রশিদ মামুন ॥ বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিভিন্ন ব্যাংকে সাত হাজার ৭০০ কোটি টাকা অলস ফেলে রেখেছে। অভিযোগ রয়েছে, এমনসব ব্যাংকে এসব টাকা রাখা হয়েছে যাদের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে কোন লেনদেনও করে না সরকারের লোকসানি এই প্রতিষ্ঠানটি। কেন বিপুল পরিমাণ টাকা অলস ফেলে রাখা হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ বিদ্যুত বিভাগ। নিয়ম অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সময় এসব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এত বড় আর্থিক গোজামিলের বিষয়ে কোন প্রশ্নই তোলেনি।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে দেখা গেছে পিডিবি বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সব মিলিয়ে ৮ থেকে ১০ ভাগ সুদেও ঋণ নিচ্ছে। অন্যদিকে নিজেদের টাকা ব্যাংকে ফেলে রেখে দুই থেকে তিন ভাগ হারে সুদ নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি বিদ্যুত বিভাগের একটি পর্যালোচনাতেও পিডিবির আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, এত টাকা এভাবে বিনিয়োগ না করে ফেলে রাখা আইনসঙ্গত হয়নি। এই টাকা ভোক্তার টাকা। তারা এই টাকা বিনিয়োগ করলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে আসত। এতে ভোক্তা কম দামে বিদ্যুত পেত। একদিকে তারা বেশি সুদে ঋণ নিয়ে প্রকল্প করছে অন্যদিকে তারা কম সুদে নিজেদের টাকা ফেলে রেখেছে। ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনা করে কাজ করলে এটা সম্ভব ছিল না বলে মনে করেন তিনি।
পিডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাত হাজার ৭০০ কোটি টাকার মধ্যে ঢাকার পিডিবি সদস্যের (অর্থ) অধীন দফতরে রয়েছে পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর বাকি অর্থ বিভিন্ন বিতরণ জোনের অধীনে ব্যাংক হিসাবে পড়ে রয়েছে।
বিদ্যুত বিভাগ জানায়, প্রতিমাসে পিডিবির রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দুই হাজার ১০০ থেকে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর প্রতিমাসে প্রতিষ্ঠানটির ব্যয় হয় দুই হাজার ৪৫০ থেকে দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এতে প্রতিমাসে পিডিবির ঘাটতি থাকে ৩৫০ কোটি থেকে ৪০০ কোটি টাকা। যদি ধরে নেয়া হয় পিডিবি তিন মাসের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল (পরিচলন ব্যয়) হাতে রাখতে চায়, সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ তাকে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা হাতে রাখতে হয়। কিন্তু সেখানে কেন আরও ছয় হাজার ২০০ কোটি টাকা অলস ফেলে রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে বোঝা যায় প্রতিষ্ঠানটির কোন আর্থিক জবাবদিহিতা নেই। তবে অভিযোগ রয়েছে নির্দিষ্ট কোন ব্যাংকে টাকা রাখলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ কমিশন পেয়ে থাকেন। সেই কমিশনের পরিমাণও সর্বোচ্চ দশমিক ৫০ থেকে একভাগ পর্যন্ত হয়ে থাকে। এজন্যই এসব ব্যাংক হিসাবে বছরের পর বছর ধরে এভাবে সরকারী অর্থ ফেলে রাখা হয়।
বিদ্যুত বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, পিডিবির প্রায় সব অর্থই শর্ট টার্ম ডিপোজিটস (এসটিডি) হিসেবে রাখা হয়েছে। ব্যাংক ভেদে এমন আমানতের ওপর সুদের হার আড়াই থেকে তিনভাগ। অন্যদিকে এসব টাকা যদি ফিক্সড ডিপোজিট -এফডিআর (নির্দিষ্ট মেয়াদী হিসাব) করে রাখা হতো তাহলেও পিডিবি আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হতো। এফডিআরে এখন বিভিন্ন ব্যাংক সর্বোচ্চ সাড়ে সাতভাগ পর্যন্ত মুনাফা দিয়ে থাকে। যেখানে বছরের পর বছর কোন লেনদেন নেই বা বছরে একবার বা দুবার লেনদেন করা হয়েছে সেখানে এসটিডির পরিবর্তে কেন এফডিআর হিসাবে টাকা রাখা হয়নি তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
পিডিবি বিদ্যুত বিভাগে সব শেষ যে হিসাব দিয়েছে তাতে দেখা যায় তাদের ঢাকার প্রধান কার্যালয়ের অধীনে পাঁচ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা এসটিডি হিসাবে রেখেছে তারা। সম্প্রতি পিডিবির কাছে এক বৈঠকে জবাব চাওয়া হলে সংস্থার চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ বলেছেনÑ এমন তো হওয়ার কথা নয়, আমরা দেখছি বিষয়টি। ওই বৈঠকে থাকা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এই বিশাল অঙ্কের টাকা ফেলে রাখা হয়েছে অথচ প্রতিষ্ঠানের প্রধান বিষয়টি অবগত নন।
সূত্রমতে, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছর পর্যন্ত পিডিবির লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকায়। এই দুই অর্থবছরে পিডিবি দেখিয়েছে পর্যায়ক্রমে তাদের লোকসান হয়েছে তিন হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা (২০১৫-২০১৬ অর্থবছর) এবং ৪ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা (২০১৬-২০১৭ অর্থবছর। চলতি অর্থবছরে সরকার গ্রীষ্মের পরিস্থিতি সামাল দিতে নতুন তেল চালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছে। পিডিবি তাদের ব্যয় বৃদ্ধির আগাম পূর্বাভাস দিয়ে বলছে এ জন্য তাদের ১০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। একক ক্রেতা হিসেবে বেশি দামে বিদ্যুত কিনে কম দামে বিক্রি করায় বছরের পর বছর ধরে পিডিবির দেনার পরিমাণ বাড়ছে। সরকারের তরফ থেকে বাজেটে ভর্তুকি বলা হলেও অর্থ বিভাগ বলছে এটা সহজশর্তের ঋণ (সফট লোন)। ঋণ বা ভর্তুকি যাই হোক না কেন এই অর্থ পিডিবির তরফ থেকে কখনই পরিশোধ করা হয় না। শুধু এতে পিডিবির ব্যালান্সশীটে (আয় ব্যয় বিবরণী) লোকসানের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিডিবি একটি বড়মাত্রার লোকসানি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের কোনভাবেই লাভ করা সম্ভব নয়। সঙ্গত কারণে লোকসান একটু বেশি হলো না কম হলো তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মনে করা হয় লোকসান যেহেতু হচ্ছেই একটু বেশি হলেইবা ক্ষতি কি।
জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের পরিচালক আমজাদ হোসেন বলেন, সরকারের উচিত পিডিবিকে ব্যবসা করার জন্য একটি পরিষ্কার ব্যালান্সশীট দেয়া। এসব দেনা পিডিবির পক্ষে পরিশোধ করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। সঙ্গত কারণেই এই দেনা সম্পর্কে একটি বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
নিয়ম অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সময় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আর্থিক হিসাব বিবরণী পর্যালোচনা করে থাকে। এক্ষেত্রে রিইনভেস্টমেন্ট (পুনঃ বিনিয়োগ) না করে এত টাকা ফেলে রাখার বিষয়ে কখনও প্রশ্ন তোলা হয়নি। আবার এই বিপুল পরিমাণ সরকারী টাকায় কেন অন্য প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে সে বিষয়েও প্রশ্ন তোলেনি কমিশন।
জানতে চাইলে কমিশনের সদস্য (বিদ্যুত) মিজানুর রহমান বলেন, আমরা এসব বিষয় দেখি না এটা ঠিক নয়। কোন প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ না করে ব্যাংকে রেখে সেই অর্থের সুদ তুলে নেবে এটা আমরা আশা করি না। তিনি জানান, দাম বৃদ্ধির সময় সব শেষ অডিট রিপোর্ট দেখে আমরা দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেই। আর্থিক হিসাবে দেখা হয় না এই অভিযোগ সঠিক নয়।
বিদ্যুত বিভাগের অপর এক কর্মকর্তা জানান, পিডিবি এবং পিডিবির যেসব কোম্পানি রয়েছে তারা দেশের বাইরের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্প নির্মাণ করে। বলা হয় সাড়ে চার ভাগ সুদে এসব ঋণ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় সব কিছু মিলিয়ে ঋণের সুদের হার ৮ ভাগ অতিক্রম করে। নিজেদের টাকা বিনিয়োগ না করে অন্যের কাছে তিন ভাগ সুদে রেখে দেয়া হয়। অন্যদিকে আট ভাগ সুদে ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। একটি প্রতিষ্ঠান যারা সেবার পাশাপাশি ব্যবসাও করে তাদের এমন মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, এটা কোন ব্যবসায়িক নীতি হতে পারে না। তিনি বলেন বিপুল পরিমাণ অর্থ পিডিবিরই যেসব বিদ্যুত উৎপাদকারী কোম্পানি রয়েছে তাদেরও ঋণ দেয়া যেতে পারে।
জানতে চাইলে পিডিবির সদস্য (অর্থ) সেলিম আবেদ বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। আমার পরিকল্পনা হচ্ছে যেসব অলস অর্থ পড়ে আছে তা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করা। এক্ষেত্রে কেন এসব অর্থ রাখা হয়েছে প্রথমেই তা দেখা হবে। পরবর্তীতে কোন্ কোন্ উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করলে পিডিবি লাভবান হবে তা নির্ধারণ করা হবে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: