ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসছে দেশ

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

 বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসছে দেশ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দুর্নীতি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সাজা পাওয়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, এ রায়ের মধ্য দিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসছে দেশ। তারা বলেছেন, দুর্নীতির বিচার হওয়ায় নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। তাছাড়া যে যতই ক্ষমতার শীর্ষে থাকুন না কেন দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের দায় থেকে কেউ রেহাই পায় না- রায়ের মধ্য দিয়ে তাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আগামীতে বাংলাদেশে সকল দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলেও আশা প্রকাশ করেন নেতারা। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মুখে পতনের পর বিভিন্ন মামলায় জেল খাটতে হয়েছিল নয় বছরের সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদকে। ছয় বছরের বেশি সময় জেল খাটেন তিনি। এজন্য এরশাদ খালেদা জিয়াকে বারবার দোষারোপ করেন। বলেন, তার জেল খাটার জন্য দায়ী খালেদা জিয়া। যদিও জেলে থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন এরশাদ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালে কারামুক্ত হন তিনি। তাই দুর্নীতি মামলায় খালেজা জিয়ার পাঁচ বছরের জেল হওয়ায় বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক। এরশাদের পক্ষে জাপার অনেক নেতাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। দীর্ঘদিন বুকে জমিয়ে রাখা কষ্টের যেন শেষ হয়েছে বৃহস্পতিবারের খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাজার রায়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু রায় নিয়ে জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ কি বলেন। এ নিয়ে সব মহলেই নানা রকম কৌতূহল। এরশাদ কি খুশি। নাকি কোন মন্তব্য নেই। এজন্য সাংবাদিকরা বারবারই এরশাদের কাছে ভিড় করার চেষ্টা করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি সরাসরি এ নিয়ে কোন মন্তব্য করেননি। তাঁর প্রেস সচিব মারফত মিডিয়ায় বক্তব্য দিয়েছেন। এতেই খুশি সবাই। তাছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। জাপা চেয়ারম্যানের প্রতিক্রিয়া ॥ এরশাদ বলেন, আদালত রায় দিয়েছেন, আমরা সেটাকে সম্মান করি। রায়ে প্রতিক্রিয়া জানানোর কিছু নেই। রায়ে আমরা খুশি না অখুশি, এটা বড় বিষয় নয়। এরশাদ বলেন, জাতীয় পার্টি সব সময় আইনের শাসনের পক্ষে এবং আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। একটি বিচারাধীন বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। এদিকে বৃহস্পতিবার সংসদে আলোচনায় অংশ নিয়ে জাপার সাংসদ ইয়াহইয়া চৌধুরী বলেন, ২৮ বছর আগে কারাগারে থাকা অবস্থায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি বরইগাছ লাগিয়েছিলেন। সেই গাছে এখন বরই ধরেছে। কারাবিধান অনুযায়ী এ বরই খাওয়া যাবে কি না জানি না। সুযোগ থাকলে খালেদা জিয়াকে সেই বরই খেতে দেয়া হোক। উল্লেখ্য, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ৫ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। আদালত থেকে তাকে নেয়া হয়েছে পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখানেই থাকবেন তিনি। শুক্রবার কারাগারে ডিস ও এসি সংযোগ দেয়া হয়েছে। সাক্ষাত করেছেন খালেদা জিয়ার স্বজনরাও। বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর বকশীবাজারের কারা অধিদফতরের প্যারেড গ্রাউন্ডে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫এর বিচারক ড. আখতারুজ্জামান এ রায় ঘাষণা করেন। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দুর্নীতির কারণে কারাবরণ করতে হলো। এছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে দুর্নীতি মামলায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৫ জনের ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসছে দেশ জিয়া অরফানেস ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ায় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসছে বাংলাদেশ। বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে, কিছু রায় বাস্তবায়ন হয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। এখন খালেদা জিয়ার দুর্নীতির বিচারের রায়ের মধ্য দিয়ে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। এভাবে ক্ষমতার যত শীর্ষে থাকুন না কেন দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের দায় থেকে কেউ যেন রেহাই না পায় সে প্রক্রিয়ার প্রতি আমাদের সমর্থন থাকবে। আগামীতে বাংলাদেশে সকল দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে এই ধারা অব্যাহত থাকবে, ওয়ার্কার্স পার্টি এটাই প্রত্যাশা করে। তথাকথিত বাংলাদেশী নাগরিকরা বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশী দূতাবাসে হামলা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অবমাননা করে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির দাবি জানিয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি। বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় রায় সম্পর্কে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন দেশের মানুষ সকল দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত ও দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দাবি করলেও এ মামলাকে কেন্দ্র করে সরকারের অতি আগ্রহের কারণে জনগণের মধ্যে এ ধারণা বৃদ্ধমূল হয়েছে যে, মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে। রাজনৈতিক বিবেচনার কারণেই জেনারেল এরশাদের দুর্নীতির মামলা গত আড়াই দশক ধরে আদালত প্রাঙ্গণে গড়াগড়িম খেলেও এখনও তার কোন সুরাহা হয়নি। এই মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে দেশের নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনৈতিক সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবে এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, বিরোধ- বৈরিতা নতুন চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হতে পারে। দলীয় বিবেচনার উর্ধে সকল দুর্নীতিবাজের শাস্তি চাই-বাম মোর্চা খালেদা জিয়ার রায়ের প্রেক্ষিত্রে সিপিবি-বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার নেতৃবৃন্দ বলেছেন, আমরা দুর্নীতিমুক্ত দেশ চাই এবং রাজনৈতিক ও দলীয় বিবেচনার উর্ধে সকল দুর্নীতিবাজের শাস্তি চাই। সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহ আলম, বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাসদের (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয় জোনায়েদ সাকি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, আমরা দুর্নীতিমুক্ত দেশ চাই এবং রাজনৈতিক ও দলীয় বিবেচনার উর্ধে সকল দুর্নীতিবাজের শাস্তি চাই। দুর্নীতির দায়ে খালেদা জিয়াসহ কয়েকজনের শাস্তি হয়েছে। দেশে শত শত কোটি টাকার আরও বড় বড় দুর্নীতি ঘটেছে। এসবের সঙ্গে সরকার ও সরকারী দলের অনেক হোমরা-চোমরাও জড়িত। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ যে নিছক দুর্নীতির অপরাধের জন্য দেয়া হয়েছে, তার পেছনে যে কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেইÑ সেকথা প্রমাণ করতে হলে সরকারকে নিজ দলের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, জনসম্মতিহীন অগণতান্ত্রিক সরকারের স্বেচ্ছাচারী শাসন, ক্ষমতার প্রবল দাপট, বিপুল লুটপাটের অভিযোগ ইত্যাদির কোন সুরাহা না করে খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়ার ব্যাপারে সরকারের অতি উৎসাহের কারণে দেশবাসীর মধ্যে এ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে এ রায়ের মধ্য দিয়ে সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে। এ কথা ঠিক যে, বিএনপি আমলে বিপুল পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে। নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, দলমত ও রাজনীতি নির্বিশেষে সকল দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। সরকারের আশ্রয়ে থেকে দুর্নীতিবাজরা যদি মনে করে তারা পার পেয়ে যাবে, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। জনগণ অবশ্যই একদিন তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।
×