ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিজের সৃষ্ট সঙ্কটে বিএনপি - মুহম্মদ শফিকুর রহমান

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

নিজের সৃষ্ট সঙ্কটে বিএনপি - মুহম্মদ শফিকুর রহমান

জিয়া অরফানেজ দুর্নীতি মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং ছেলে তারেক রহমানসহ অপর ৫ জনের ১০ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড দেয় আদালত। সঙ্গে সঙ্গে খালেদা জিয়াকে কারাগারে প্রেরণও করা হয়েছে। এই পরিস্থিতি বিএনপির রাজনীতির জন্য মহাসঙ্কট বলা যায়, যা তারা নিজেরাই সৃষ্টি করেছে। সহজেই বলা যাবে বিএনপির পক্ষে এই সঙ্কট মোকাবেলা করা সহসা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। আইনী সঙ্কট তারা আইনীভাবে মোকাবেলা করবে নিশ্চিয়ই; কিন্তু এই রায়ের মাধ্যমে বিএনপির যে সাংগঠনিক রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হলো তা মোকাবেলা করার ক্ষমতা কি বিএনপি নেতৃত্বের আছে? দলের প্রভাবশালী আইনজীবী নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আইনের যে ব্যাখাই দিন না কেন তিনি নিজেই তো গুলশানে দখল করা বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তাও আদালতের রায়ে। তারপর থেকে মওদুদ সাহেব আর সে ব্যাপারে কোন টু শব্দ করেননি। মওদুদ সাহেবকে মানুষ মনে করে ঢাকার ফুটবল মাঠের রাজা মিয়া, তার পায়ে বল গেলে দু’দিকের গোলকিপারই তটস্থ থাকে। কারণ রাজা মিয়া কোন্দিকে যে গোল দেবেন আগে থেকে বোঝার উপায় থাকে না। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মহাসচিব যতই চিবিয়ে চিবিয়ে বলুন এ রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত; কিন্তু তার যে ব্যক্তিগত দুর্বলতা রয়েছে (তাকে চিহ্নিত করা হয় রাজাকার চখামিয়ার ছেলে বলে) তাতে করে তার কথা কতখানি ইফেকটিভ হবে? আরেক কথা বলা নেতা যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এত বেশি অসত্য কথা বলেন যে, বলতে বলতে এখন তার সত্যিটাও মানুষ বিশ্বাস করে না সেই রাখাল বালকের মতো। এখন যদি তিনি বলেন জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার ৫ বছর এবং ছেলে তারেক রহমানের ১০ বছর সাজা হয়েছে, মানুষ বিশ্বাস করবে না। কেউ হয়ত বলেই বসবেন এই লোকটি মিথ্যা কথা বলছে। রায়টি হলো সাড়ে ৯ বছর মামলাটি চলার পর অর্থাৎ জিয়া অফারেজ বা এতিমখানার জন্য বিদেশ থেকে পাওয়া অর্থ আত্মসাতের এই মামলাটি চলেছে দীর্ঘ সাড়ে ৯ বছর এবং খালেদা জিয়া তাতে ৪৩ বার হাজিরা দিয়েছেন। প্রথম দিকে কেবল সময় নিয়ে দীর্ঘসূত্রতায় ঠেলে দিয়েছেন। শেষের দিকে ঘনঘন হাজিরা দিয়ে শেষ করলেন। তাও সামনে নির্বাচন। বছর শেষে। ওয়ান ইলেভেনের পর বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে সংসদ ভবন এলাকায় সাব জেল বানিয়ে রুদ্ধ করা হয়েছিল। সেদিন আরও অনেককে বিভিন্নভাবে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল। তারপরও সে সময় বিডিনিউজ২৪ ডটকম সম্পাদক তওফিক ইমরোজ খালিদীর মতে নির্মল চরিত্রের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দুই নেতা জিল্লুর রহমান (সাবেক রাষ্ট্রপতি) এবং সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দলের হাল ধরেছিলেন এবং রাজনৈতিক বিচক্ষণতার সঙ্গে পুরো পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। রাজনীতি নিজেদের পক্ষে নিয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপির কাছের মানুষ দৈনিক নিউজ টুডে সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ অবশ্য বলেছেন রায়ের কয়েকদিন আগে বিএনপি নির্বাহী কমিটির সভা হয়েছে। তাতে নাকি খালেদা জিয়া তার অনুপস্থিতিতে দল পরিচালনার দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। এটাও শোনা গেছে লন্ডন থেকে তারেক জিয়ার নির্দেশে দল চলবে। কোন অসুবিধা হবে না। তবে এর আগেও তার আরেকটি মামলায় সাজা হয়েছে এবং সে পলাতক কনভিক্ট ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু রিয়াজ উদ্দিন সাহেব এটা জানেন না যে, দুই যুদ্ধাপরাধী ফাঁসি ও আমৃত্যু কারাদ-প্রাপ্ত রাজাকার সাকা চৌধুরী ও আবদুল আলিমের ছেলেকে খালেদা জিয়ার পুত্রের প্রেসারে নির্বাহী কমিটির সদস্য করেছেন, যা দলের জন্য বোঝা। এতদিন কেবল তারেক-কোকো দুর্নীতিপরায়ণ বলে নাগরিক সমাজ জানতেন, এবার জানলেন গোটা পরিবারটাই দুর্নীতিপরায়ণ। এর আগে খালেদা জিয়া অবৈধ দখলদার হিসেবে বসবাসরত ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন। ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড তার বিরুদ্ধে ওই মামলা করেছিল আর এই মামলা করছিল ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বৃহস্পতিবার মামলাটি আদালতে ওঠার আগে বেগম খালেদা জিয়া গাড়ির বহর নিয়ে যখন তার গুলশানের বাসা থেকে আদালতের উদ্দেশে রওনা দেন তার সচিত্র প্রতিবেদনে টিভি চ্যানেলগুলো থেমে থেমে দেখিয়েছে। একাত্তর টিভি একটু ডিটেইলড দেখিয়েছে। একাত্তরের সাংবাদিক ফারজানা রুপার ভাষায় খালেদা জিয়ার গাড়িবহরের গতি ছিল ‘পিপড়ার গতি’। বস্তুত এটাও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কৌশল। যেতে যেতে পথে পথে গ্রুপে গ্রুপে প্রস্তুত হয়েছিল কর্মীরা, গাড়িবহর এলে তারা যোগ দেবে এবং আকস্মিকভাবে পুলিশের ওপর চড়াও হবে ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। এতে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল হবে। হাতিরঝিল, মগবাজার, কাকরাইল, বার কাউন্সিল গেট, হাইকোর্ট গেটসহ বিভিন্ন স্থানে বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুলিশকে উস্কানি দেয়ার চেষ্টা করেছে। তারা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছুড়ে প্রভোকট করার চেষ্টা করে; কিন্তু পুলিশ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে খালেদা জিয়াকে আদালতে পৌঁছার পথ করে দেয়। এক পর্যায়ে পুলিশ চানখার পুল এলাকায় টিয়ার গ্যাস ও কিছু রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপরও বিএনপি নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন কোন্ থেকে বারবার পুলিশের প্রতি হামলা চালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুরক্ষায় অটল থাকে। খালেদা জিয়া সম্ভবত নিশান প্যাট্রোল জীপে করে আদালতে যান। টিভি ক্যামেরায় কিছু সময় খালেদা জিয়াকে দেখানো হয়, যাতে খালেদা জিয়ার পাশে একটি টিভি স্ক্রিনের মতো দেখা গেছে। সম্ভবত খালেদা জিয়া গাড়িতে বসে ওয়াচ করেছেন নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ কতখানি। কিন্তু তিনি যা দেখলেন তাতে হতাশ হয়েছেন বলা যায়। আগেই বলেছি খালেদা জিয়া নিজেই নিজের জন্য সঙ্কট সৃষ্টি করেছেন। আবার কতগুলো সঙ্কট উত্তরাধিকার সূত্রে, কতগুলো স্বীয় পুত্রদ্বয় সৃষ্ট, যা তাকে বহন করতে হচ্ছে : উত্তরাধিকার সূত্রে সঙ্কট সৃষ্টি করে গেছেন তার প্রয়াত স্বামী মিলিটারি জেনারেল জিয়াউর রহমান : ১. আজ জঙ্গীবাদের যে বিষবৃক্ষের ছায়ায় বসে খালেদা জিয়া অক্সিজেন নিচ্ছেন তার চারাগাছটি রোপণ করে যান জিয়া। খালেদা জিয়ার কোন বিকল্প ছিল না, স্বামীর লাগানো চারাগাছের গোড়ায় তাকে পানি দিতে হয়েছে। নিজের মধ্যেও চাঁদ-তারা প্রীতি ছিল। ২. কুখ্যাত জামায়াতী গোলাম আযমকে বাংলাদেশে এনে স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছেন এবং স্ত্রী বুঝে না বুঝে স্বামীর আশীর্বাদ হিসেবে ওই বিষধর সাপকে লালন করেছেন। যে কারণে খালেদা জিয়া যখন জনগণকে ডাক দেন তখন প্রফেসর এমাজ উদ্দীন সাহেবরাও রাজপথে নামেন না, ঘরে বসে টিভি স্ক্রিনে চেহারা দেখেন। ৩. দেশপ্রেমিক স্বাধীনতাকামী নাগরিক সমাজ দলটির রাজনৈতিক কর্মসূচীতে ভয় পায়, শঙ্কিত হয়। একটু পেছনে তাকালে প্রথমেই যে ভয়াবহ চিত্র দেখা যাবে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে গ্রেনেড হামলায় কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভী রহমানসহ ২৩ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। মুহম্মদ হানিফ, আবদুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ অনেকেই গ্রেনেডের স্পিøন্টারের যন্ত্রণা নিয়ে ইন্তেকাল করেছেন। এখনও অনেকে দেহে যন্ত্রণা বয়ে চলেছেন। টার্গেট ছিল বঙ্গবন্ধুকন্যাসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বশূন্য করা। আল্লাহর রহমতে শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও তার এক কানের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ কি হিংস্র মানসিকতা যে, পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে খালেদা জিয়াসহ (তখন প্রধানমন্ত্রী) তার দলীয় নেতারা বললেন, শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সমাবেশে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। ছিঃ! কিন্তু আমরা যারা সেই ভয়াবহতার কিছু মুহূর্তের সাক্ষী তারা দেখেছি কিভাবে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপে গোটা এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে হামলাকারীদের জন্য সেফ রিট্রিটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ৪. খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী, ছেলে তারেক হাওয়া ভবন-খোয়াব ভবনের তাকিয়ায় হেলান দিয়ে রাষ্ট্র চালাচ্ছেন। ৫. প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অর্থমন্ত্রী এএসএমএস কিবরিয়াকে হবিগঞ্জে জনসভায় গ্রেনেড মেরে হত্যা করা হলো। তিনি অনেকক্ষণ বেঁচেছিলেন। সুচিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারও চাওয়া হয়েছিল, দেয়া হয়নি। গাড়িতে করে আসতে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণে তিনি ইন্তেকাল করেন। ৬. এভাবে খুলনার মনজুরুল ইমাম, ৭. নাটোরের মমতাজ উদ্দিন, ৮. গাজীপুরের আহসান উল্লাহ মাস্টার- এসব হত্যাকা- মানুষ কি সহজে ভুলবে? মানুষ কি ভুলে যাবে ২০০১-এর নির্বাচনে পুরো রেজাল্ট পাওয়ার আগেই আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কি ভয়াবহ নির্যাতন তারা চালিয়েছিল? মানুষ কি ভুলে যাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে এবং ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিরোধ করতে ২০১৩ সাল থেকে কিভাবে পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করেছিল খালেদা জিয়া ও তারেকের দল বিএনপি এবং তাদের সহোদর জামায়াত-শিবির? এসব ভুলে যাবে তেমন অকৃতজ্ঞ বাঙালী নয়। ভুলের ওপর প্রতিষ্ঠিত কোয়ার্টার শিক্ষিত এক নারীকে ‘চেয়ারপার্সন’, ‘দেশনেত্রী’, ‘ম্যাডাম’, ‘আপোসহীন’ কিংবা অশিক্ষিত ছেলেকেও যতই তরুণ তুর্কী নাম দেয়া হোক, আদালতের রায়ে গোটা পরিবারই আজ দুর্নীতিবাজ। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাজা হলো দুর্নীতির অভিযোগে, তাও এতিমের টাকা আত্মসাত করায়, এটি জাতি হিসেবে একদিকে যেমন লজ্জার, তেমনি বহির্বিশ্বে মর্যাদারÑ বাংলাদেশ দুর্নীতির বিচার করে, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হোন আর যেই হোন আইনের কাঠগড়ায় সবাই হরিপদ কেরানী। ঢাকা ॥ ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×