ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উগ্র বৌদ্ধদের অস্ত্রে নিহত দু’জন ॥ বাকিদের ওপর গুলি চালায় সৈন্যরা

গণকবরের ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয় যেভাবে-

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

 গণকবরের ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয় যেভাবে-

উগ্র বৌদ্ধ প্রতিবেশীদের হাতে কবর খোঁড়ার দৃশ্য দেখার অল্প সময় পরই সেই কবরে একসঙ্গেই ঠাঁই হয় ১০ রোহিঙ্গার। তাদের দুজন খুন হয় উগ্র বৌদ্ধ গ্রামবাসীদের ধারাল অস্ত্রে, বাকিদের ওপর গুলি চালায় সৈন্যরা। রয়টার্স লিখেছে, এই অনুসন্ধানে প্রথমবারের মতো উগ্র বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে, মুসলমানদের হত্যা করে লাশ পুঁতে ফেলার কথা স্বীকার করেছে। কেবল উগ্রপন্থী বৌদ্ধরাই নন, বরং ইন দিনে ১০ রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞে দেশটির সেনা ও আধাসামরিক পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও যে জড়িত ছিলেন, তার প্রমাণ মিলেছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ভাষ্যেও।- খবর ওয়েবসাইট বয়োজ্যেষ্ঠ এক বৌদ্ধ গ্রামবাসী রয়টার্সকে তিনটি আলোকচিত্র দিয়েছেন, যাতে ১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সৈন্যদের হাতে ধরা পড়া থেকে শুরু করে পরদিন সকাল ১০টায় তাদের হত্যাকা- পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য মুহূতের ছবিও আছে। এ তদন্তের সূত্র ধরেই মিয়ানমারের পুলিশ বার্তা সংস্থাটির দুই প্রতিবেদক ওয়া লোন এবং কিয়াও সোয়ে ও’কে রাখাইন সংশ্লিষ্ট গোপন নথি হাতানোর অভিযোগে গত ১২ ডিসেম্বর গ্রেফতার করে। এর মাসখানেক পর ১০ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে ইন দিনে ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যার খবর নিশ্চিত করা হয়। যদিও সেনাবাহিনীর ভাষ্যের সঙ্গে তদন্তে উঠে আসা তথ্য এবং রাখাইনের প্রত্যক্ষদর্শী মুসলিম ও বৌদ্ধদের কথায় গরমিল পাওয়া গেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বলছে, যে ১০ রোহিঙ্গা হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে তারা ‘২০০ সন্ত্রাসীর’ অংশ, যারা নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছিল। অন্যদিকে বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা বলছেন, ইন দিনে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বিদ্রোহীদের আক্রমণের কোন ঘটনাই ঘটেনি। উল্টো সেনারাই কাছাকাছি একটি সমুদ্রসৈকতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে ১০জনকে তুলে নিয়ে হত্যা করে বলে দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের। পরিস্থিতির শুরু গত বছরের ২৫ আগস্টে, যেদিন রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা উত্তর রাখাইনের ৩০টি পুলিশ ফাঁড়ি ও সেনা ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। নিরাপত্তার ভয়ে তখনই ইন দিনের কয়েক শ’ বৌদ্ধ গ্রামবাসী কাছাকাছি একটি মঠে আশ্রয় নেয়। ২৭ আগস্ট মিয়ানমারের তেত্রিশ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের প্রায় ৮০ সেনা গ্রামটির দখল নেয়। ওই ডিভিশনের প্রধান বৌদ্ধ গ্রামবাসীদের নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অংশ নেয়ার আহ্বান করেন বলে ইন দিনের পাঁচ বৌদ্ধ পরে রয়টার্সকে জানান। সেনাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেশ ক’জন স্বেচ্ছাসেবী হন, যাদের মধ্যে বৌদ্ধ ‘নিরাপত্তা দলের’ সদস্যরাও ছিলেন। পরের কয়েকদিন ওই স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে সেনা ও পুলিশ সদস্যরা ইন দিনের রোহিঙ্গা মুসলমানদের বেশিরভাগ বাড়িই পুড়িয়ে দেয় বলে বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা জানায়। এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ওই সময়ে তিনি তার কমান্ডারের কাছ থেকে ‘যাও এবং পরিষ্কার কর’ এমন মৌখিক নির্দেশ পান; রোহিঙ্গাদের পুড়িয়ে দিতেই কর্মকর্তা এ নির্দেশ দিয়েছিলেন বলেও মনে করেন তিনি। দ্বিতীয় আরেক পুলিশ কর্মকর্তা ইন দিনের উত্তরের গ্রামগুলোতে এ ধরনের বেশ কয়েকটি অভিযানে অংশ নেয়ার কথা জানান। সে সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বেসামরিকদের মতো শার্ট ও শর্টস পরে গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন বলেও ওই কর্মকর্তা এবং ইন দিনের বৌদ্ধ প্রশাসক মং থেইন চায়ে নিশ্চিত করেছেন। রোহিঙ্গারা ইন দিন থেকে পালিয়ে গেলে বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা তাদের মুরগি ও ছাগল লুট করে নেয়। সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র যেমন মোটরসাইকেল ও গরু লুট করে সেগুলো এইটথ সিকিউরিটি পুলিশ ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার নিজের কাছে রাখেন এবং পরে বিক্রি করে দেন বলে জানান গ্রাম প্রশাসক ও পুলিশ কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে জানতে চেয়ে ওই ব্যাটালিয়নের কমান্ডার থান্ট জিন ও’কে ফোন করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করেননি। পুলিশের মুখপাত্র কর্নেল মায়ো থু সোয়ে জানান, পুলিশ লুটের অভিযোগ তদন্ত করবে। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দিতে সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক পুলিশ ইন দিন ও কাছের আরও দুটি গ্রামের বৌদ্ধদের সংগঠিত করে বলে বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা নিশ্চিত করেছেন। আধাসামরিক পুলিশের তিন কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক রাজধানী সিটুই-র গোয়েন্দা বিভাগের এক পুলিশ কর্মকর্তা ইন দিনের রোহিঙ্গা পল্লী ‘নিশ্চিহ্ন’ করার আদেশ সেনাবাহিনীর ওপর মহল থেকে নিচের দিকে এসেছিল বলে জানিয়েছেন। ইন দিনের বৌদ্ধ প্রশাসক ও আধাসামরিক এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, আধাসামরিক পুলিশের কিছু সদস্য রোহিঙ্গাদের গরু ও মোটরসাইকেল লুট করে পরে সেগুলো বিক্রি করেন। সেপ্টেম্বরের ১ তারিখের মধ্যে কয়েক শ’ রোহিঙ্গা নিকটবর্তী সমুদ্রসৈকতে আশ্রয় নেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, যাদের মধ্যে পরে হত্যাকা-ের শিকার ১০জনও ছিলেন। হত্যার শিকার এ রোহিঙ্গাদের পাঁচজন ছিলেন জেলে ও মাছ বিক্রেতা। বাকিদের মধ্যে দুজন দোকানি, দুজন ছাত্র এবং একজন ধর্ম শিক্ষক। রোহিঙ্গা প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ইসলাম ধর্ম শিক্ষক আবদুল মালিক আশ্রয়স্থলের জন্য খাবার ও বাঁশ যোগাড়ে নিজের পল্লীতে গিয়েছিলেন। যখন তিনি সেখান থেকে সমুদ্রসৈকতে ফিরে আসছেন, তখনই অন্তত সাত সেনা ও সশস্ত্র বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা তাকে ধাওয়া করে। এরপর সমুদ্রসৈকতে এসে এখান থেকে ১০ রোহিঙ্গাকে তুলে নিয়ে চলে যায়। রয়টার্সের হাতে আসা এক আলোকচিত্রে ওইদিন সন্ধ্যায় গ্রামের পথে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা ওই ১০ রোহিঙ্গাকে দেখা যায়। সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে তাদের কবরস্থানের কাছাকাছি একটি সবজি ক্ষেতে নিয়ে যাওয়া হয় বলে গ্রামবাসীরা জানান, সেখানে ফের তাদের ছবি তোলা হয়। নিরাপত্তা রক্ষীরা ওই ১০জনকে ইন দিনের নিখোঁজ বৌদ্ধ কৃষক মাউং নি-র বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন বলে রাখাইনের এক বৃদ্ধ জানান। পরে রাখাইনের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও রাখাইন গ্রামবাসীরা বলেন, মাউং নি-র নিখোঁজের সঙ্গে এ ১০জনের কারও কোন রকম সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ আছে বলে তারা জানেন না। এরপর আটক ১০জনকে সেনারা হত্যার জন্য নিয়ে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শী তিন বৌদ্ধ গ্রামবাসী জানান। গোরখোদকদের একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক সোয়ে চায়ে বলেন, ধরা পড়া ব্যক্তিদের ওপর প্রথম আঘাত হানতে সেনাদলের প্রধান মাউং নি-র সন্তানদের আমন্ত্রণ জানান। জ্যেষ্ঠ সন্তান ধর্ম শিক্ষক আবদুল মালিকের মাথা আলাদা করে ফেলে বলেও জানান সোয়ে। দ্বিতীয় সন্তান আরেকজনের ঘাড়ে কোপ মারেন। রাখাইনের বয়স্ক এক নাগরিক রয়টার্সের প্রতিবেদককে হত্যাকা-ের পরের একটি ছবি সরবরাহ করেন। কেন তিনি তথ্য সরবরাহের জন্য রয়টার্সকে বেছে নিলেন? উত্তরে বলেন, ‘এ ঘটনার বিষয়ে আমি স্বচ্ছ থাকতে চাই। ভবিষ্যতে কখনই এ রকম কিছু ঘটুক, তা চাই না আমি।’
×