ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

॥ পর্ব- তিন ॥ ১৯৭১ সালের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যারা মুজিবনগর সরকারের সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম, তাদের জন্য জুলাই-আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত দুটো কর্মসূচী নানা কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কর্মসূচী দুটো ছিল দু’দিনব্যাপী সেক্টর কমান্ডারদের কমফারেন্স এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একটা ষড়যন্ত্রমূলক প্রহসনের বিচার প্রক্রিয়া ঘোষণার প্রতিবাদে কলকাতায় বিরাট জনসমাবেশ। সেক্টর কমান্ডারদের কনফারেন্সটি অনুষ্ঠিত হয় থিয়েটার রোড অফিসে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি, দায়িত্ব এবং ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতাম তাদের জন্য কনফারেন্সটির গুরুত্ব ছিল উল্লেখ করার মতো। তৎকালীন আওয়ামী লীগের এমএনএ এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এমএজি ওসমানীর নেতৃত্বে যেসব সার্ভিং এবং অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন তাদের জন্য প্রকৃতপক্ষে এটাই ছিল প্রথম সম্মিলিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন। এটাই ছিল সম্ভবত সেক্টর কমান্ডারদের যুদ্ধবিষয়ক কর্মপন্থা নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি প্রণয়ন। ছাইওয়ারে আমরা যারা কর্মরত ছিলাম তারাও নানাভাবে পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই কনফারেন্সে গৃহীত অগোপনীয় সিদ্ধান্তসমূহ কিভাবে কার্যকরীভাবে বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করা সম্ভব সেটা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে এবং নিজেদের মধ্যেও আলোচনা করে প্রস্তুতি নেয়া। এই কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করার কথা ছিল তৎকালীন সিএনসি কর্নেল ওসমানীর। কিন্তু তিনি কনফারেন্সে প্রথম দিন প্রথম সেশনে উপস্থিত না থাকার কারণে অনেকে প্রশ্ন তুললে কনফারেন্সের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জানান যে, কমান্ডারদের অনেকের কর্নেল ওসমানীর ওপর আস্থার অভাব থাকায় তিনি পদত্যাগ করেছেন। পরে অবশ্য কমান্ডারদের অনুরোধে কর্নেল ওসমানী তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করেন এবং দ্বিতীয় দিন কনফারেন্সে উপস্থিত হন এবং কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করেন। কমান্ডারদের মধ্যে সামান্য কিছু ভুল বোঝাবুঝি হলেও পরে যখন এটা কেটে যায় তখন কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়নে এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতিতেও আর কোন বাধা বা দ্বিমতের কোন সুযোগ নেই। দু’দিনব্যাপী এই সেক্টর কমান্ডারদের কনফারেন্সে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণে অর্থাৎ হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের নির্মূল করার অভিযান পরিচালনা বিষয়ে পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময়ের ফলে তারা যেমন আরও বেশি সক্রিয় ও শক্তিশালী হয়েছিলেন, তেমনিভাবে আমরা যারা ছাইওয়ারের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, তাদের অধিকাংশের সঙ্গেও আমাদের গড়ে ওঠে অনেকটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক। আমরাও বিভিন্ন সেক্টরের যুদ্ধ অগ্রগতি সম্পর্কে আরও সম্যকভাবে অবহিত হওয়ার সুযোগ পাই। ফলে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ করে বিভিন্ন সেক্টরের অধীন অঞ্চলসমূহে ব্যাপকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী কর্মতৎপরতার গৌরবময় কাহিনী ব্যাপকভাবে এবং সঠিকভাবে দেশে-বিদেশে তুলে ধরতে আমরা আরও বেশি সক্রিয় হতে সমর্থ হই। এতে অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও অনুপ্রাণিত হয়ে আরও বেশি সক্রি হয় হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের নির্মূল করার নতুন নতুন অভিযানে। সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলনের পরে সাহসিকতা যুদ্ধ নিপুণতা, নেতৃত্বের গুণাবলী এবং দৃষ্টান্তমূলক দেশপ্রেমের গুণাবলী প্রদর্শনের জন্য স্ব-স্ব চাকরিতে একটা প্রমোশন দেয়া হয় কয়েকজনকে এবং কয়েক মেজরকে পদোন্নতি দিয়ে লে. কর্নেল করা হয়। পরে অবশ্য লে. কর্নেল জিয়াউর রহমানকে লে. কর্নেল কেএম শফিউল্লাহকে এবং লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফকে নবগঠিত তিনটা ব্রিগেডের অধিনায়ক করা হয় এবং এই তিনটি ব্রিগেডের নামকরণ করা তাদের নামের প্রথম অক্ষর দ্বারা অর্থাৎ জেড ফোর্স, এস ফোর্স এবং কে ফোর্স। সেক্টর কমান্ডারদের সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ এবং কার্যকরী কনফারেন্স শেষ হওয়ার পর থেকেই ছাইওয়ারের তরফ থেকে আমরা বলার চেষ্টা করেছি যে, মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার সুশৃঙ্খলতাপূর্ণভাবে এবং শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি বজায় রেখে মুক্তিযুদ্ধের মতো গুরুদায়িত্বপূর্ণ কাজটি যেমন করে যাচ্ছে, তেমনি দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, বাংলাদেশ থেকে ভারতে আগত শরণার্থীদের দেখাশোনা করার মতো অন্য কাজগুলোও সুসম্পন্ন করে যাচ্ছে স্বাভাবিকভাবেই। এছাড়া সেক্টর কমান্ডারদের সুশৃঙ্খল নিয়ন্ত্রণে তারা যে পূর্বের তুলনায় আরও অনেক বেশি সংগঠিত এবং গেরিলা যুদ্ধে প্রতিনিয়তই অগ্রগতিও যথেষ্টভাবে। এদিকে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে কর্নেল ওসমানী ও তার সেক্টর কমান্ডারদের পূর্ণ সমর্থন এবং সহযোগিতা পাওয়ার আশ্বাসটা অর্জন করে পূর্বের চেয়ে আরও বেশি উদ্যোগে কাজ করতে শুরু করেন। এটা জেনে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্ব-স্ব এলাকায় হানাদার পাকবাহিনী ও স্থানীয় সহযোগীদের প্রতিহত করার যুদ্ধে লিপ্ত সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা আরও বেশি উজ্জীবিত হয়। কমান্ডার-ইন-চিফের জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম ও সেক্টর কমান্ডারদের কনফারেন্সের পরে পূর্বের চেয়ে আরও বেশি তৎপর হন তার দায়িত্ব পালনে সাংবাদিকদের আরও বেশি তথ্য সরবরাহ করার উদ্যোগ নেন তিনি। অন্যদিকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ তুলে পাকিস্তান সামরিক জান্তা কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচারিক কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ঘোষণা দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় মোটামুটিভাবে অধিকাংশ দেশে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীসহ ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, জাপান, যুগোশ্লাভিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশের নেতা-নেতাদের মধ্যে। পাকিস্তানের এই প্রহসনমূলক বিচার প্রক্রিয়াকে নিন্দা জানান তারা। একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বিশেষ করে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে এমনভাবে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করাটা মোটেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলে স্পষ্টভাবে পাকিস্তান সরকারকে জানিয়ে দেয় ভারত, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডার মতো অনেক দেশ। আমরা সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ারের তরফ থেকে প্রথম দিন থেকেই বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম, দেশের জনগণের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা দেশের সব রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জনগণের পাশে অংশগ্রহণের ইতিহাস, ছয় দফার আন্দোলনটা প্রকৃতপক্ষেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের আন্দোলন এবং সর্বোপরি ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন অনেক অধিক সংখ্যক ভোট পেয়ে তার নেতৃত্বে তার দল সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়েছে ইত্যাদি তথ্যাবলী সন্নিবেশিত করে ভারতীয়, ব্রিটেন, আমেরিকান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশের রেডিও, টিভি, খবরের কাগজ প্রভৃতি মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তবে সার্কাস এ্যাভিনিউতে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন ও আমাদের এই উদ্যোগকে সর্বতোভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছিল। এসব ব্যাপারে তৎকালীন ফার্স্ট সেক্রেটারি মি. করিম চৌধুরী বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে এ ব্যাপারে নয় অথবা দশ তারিখে আয়োজন করা হয়েছিল লাখ লাখ লোকের একটা বিরাট জনসমাবেশ। সম্ভবত এই সমাবেশ আয়োজনে কোকাকোলা বিল্ডিংয়ে অবস্থিত তৎকালীন আওয়ামী লীগ অফিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। জহির রায়হানসহ বাংলাদেশের আরও কয়েকজন প্রখ্যাত ব্যক্তি এই আয়োজনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং ওই সমাবেশে বক্তব্যও দিয়েছিলেন। আমাদের অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরাও তাদের স্ব-স্ব সেক্টর থেকে এসে এই সমাবেশে যোগদান করেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে এই সমাবেশে দেখা হয়েছিল আমার চারজন সহপাঠী বন্ধুর সঙ্গে, যারা পরবর্তীকালে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে জাতীয় ব্যক্তিত্বে পরিগণিত হয়েছিলেন। এরা হলেন তৌফিক এলাহী চৌধুরী হাফিজউদ্দিন আহম্মদ, মাহবুবউদ্দিন আহম্মদ এবং মাহমুদুর রহমান বেনু। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্য নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলাম তাদের জন্য পাক সামরিক সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ তুলে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানোর জঘন্য প্রচেষ্টার নিন্দা জানানোর অভিযানে বিদেশের মাটিতে শরিক হওয়াটা ছিল এক বিরাট তৃপ্তি ও সন্তুষ্টি। তবে আমরা সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার থেকে পাক সামরিক সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এই হত্যা প্রচেষ্টার শুরু থেকেই যে কথাটা ব্যাপকভাবে প্রচারে উদ্যোগ নিয়েছিলাম তা হলো বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান যেভাবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাঁকে পাকিস্তানের শীর্ষতম জনপ্রিয় নেতায় রূপান্তরিত করেছিলেন এবং বাধ্য হয়েছিলেন বীরবেশে তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতেÑ একইভাবে তাঁর বিরুদ্ধে এই দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে এবং তৎকালীন বিশ্বের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অন্যতম একজন হিসেবে সসম্মানে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে। আর সত্যিকারভাবে ঘটেছিলও তাই। লেখক : মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী
×