ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ আবদুল হাই

অভিমত ॥ ‘যে রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন তৈরি করা হয়েছে, ওই আইন অসম্পূর্ণ আইন’

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

অভিমত ॥ ‘যে রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন তৈরি করা হয়েছে, ওই আইন অসম্পূর্ণ আইন’

কথাটি আমার নয়, স্বনামধন্য কলামিস্ট স্বদেশ রায় তাঁর ‘তরুণ প্রজন্মের সামনে দ্বিতীয় অধ্যায়-স্বাধীনতাবিরোধীদের আশ্রয়দাতাদেরও রুখতে হবে’ নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন। আমি অধিকাংশ লেখায় বলার চেষ্টা করেছি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আইনী সুরক্ষা ছাড়া স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির থাবা থেকে রক্ষা করা কঠিন। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ধর্মের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী জাতিকে পাকিস্তানীদের শোষণ নিষ্পেষণ থেকে মুক্ত করার জন্য। ৫ লাখের বেশি মা-বোনের ইজ্জত গেল ৩০ লাখ মানুষ রক্ত দিল যে স্বাধীনতার জন্য, তা কি কেবল পাকিস্তানীদের তাড়িয়ে তাদের জায়গায় নব্য শাসকশ্রেণী ঘাড়ের ওপর বসিয়ে দেয়ার জন্য? সংবিধানের মূল যে চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর কেন জিয়াউর রহমানের মন্ত্রদাতারা ঝাঁপিয়ে পড়ে ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ক্ষমতা দখলের ঊষালগ্নেই? তাদের মূল লক্ষ্য ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে আবার মুসলিম বাংলায় নিয়ে যাওয়া। বাঙালী জাতীয়তাবাদ রেখে ও তা সম্ভব না, তাই তাদের প্রথম টার্গেট হয় সংবিধানের এ দুটি স্তম্ভ। ১৫ আগস্ট পরবর্তী কঠিন সময়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা যখন নীরবে নিভৃতে সংগঠিত হতে থাকি উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আবার দেশকে ফিরিয়ে নেয়া। জিয়াউর রহমানের পর জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা জবর দখল করে জিয়াউর রহমানের পথেই হাঁটতে থাকেন; উপরন্তু আরেক ধাপ এগিয়ে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে জুড়ে দিয়ে ষোলোকলা পূর্ণ করেন। খন্দকার মুশতাককে সঙ্গে নিয়ে জিয়াউর রহমান সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম যোগ করে পাকিস্তানীকরণের পথে যে যাত্রা শুরু করেন জেনারেল এরশাদ মৌলানা মান্নান গংদের নিয়ে তাতে গতি সঞ্চার করেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির অংশগ্রহণ ছিল যদি কোন কারণে এরশাদকে সরে যেতে হয় তাহলে প্রবর্তিত দেশ পরিচালনার ধারা যাতে পরিবর্তন না হয় তা দেখভাল করা। জিয়াউর রহমানের যারা মন্ত্রণাদাতা এরশাদের মন্ত্রণাদাতা ও একই গোষ্ঠী; ব্যক্তির কিছু কিছু পরিবর্তন ছিল লোক দেখানো। ’৯১-এ এরশাদের পতনের পর রাজনীতিতে যে পরিবর্তন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কাক্সিক্ষত ছিল তা ঘটেনি। জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী; রাজনীতির সঙ্গে যার কোন সম্পর্ক ছিল না তাকে রাজনীতিতে যারা নিয়ে আসেন তাদের সুদূরপ্রসারিত পরিকল্পনা ছিল। ’৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত যে ধারায় দেশ পরিচালিত হয় তা বহাল রাখার জন্য থিংক ট্যাংকের প্রয়োজন ছিল বেগম খালেদা জিয়ার মতো একজন অনভিজ্ঞ অহমিকাপূর্ণ ক্ষমতালোভী সুদর্শন মহিলার। ক্ষমতার মসনদে বসিয়ে তাকে দিয়ে তাদের সৃষ্ট ধারা বহাল রাখার জন্য এরকম একজন মহিলাই তাদের দরকার ছিল। ’৯১ এ এরশাদের পতন যখন অনিবার্য তখন মূল চালটি চালা হয় আজীবন রাজনীতিবিমুখ একজন প্রধান বিচারপতিকে এরশাদের স্থলাভিষিক্ত করা। যাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তাদের সমগোত্রীয়কে চেয়ারে বসিয়ে কিভাবে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট লুট করা সংবিধান ফিরিয়ে আনা সম্ভব তা আন্দোলন এর নেতারা কেন বুঝতে পারলেন না? যা হবার তাই হলো, আমরা নির্বাচনে হেরে গেলাম। এরশাদের চেয়ারে বসলেন বেগম খালেদা জিয়া দাড়িকমাসহ এরশাদের সব ক্ষমতা নিয়ে; ৫ম-৭ম সব সংশোধনীসহ জিয়া-এরশাদের করা সব অধ্যাদেশ বহাল রেখে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনাত হলোই না উল্টো রাষ্ট্রধর্ম ইসলামসহ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সবই আমরা মেনে নিলাম। অনেক জল গড়িয়ে গেল। মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকার ২০০৭-০৮ এ আমাদেরকে উপহার দিয়ে গেল রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধি জিয়াউর রহমানের আদলে। তখনও আওয়ামী লীগকে বাধ্য করা হয়েছিল দলের গঠনতন্ত্র থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বাদ দিয়ে দল নিবন্ধন নিতে। আর মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকার জামায়াতে ইসলামের মতো স্বাধীনতাবিরোধী দলকে নিবন্ধন দিয়ে গেল আমাদের হাত দিয়ে। এখন কথা হলো, ২০০৮-এর নির্বাচনে যখন ধনংড়ষঁঃব সধলড়ৎরঃু নিয়ে ক্ষমতায় এলো; মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের করা অধ্যাদেশগুলো যখন সংসদে অনুমোদনের জন্য পেশ করা হলো তখন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইনে কেন যোগ করা হল না জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; বাঙালী জাতীয়তাবাদ; স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দলের গঠনতন্ত্রে আনুগত্যের ঘোষণা থাকতে হবে নচেৎ নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে; নতুন দল নিবন্ধন দেয়া হবে না। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ রাজনৈতিক দল থাকবে তা কি কল্পনা করা যায়? রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে কোন দণ্ডিত ব্যক্তি থাকতে পারবে না এটিও আইনে এখনই সংযোজন করা দরকার। না হয় রাজনীতি কলুষিত হবে দণ্ডিত ব্যক্তিদের নেতৃত্বে, যার প্রভাব পড়বে গোটা রাজনীতির ওপর। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থেকেও কেন মূল আদর্শগুলোকে আইনী সুরক্ষা দিতে পারে না তা বুঝা মুশকিল। লেখক : সাবেক যুগ্মসচিব
×