদা জিয়া শীঘ্রই জামিন পাবেন আমরা আশা করছি। আর তিনি জামিন পেলে আবার দলীয় সব কর্মকা- স্বাভাবিক গতিতে চলবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি যখন যেভাবে নির্দেশনা দেবেন সবকিছু সেভাবেই হবে। তাই তিনি যত তাড়াতাড়ি জামিন পাবেন দলের জন্য ততই মঙ্গল। এদিকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার ৫ বছর সাজা হওয়ার পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে বিএনপিতে নতুন করে হিসেব-নিকেশ শুরু হয়েছে। দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতা খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের আগেই বলে রেখেছেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া তাদের দল নির্বাচনে যাবে না। তাই খালেদা জিয়ার ৫ বছর সাজা হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচন করতে পারবেন কি না তা আইনী প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল। আইনী প্রক্রিয়ার কারণে যদি খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে না পারেন আর বিএনপির সিনিয়র নেতারা আগে যে কথা বলেছেন তা যদি বহাল রাখেন তাহলে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়টিও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আর এ কারণেই খালেদা জিয়ার ৫ বছরের সাজার বিষয়টি বিএনপিকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অবশ্য আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে নিয়ে একাদশ নির্বাচনে যাওয়াই বিএনপির মূল লক্ষ্য। আর এ কারণেই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ৫ বছর সাজা ও কারাগারে পাঠানোর পরও দলের পক্ষ থেকে কঠোর কোন কর্মসূচী দেয়া হয়নি। দেয়া হয়েছে দেশব্যাপী ২ দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচী। আর শুক্র ও শনিবার এ কর্মসূচী পালন করতে গিয়েও বিএনপি নেতাকর্মীরা রাজপথে তেমন কোন সহিংস ঘটনা ঘটায়নি। কঠোর কর্মসূচী ও রাজপথে সহিংসতার পথ বেছে নিলে সরকার বিএনপির প্রতি আরও কঠোর এবং খালেদা জিয়া নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে যেতে পারেন এমন আশঙ্কা থেকেই বিএনপি এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালনের পক্ষেই অবস্থান করছে। তবে তারা শেষ পর্যন্ত এ অবস্থানে থাকে কি না তাই দেখার বিষয়। বিএনপি সূত্র জানায়, খালেদা জিয়াকে নিয়ে সরকারের অবস্থান শেষ পর্যন্ত কি হয় তা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। খালেদা জিয়ার জামিন পেতে দেরি হলে আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচী আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে আবারও হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী দেয়া হতে পারে। কারণ খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রাখার চেষ্টা করা হলে বিএনপির পক্ষে নির্বাচনে যাওয়া অসম্ভব হবে। সে ক্ষেত্রে বিএনপিকে কঠোর আন্দোলনের পথই বেছে নিতে হবে। যদিও কারাগারে যাওয়ার আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছেন যেন আপাতত কঠোর কোন কর্মসূচী না দিয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী দেয়া হয়। বৃহস্পতিবার বিকেলে নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ২ দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচী ঘোষণার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, খালেদা জিয়া আমাদের বার বার নির্দেশ দিয়ে গেছেন যেন আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালন করি।
×