ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এএলআরডির গোলটেবিল আলোচনা

কৃষি জমি ও কৃষকের অধিকার রক্ষায় আগ্রাসন বন্ধের তাগিদ

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

কৃষি জমি ও কৃষকের অধিকার রক্ষায় আগ্রাসন বন্ধের তাগিদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে দিন দিন কমছে কৃষি জমি। বসতবাড়ি তৈরি, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং, চিংড়ি চাষ, তামাক চাষ, দোকানপাট নির্মাণ, হাউজিং সোসাইটি নির্মাণ, ইটভাঁটি প্রভৃতির জন্য কৃষি জমি প্রয়োজন। ব্যাপকভাবে চলছে আবাসনের নামে দখল। কৃষি জমি সুরক্ষায় এসব দখল বন্ধ করতে হবে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। তারা বলছেন, শুধু আইন তৈরি করে বা তা প্রয়োগ করে নয়, গনসচেতনতা ও গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে কৃষি জমি রক্ষা ও কৃষকের অধিকার রক্ষা করতে হবে। ধ্বংসের হাত থেকে কৃষি জমিকে রক্ষায় কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন দ্রুত প্রণয়ন করতে হবে। শনিবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির গোলটেবিল লাউঞ্জে এ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি) আয়োজিত ‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের জরুরী গুরুত্ব এবং খাদ্য যোগানের নিশ্চয়তা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এ দাবি জানান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ও সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা। প্যানেল আলোচক ছিলেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-এর সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান ভূইয়া, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির ব্যুরো সদস্য বিমল বিশ্বাস, সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী ও সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের নেতা এ্যাডভোকেট তবারক হোসেইন, গবেষক ও গ্রিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন এবং বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি বদরুল আলম। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইনজীবী রফিক আহম্মেদ সিরাজী। এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা স্বাগত বক্তব্যে বলেন, কৃষি জমি সুরক্ষায় সরকারের দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নেই। ফলে আশঙ্কা জনক হারে কৃষি জমি কমছে। কৃষি জমি রক্ষার জন্য ভূমির যথেচ্ছ ব্যবহার রোধ করা জরুরী। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে রফিক আহম্মেদ সিরাজী বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট ১ কোটি ৫২ লাখ ৪৫ হাজার ৮৪১ দশমিক ৯৩ হেক্টর ভূমির মধ্যে আবাদযোগ্য জমি ৮৫ লাখ ৫ হাজার ২৭৮ দশমিক ১৪ হেক্টর। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ভূমির ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ জুড়ে বনভূমি, ২০ দশমিক ১ শতাংশে স্থায়ী জলাধার, ঘরবাড়ি, শিল্প-কারখানা, রাস্তাঘাট ইত্যাদি, অবশিষ্ট ৬৬ দশমিক ৬ শতাংশ জমি কৃষি কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৫১ লাখ ৮৩ হাজার ১৮৩টি। তাদের শতকরা প্রায় ৬০ ভাগই প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক। সরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের কৃষি জমি বিলুপ্তির প্রবণতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ থেকে ২০১১ এই ১২ বছরে দেশে প্রতিবছর ৬৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে গেছে। অথচ পূর্বের তিন দশকে প্রতিবছর ফসলি জমি কমেছে গড়ে ১৩ হাজার ৪১২ হেক্টর। একই সঙ্গে প্রতিবছর আবাসন খাতে ৩০ হাজার ৮০৯ হেক্টর, নগর ও শিল্পাঞ্চলে চার হাজার ১২ হেক্টর এবং মাছ চাষে তিন হাজার ২১৬ হেক্টর জমি যুক্ত হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৬ হইতে ২০০০ সাল পর্যন্ত শূন্য দশমিক ১৩৭ শতাংশ হারে কমলেও, ২০০০ হইতে ২০১০ সাল মেয়াদে ওই হারের পাঁচ গুণেরও বেশি শূন্য দশমিক ৭২৮ শতাংশ হারে কৃষি জমি কমেছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত এক গবেষণায় দেখিয়েছেন ২০০৩ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ২৬ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩১ একর কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে গেছে। গড়ে প্রতিবছরে ২ লাখ ৪১ হাজার ৪৩০ একর অর্থ্যাৎ গড়ে প্রতিদিন ৬৬১ দশমিক ৪৫ একর কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। অকৃষি খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে- বসতবাড়ি তৈরি, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং, চিংড়ি চাষ, তামাক চাষ, দোকানপাট নির্মাণ, হাউজিং সোসাইটি নির্মাণ প্রভৃতি। আশঙ্কার বিষয় হলো, প্রতিবছর প্রায় ১ শতাংশ হারে কৃষি জমি কমছে। অস্বাভাবিক কৃষি জমি হ্রাসের এই প্রবণতা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। সরকারী হিসেব অনুযায়ী ইটভাঁটির বর্তমান সংখ্যা ৬ হাজার ৯৩০টি। এগুলো বেশির ভাগই কৃষি জমির ওপর গড়ে উঠেছে। দেশের বার্ষিক উৎপাদিত ইটের পরিমাণ ১৭ দশমিক ২ বিলিয়ন। এই ইট তৈরিতে ১২৭ কোটি সিএফটি সাটির দরকার হয়। এই মাটি সংগ্রহ করা হচ্ছে কৃষি জমির সবচেয়ে উর্বর অংশ জমির উপরিভাগের মাটি। কৃষি জমি যথা সম্ভব কৃষি কাজে ব্যবহার নিশ্চিত করা ভূমি ব্যবহার নীতির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলেও বাস্তব অবস্থা এর বিপরীত। ভূমি ব্যবহার নীতি ২০০১ এ বলা আছে, কৃষি জমি কৃষিকাজে ব্যতিরেকে অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কৃষি জমি ভরাট করে বাড়ি ঘর, শিল্প-কলকারখানা, ইটভাঁটি বা অন্য অকৃষি স্থাপনা কোনভাবেই নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু এ নীতির বাস্তবায়নে কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপে নেই। কিভাবে অকৃষিখাতে জমি চলে যায় তা দেখার জন্য আটটি সংগঠন জরিপ চালায়। তাতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ভূমি দখলের চিত্র উঠে এসেছে। অনুষ্ঠানে বদরুল আলম বলেন, যে হারে কৃষি জমি বিলুপ্ত হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে তা খুবই উদ্বেগজনক। কৃষি আমাদের জীবন জীবিকার প্রধান ক্ষেত্র। ভূমি ছাড়া কৃষি সম্ভব নয়। ভূমি জীবন জীবিকার উৎস। কৃষক মানেই তার ভূমি থাকতে হবে। ভূমি না থাকলে কৃষক কোথায় চাষ করবে। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমির প্রয়োজন। কৃষি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা দিতে পারে। এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে এ্যাডড্রেস করা দরকার। সেইসঙ্গে কৃষক ও আদিবাসীদের স্বার্থেও বিষয়ে জোর দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কৃষি জমি সুরক্ষার জন্য নীতিমালা আর কৃষক ও আদিবাসীদের অধিকারের জন্য একটি আইন করা খুবই জরুরী। আবাসনের নামে ব্যাপকভাবে দখল চলছে, কৃষি জমি সুরক্ষায় এসব দখল বন্ধ করতে হবে। আইনজীবী তবারক হোসেন বলেন, সরকার কোন শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে। পার্লামেন্টে কতজন ব্যবসায়ী আছে ? তার মধ্যে কতজন ভূমিদস্যু আছে, তা অনেকেই জানেন! ভূমিদস্যুরা ভাল ভাষায় ডেভেলপার হিসেবে পরিচিত। এই ডেভেলপাররাই দুর্বল কৃষকের জমি কেনার জন্য চারপাশের জমি কেনার পর ওই কৃষককে বাধ্য করে কম দামে জমি বিক্রি করতে। এতে গ্রামীণ অনেক দালাল আছে তারা তাদের সহযোগিতা করে। এক সময় কৃষক আন্দোলন খুবই জোরদার ছিল বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৃষকের যে গন সংগঠন গুলোকে আমরা টুকরো টুকরো করে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছি। এখানে যারা রাজনৈতিকরা আছেন, তারা উদ্যোগ নিয়ে তাদের আবার সংগঠিত করতে হবে। সেনাবাহিনীর জন্য জমি যে বন্দোবস্ত দেয়া হচ্ছে, তার আমি দৃঢ় প্রতিবাদ জানাই। বজলুর রশিদ বলেন, শুধু আইন তৈরি করে বা তা প্রয়োগ করে নয়, গণসচেতনতা ও গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে দাবি আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া শুধু রাজধানীতে সভা সেমিনার নয়, সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সচেতনতা সভা সেমিনার করতে হবে। কমরেড বিমল বিশ্বাস বলেন, এক ধরনের ভূমিদস্যু আছে যারা শহরটাকে গ্রাস করছে। আরেক ধরনের ভূমিদস্যু আছে, যারা হত দরিদ্র্যের জমি জাল জালিয়াতের মাধ্যমে গ্রাস করছে। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে কৃষক আন্দোলনের কোন অস্তিত্ব নেই। যা আছে তা বলার মতো নেই। তাছাড়া খাস জমির আইনের যথাযথ ব্যবহার হয় না এমন প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, রক্ষক যদি ভক্ষক হয়, তা হলে যা হবার তাই হচ্ছে। খালেকুজ্জামান বলেন, স্বাধীনতার পর মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণ। খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে তিনগুণ। উৎপাদন কারা বাড়িয়েছে, কৃষকই তো। আপনারা যারা আছেন তারা ঐক্যবদ্ধ হন। জনগণের শক্তি গড়ে তোলেন। ভূমিদস্যুদের শক্তির চেয়ে জনগণের শক্তি বড় না করতে পারলে কাজ হবে না। আজ সময়ে এসেছে আপনার হাত মুষ্টিবদ্ধ করবেন নাকি হাত উঁচু করে কাঁদবেন সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার। ফজলে হোসেন বাদশা প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, গ্রামের দুর্বল লোকদের সঙ্গেই ভূমিদস্যুতা বেশি হয়। তাদের জমি নিয়ে মামলা বেশি হয়। সবলরা মামলা এমনভাবে করে, দুর্বল লোকদের আর হাইকোর্ট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। এক সময় তারা ওই ভূমিদস্যুর কাছে জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। তিনি আরও বলেন, ভূমি সংস্কারে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ভূমিকা রাখে। আর আমাদের দেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বলে কোন কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, যারা দেশটাকে বাঁচিয়ে রাখছে তারা কৃষক-শ্রমিক আর নারী। নারীরা দিচ্ছে সমৃদ্ধি। যারা বাঁচিয়ে রেখেছে আজ তাদের মেরে বহুমুখী কার্যক্রম হচ্ছে। যারা রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখছে, এই শক্তিগুলো আজ উপেক্ষিত। তাদের অধিকার ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেন, কৃষক ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে তার ৯০ শতাংশই কৃষক বা কৃষকের সন্তান। কৃষকদের মুক্তির জন্য একটি রাজনৈতিক ছাতার দরকার। যার তলে দাঁড়িয়ে কৃষক বাঁচানোর জন্য দেশ বাঁচানো জন্য আমরা একসঙ্গে লড়ব, একসঙ্গে মরব এই প্রতিজ্ঞা করে নামতে হবে। এসব সমস্যার সমাধানে অনুষ্ঠানে আটটি সুপারিশ এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হচ্ছে- অবিলম্বে প্রস্তাবিত কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কৃষি খাস জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বন্দোবস্ত দেয়া সুনিশ্চিত করতে হবে। কৃষি খাস জমি কোন প্রকার অকৃষি কাজে ব্যবহারে বন্দোবস্ত দেয়া যাবে না বিধান প্রবর্তন করে কার্যকর করতে হবে। অকৃষি খাস জমিকে কেবল উন্নয়ন কাজেই বন্দোবস্ত দেয়ার বিধান করতে হবে। ইটভাঁটির গ্রাস থেকে কৃষি জমিকে বাঁচাতে হবে এবং কৃষি জমি রক্ষায় সচেতনতার জন্য ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে।
×