ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পুরস্কারের বদলে তিরস্কার ;###;পেলেন ওসি

বরিশালের মাদকসেবীদের কাছে জন্মদাতার চেয়েও প্রিয় ‘বাবা’!

প্রকাশিত: ০৮:২০, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বরিশালের মাদকসেবীদের কাছে জন্মদাতার চেয়েও প্রিয় ‘বাবা’!

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ নগরীসহ জেলার দশ উপজেলা ও ছয় পৌরসভার প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ড, ৮৬টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটি অলিগলিতে এখন ‘বাবা’র একক আধিপত্য। বরিশালের ছোট থেকে বড়, তরুণ ও বৃদ্ধ সকলের কাছেই ‘বাবা’ নামটি বিশেষভাবে পরিচিত। এ অঞ্চলের মাদকসেবীদের কাছে তাদের জন্মদাতা ‘বাবা’র চেয়ে এই বিশেষ ‘বাবা’র প্রতিই যেন ভক্তি শ্রদ্ধা বেশি লক্ষ্য করা গেছে। দিনে একবার হলেও তাদের অবশ্যই বাবার সান্নিধ্য চাই-ই-চাই। আর তা না হলে নাকি মাদকসেবীদের দিন শুরু কিংবা রাত শেষ হয় না। এ ভয়ঙ্কর ‘বাবার’ আসল নাম ইয়াবা। অন্য যেকোন মাদকদ্রব্যের তুলনায় বরিশালে ইয়াবার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। বরিশালে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় মরন নেশা ইয়াবা। ফেন্সিডিল, হেরোইন, মদ, বিয়ার, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকের বিস্তার থাকলেও ইয়াবার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে গোটা বরিশাল। প্রাণঘাতী ইয়াবায় সয়লাব হয়ে গেছে গোটা জেলা। সমাজের বিভিন্ন-শ্রেণীর লোকজন এমনকি নারীদেরও অনেকে এ নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। কখনও ম্যানেজ করে আবার কখনও নানা কৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন স্থানে একপ্রকার প্রকাশ্যেই চলছে ইয়াবার রমরমা বাণিজ্য। জেলার সহস্রাধিক যুবক ভ্রাম্যমাণ ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, একটি চক্র বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ইয়াবা ছড়িয়ে দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এ ব্যবসার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের অনেকেই জড়িত রয়েছে। কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের রয়েছে সুসম্পর্ক। মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত জেনেও পুলিশ তাদের গ্রেফতার করছেন না। উভয়পক্ষ মিলেমিশে মাদকের ব্যবসা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স পরিচয়ধারীরা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলেও সূত্রগুলো দাবি করেছেন। ফলে ইয়াবার ভয়াবহ থাবায় যুব সমাজ আজ ক্ষতবিক্ষত। ভবিষ্যত প্রজন্মকে নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পরেছেন তাদের অভিভাবকরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদক ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ব্যবসা এবং পেশার আড়ালে দেদারসে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ওই চক্রটি নারীদের ইয়াবা ব্যবসার টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে। ইয়াবা ট্যাবলেট পকেটে করে নির্বিঘেœ বহন করা যায় বিধায় ভ্রাম্যমাণ মাদক বিক্রেতার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। এতে বিভিন্ন আবাসিক এলাকার অলিগলি ইয়াবা ট্যাবলেটে সয়লাব হয়ে গেছে। নেশাগ্রস্ত যুবকরা ছিনতাই, রাহাজানি, চুরি, ডাকাতিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পরছে। ইয়াবা ক্রয়ের টাকা জোগার করতে গিয়ে অনেক উঠতি বয়সের তরুণ-যুবকরা বেছে নিয়েছে অপরাধের পথ। আর এ কারণেই পরিবারে নেমে এসেছে চরম অশান্তি। পড়াশোনা বাদ দিয়ে তরুণরা ইয়াবাসক্ত হয়ে পড়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পরেছে অভিভাবক মহল। ইয়াবা বিক্রেতা কলেজ ছাত্রীসহ চার তরুণী আটক ॥ ইয়াবা নেশায় আসক্ত হয়ে খরচ বহন করতে স্কুল-কলেজের কতিপয় ছাত্রীরা বেছে নিয়েছে মাদক ব্যবসার পথ। কলেজ ছাত্রীসহ এমনই চার তরুণীকে গত ৩০ জানুয়ারি মধ্যরাতে আটক করেছে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৩০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নগরীর অমৃত লাল দে সড়ক (হাসপাতাল) রোডের অষ্টকোনা মন্দির সংলগ্ন ‘মায়া কানন’ বাড়ি থেকে নগরীর কাশিপুর স্কুল এ্যান্ড কলেজের ছাত্রী এবং ইছাকাঠি এলাকার বাসিন্দা হানিফ চৌধুরীর কন্যা হাদিয়া চৌধুরী মুনা (১৯), কলেজ এভিনিউ লেচুশাহ সড়কের বাসিন্দা দুলাল বাড়ৈর কন্যা বৃষ্টি বাড়ৈ (২২), নলছিটি উপজেলার বাসিন্দা আব্দুল জলিল হাওলাদারের কন্যা নুসরাত জাহান নিশাত (২২) ও একই উপজেলার বাসিন্দা জামাল হোসেনের কন্যা ইসরাত জাহান ইভাকে (২২) আটক করেছে পুলিশ। কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই আরাফাত হাসান জানান, আটককৃতরা মাদকাসক্ত ছাড়াও তারা ইয়াবা বিক্রির সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে জানিয়েছেন। বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসক ডাঃ দাস রনবীর বলেন, ইয়াবা সেবনের ফলে তরুণদের স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে। এ ট্যাবলেট সাময়িক আনন্দ ও উত্তেজনা তৈরি করলেও ধীরে ধীরে আসক্ত ব্যক্তি নানা শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়। এতে হুমকির মুখে পরছে আগামী প্রজন্ম। পরিবার উদ্যোগী হয়ে সঠিক কাউন্সিলিং ও চিকিৎসা করানো হলে ইয়াবা আসক্ত ব্যক্তিকে সুস্থ জীবনে ফেরানো সম্ভব। ইয়াবার ভয়াবহতা স্বীকার করে জেলা পুলিশ সুপার মোঃ সাইফুল ইসলাম বিপিএম বলেন, ইয়াবার প্রকোপরোধে পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইয়াবা একটি মরণঘাতী ব্যাধির মতো সমাজে ছড়িয়ে পরছে। তবে এটি নির্মূলে সবাইকে সচেতন হতে হবে। তিনি আরও বলেন, প্রায় প্রতিদিনই পুলিশ অভিযান চালিয়ে চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মাদকসহ গ্রেফতার করছে। ইয়াবা নির্মূলে পুলিশের কঠোর অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। মাদক নির্মূলে সফলতা অর্জনকারী ওসি পুরস্কারের বদলে পেলেন তিরস্কার ॥ দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ ইয়াবা ডিলার মানিক মাঝির বাড়ি জেলার গৌরনদী উপজেলার কটকস্থল গ্রামে। বরাবরেই থানার বড়কর্তাকে নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়ে মহাদাপটের সঙ্গে ইয়াবার রমরমা ব্যবসা করে আসছিল মানিক মাঝি। এরই মধ্যে গত বছরের ২৯ মার্চ রাতে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ জেলা ডিবি পুলিশ মানিক মাঝির ভাই হিরা মাঝিকে তার দুই সহযোগীসহ গ্রেফতার করে। পুলিশের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, হিরা মাঝি ও তার সহযোগীরা তৎকালীন গৌরনদী মডেল থানার ওসি আলাউদ্দিন মিলনকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে দীর্ঘদিন যাবত এলাকায় একচেটিয়া মাদক ব্যবসা করে আসছিল। ৩০ মার্চ সকালে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে মাদক ব্যবসায়ী হিরা মাঝি ও তার সহযোগীরা স্বীকারোক্তি প্রদান করে। এ অভিযোগের ভিত্তিতে তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপার মোঃ আক্তারুজ্জামান তাৎক্ষণিক ওসি মিলনকে প্রত্যাহার করে নেন। পরবর্তীতে গৌরনদীকে মাদকমুক্ত করার প্রত্যয়ে ওই বছরের ২ এপ্রিল গৌরনদী মডেল থানায় নতুন ওসি হিসেবে যোগদান করেন ফিরোজ কবির। সূত্র মতে, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর কঠোর নির্দেশে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ওসি ফিরোজ কবির মাদক বিরোধী সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করেন। এক মাসেই তিনি (ফিরোজ কবির) দক্ষিণাঞ্চলের প্রভাবশালী ইয়াবা ডিলার মানিক মাঝিসহ ১২৮ জন মাদক বিক্রেতা ও সেবীকে গ্রেফতারের পাশাপাশি উদ্ধার করেন বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। আর এ ঘটনায় ৮২টি মামলা দায়েরের পর ৯৮ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- এবং ৩০ জনকে নিয়মিত মামলায় জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়। মাদকের স্বর্গরাজ্য হিসেবে খ্যাত গৌরনদী উপজেলায় মাদকের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে মাত্র চার মাসের ব্যবধানে শতকরা আশিভাগ সফলতা অর্জনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখায় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে ওসি ফিরোজ কবিরকে ‘মাদার তেরেসা’ স্বর্ণ পদক দেয়া হয়। এরই মধ্যে রহস্যজনক কারণে কোন কারণ ছাড়াই চার মাসের মধ্যেই ওসি ফিরোজ কবিরকে গৌরনদী মডেল থানা থেকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে কারাগারে থাকা মাদক বিক্রেতারা জামিনে বেরিয়ে ফের মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে গোটা গৌরনদী। বর্তমানে ওসি শূন্য রয়েছে গৌরনদী মডেল থানা। এখানকার সচেতন অভিভাবকদের মতে, বরিশাল রেঞ্জের বর্তমান ডিআইজি ও জেলা পুলিশ সুপার যেখানে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন সেখানে মাদকের বিরুদ্ধে একমাত্র সফলতা অর্জনকারী ওসি ফিরোজ কবিরকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুরস্কার না দিয়ে একপ্রকার তিরস্কার করে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সচেতন গৌরনদীবাসী মাদক নির্মূলে ওসি ফিরোজ কবিরকে পুনরায় গৌরনদী থানায় পোস্টিং দেয়ার জন্য বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলা পুলিশ সুপারের কাছে জোর অনুরোধ করেছেন।
×