ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৮৭ ভাগ পরিবহনের বাড়তি অর্থ আদায়

নয় মাসেও চূড়ান্ত হয়নি সিটিং সার্ভিস নীতিমালা

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

নয় মাসেও চূড়ান্ত হয়নি সিটিং সার্ভিস নীতিমালা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ নয় মাসেও চূড়ান্ত হয়নি সিটিং সার্ভিস নীতিমালা। কবে চূড়ান্ত হবে তাও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। ইতোমধ্যে নীতিমালা ঘোষণার জন্য অন্তত তিনবার সময় নেয়া হয়। তবুও সেই মাহেন্দ্রক্ষণের দেখা নেই! এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে যাত্রীদের পকেট কাটছে পরিবহন কোম্পানিগুলো। রাতারাতি লোকাল বাস হচ্ছে সিটিং। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণপরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য এড়াতে দ্রুত সময়ের মধ্যে এ ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরী। অন্যথায় অরাজকতা কমবে না। অন্যদিকে যাত্রী অধিকার সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলছেন, যাত্রীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে সিটিং সার্ভিসের বৈধতা দেয়া উচিত। সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের ৪১তম সভা শেষে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, রাজধানীতে চলাচলরত সিটিং সার্ভিসের বিষয়ে ?আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে। এরপর এ নিয়ে আর কোন জটিলতা থাকবে না। মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরও কেটেছে আরও অন্তত তিন মাসের বেশি। তাহলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা কোথায়? বিআরটিএ ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভাড়া নির্ধারণ, কোম্পানি গঠন, বিশেষ রং, মালিক সমিতির মতামতসহ নানা ইস্যুতে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। আবার একটি পক্ষ অবৈধ সিটিং সার্ভিসের বৈধতা দিতে আপত্তি জানাচ্ছে। সব মিলিয়ে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে সিটিং সার্ভিস নীতিমালা ঘোষণার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তারা। গত বছরের মে মাসের শুরুতে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পর রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু এ নিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের অসন্তোষ ও কর্মবিরতির প্রেক্ষিতে সিটিং সার্ভিসের নামে চলাচলকারী পরিবহনগুলোকে আরও তিন মাস সময় দেয়া হয়। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ৮ সদস্য বিশিষ্ট সুপারিশ কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। জনস্বার্থে সিটিং সার্ভিস বহাল রাখা যাবে, নাকি বন্ধ করা হবে এসব বিষয় খতিয়ে দেখে আগামী তিন মাসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। কমিটির প্রধান করা হয় বিআরটিএ’র রোড সেফটি বিভাগের পরিচালক শেখ মোঃ মাহবুব-ই রব্বানীকে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন- ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান, শ্রমিক নেতা শাহজাহান বাবুল, ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রতিনিধি, বিআরএটিএ ঢাকা বিভাগের পরিচালকসহ আরও বেশ কয়েকজন। গত ১৫ অক্টোবর এ কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে ২৬ দফা পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে কমিটি। এসবের মধ্যে রয়েছে- সিটিং বাসের রং হবে লোকালের চেয়ে ভিন্ন, স্টপেজ সংখ্যা হবে লোকালের চেয়ে কম, কোন রুটে কত সংখ্যক ‘সিটিং বাস’ চলবে তা নির্ধারণ করবে সরকার, অনুমতি ছাড়া লোকাল বাসকে সিটিংয়ে“রূপান্তর করা যাবে না, সিটিং বাসে দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করা যাবে না ইত্যাদি। এসব পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশের ভিত্তিতে এক সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে বলে জানান সেতুমন্ত্রী। সরেজমিন দেখা গেছে, সিটিং সার্ভিসের নামে বাড়তি ভাড়া নেয়া হলেও যাত্রীসেবার মান বাড়েনি। বেশিরভাগ সিটিং সার্ভিস বাসে ফ্যানের কোন ব্যবস্থা নেই। এক সিটের চেয়ে অন্য সিটের দূরত্ব কম। থামানো হয় সবখানেই। জানালা ও আসন ভাঙ্গাচোরা। তেমনি যাত্রীও তোলা হয় যেখানে সেখানে। ছারপোকার দৌরাত্ম্য। লক্কড়-ঝক্কড় বাস। ইঞ্জিনের ওপর বসানো হয় যাত্রী। সব মিলিয়ে মানসম্মত গণপরিবহন একেবারেই নেই বললেই চলে। অথচ সিটিং সার্ভিসের কোন বৈধতা নেই। ইচ্ছেমতো ভাড়া নির্ধারণ করে যাত্রীদের পকেট কাটা হচ্ছে দিনের পর দিন। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতারাতি সাধারণ বাসগুলো সিটিং সার্ভিস হিসেবে চালানো হচ্ছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, সিটিং সার্ভিসের নামে রাজধানীতে ৮৭ ভাগ পরিবহন যাত্রীদের থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করছে। জানতে চাইলে বিআরটিএ সচিব শওকত আলী জনকণ্ঠ’কে বলেন, আমরা পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অভিযান চলমান রয়েছে। কেউ বাড়তি ভাড়া আদায় করলে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান তিনি। জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জনকণ্ঠ’কে বলেন, আমরা চেয়েছিলাম সিটিং সার্ভিস না চলুক। কিন্তু পরিস্থিতি উল্টো হয়েছে। তিনি বলেন, কোন পরিবহন কোম্পানি যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নেয়ার কথা নয়। কেউ যদি বাড়তি ভাড়া আদায় করে তাহলে কোম্পানি সংশ্লিষ্টদের সমিতির পক্ষ থেকে সতর্ক করা হবে। তাছাড়া এ বিষয়ে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, রুট পারমিটে সিটিং সার্ভিস বলতে কিছু নেই। সিটিং সার্ভিস হিসেবে বিআরটিএ কোন বাস অনুমোদন দেয় না। তবুও অনেকে সিটিং হিসেবে গাড়ি চালাচ্ছেন। এটা ঠিক নয়। এ কারণে বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগও আসছে। সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৬ সালের ১ অক্টোবর থেকে রাজধানীতে বাসের ভাড়া প্রতি কিলেমিটারে ১০ পয়সা বাড়িয়ে এক টাকা ৭০ পয়সা করা হয়। মিনিবাসের ভাড়াও ১০ পয়সা বেড়ে এক টাকা ৬০ পয়সা হয়েছে। সে হিসেবে ১০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করলে বাসগুলোতে মাত্র এক টাকা বেশি ভাড়া নেয়ার কথা। কিন্তু এই পরিমাণ দূরত্বে ঢাকার বিভিন্ন রুটের পরিবহনগুলোকে নতুন ভাড়া কার্যকরের অজুহাতে দুই টাকা থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। এছাড়া ‘লোকাল’ বাসগুলো আগে যেখানে পাঁচ টাকা ভাড়া নিত এখন সেখানে ছয় টাকা নিচ্ছে। আবার আগের ৭/৮ টাকার ভাড়া নিচ্ছে ১০ টাকা হারে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস চালানোর কোন বৈধতা নেই। কারণ গাড়ির আসন বিবেচনা করে বিআরটিএ থেকে ভাড়া নির্ধারণ করা আছে। এই হিসেবে কোন পরিবহনেই দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলার কথা নয়। কিন্তু একদিকে বাস কোম্পানিগুলো দাঁড়িয়ে যাত্রী নিচ্ছে অন্যদিকে সিটিংয়ের নামে বাড়তি ভাড়াও নিচ্ছে। এখন প্রকাশ্যে স্টিকার লাগিয়ে সিটিং সার্ভিস চলছে। এসব বাস কোম্পানিকে সহজেই চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব বলে মত দেন তিনি। পাশাপাশি সিটিং সার্ভিসের বৈধতা দিলে যাত্রীদের ভাড়ার বিষয়টি বিবেচনা করারও দাবি জানান এই নেতা।
×