ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ায় নানা জল্পনা-কল্পনা, আবারও দলে ভাঙ্গনের আশঙ্কা

সঙ্কটে বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সঙ্কটে বিএনপি

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৫ বছর সাজা হওয়ার পর খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ায় আবার সঙ্কটে পড়েছে বিএনপি। এ সঙ্কট উত্তরণে বিএনপি এখন কি করবে এ নিয়ে খোদ দলের মধ্যেই নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। এ পরিস্থিতিতে দল আবারও ভাঙ্গণের মুখে পড়তে পারে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। উল্লেখ্য, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে দল পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে যান স্থায়ী কমিটির সদস্যদের। তিনি কারাগারে যাওয়ার পর বৃহস্পতিবার বিকেলে নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দেয়া রায় সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কিন্তু ওইদিন রাতে নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে প্রথমে সংবাদ সম্মেলন করে তারেক রহমান এখন থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনের দায়িত্বে রয়েছেন বলে ঘোষণা দেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব। মধ্য রাতে এ বিষয়ে তিনি গণমাধ্যমে একটি বিবৃতিও পাঠান। জানা যায়, খালেদা জিয়া কারাগারে গেলেও দলের চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব ছাড়েননি, বরং ওয়ান-ইলেভেনের সময় যেভাবে এ দায়িত্ব নিজের হাতে রেখেছিলেন একইভাবে এবারও নিজের কাছেই চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব রেখে দিয়েছেন। তবে দলের গঠনতন্ত্র অনুসারে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের কথা রয়েছে। কিন্তু সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলায় সাজা ও কোন কোন মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় এবং তিনি এখন বিদেশে অবস্থান করায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে পারবেন না ভেবেই খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে দল পরিচালনার দায়িত্ব কৌশলে স্থায়ী কমিটির ওপর ন্যস্ত করে ছিলেন, যে স্থায়ী কমিটির সদস্য খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানও। কিন্তু খালেদা জিয়ার এ কৌশল আর এখন থাকল না তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেয়ার পর। খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর প্রতিবাদে শুক্রবার সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচী থাকলেও রাজধানীতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া সিনিয়র তেমন কোন নেতাকে মাঠে নামতে দেখা যায়নি। জানা যায় খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব দিলেও তাদের অবহিত না করেই বৃহস্পতিবার রাতে তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলে ঘোষণা দেয়ায় তাদের মধ্যে অনেকেই নাখোশ হয়েছেন। আর এ জন্যই তারা পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী পালন করতে রাজপথে নামেননি। আর এ কারণে বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচীও কার্যত ফ্লপ হয়েছে। এদিকে বিএনপিতে তারেক রহমানের হস্তক্ষেপকে সহ্য করতে না পারায়ই দলে সংস্কারের প্রস্তাব উঠেছিল। আর যারা সেই সংস্কারপন্থী ছিলেন তাদের অধিকাংশ পরে মূল ¯্রােতে প্রবেশ করলেও এখন তারেক রহমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়ার বিষয়টিকে তারা ভাল চোখে দেখবেন না এটাই স্বাভাবিক। আর যে সব সংস্কারপর্ন্থী নেতারা এখনও দল থেকে বাইরে আছেন তারা আবার নতুন করে ইস্যু পেয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া দলের স্থায়ী কমিটিতে যারা সংস্কারপন্থী নন তারাও খালেদা জিয়ার নির্দেশ উপেক্ষা করে তারেক রহমানের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব নেয়ার বিষয়টিকে সহজে মেনে নেবেন না। এ পরিস্থিতিতে বিএনপিতে আবার নতুন করে ভাঙ্গণের সুর বাজতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। কারণ, খালেদা জিয়া কারাগারে থেকে আগের মতো আর নির্দেশনা দিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রেখে কাজ করতে পারবেন না। আর তারেক রহমানও জেল ও গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে সুদূর লন্ডনে বসে সঠিকভাবে নির্দেশনা দিয়ে দল পরিচালনা করতে পারবেন না। এ পরিস্থিতিতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলের মধ্যে ভাঙ্গণের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। প্রসঙ্গত, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার রায় ঘোষণার তারিখ হওয়ার পর থেকেই তার সাজা হবে বলে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। সেই সঙ্গে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দল চলবে কীভাবে নিয়ে শুরু হয় নানান নানান কথা। কেউ বলেন, তারেক রহমান, আবার কেউ বলেন, তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমান চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পাচ্ছেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার আদালত থেকে কারাগারে যাওয়ার আগে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে দেখা হলেও তিনি এমন কোন নির্দেশনা দেননি। তাই এ বিষয়ে তার আগের সিদ্ধান্ত অর্থাৎ দল চলবে স্থায়ী কমিটির নেতাদের নির্দেশে এমনটিই সবাই ধরে নেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলে আর তারেক রহমান বিদেশে থেকে দলের সঠিক নেতৃত্ব দিতে না পারলে সাংগঠনিকভাবে আবার স্থবির হয়ে পড়বে বিএনপি। এ পরিস্থিতিতে দলের সিনিয়র নেতারা যদি নিষ্ক্রিয় হয়ে যান অথবা ক্ষুব্ধ হয়ে অন্য কিছু চিন্তা করেন তাহলে বিএনপিতে রাজনৈতিক সঙ্কট আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। সে ক্ষেত্রে মূল ধারার বিএনপি কোন কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও দলের একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলকে চরম বেকায়দায় ফেলে দিতে পারে বলেও বিভিন্ন মহল মনে করছে। এদিকে শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের খালেদা জিয়ার রায়ের মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে বলে বিএনপি নেতাদের দাবি নাকচ করে বলেছেন, খালেদা জিয়ার রায়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক সঙ্কট নয় বরং বিএনপির অভ্যন্তরীণ সঙ্কট ঘনীভূত হবে, সেটির লক্ষণ আমরা টের পাচ্ছি। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার মামলা সরকার করেনি, হস্তক্ষেপও নেই। তিনি যদি নিয়মিত হাজিরা দিতেন তবে এ মামলার অনেক আগেই রায় হয়ে যেত। এখন তিনি নিজেই দেরি করে নির্বাচনকে সামনে রেখে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। এ জন্য খালেদা জিয়া ও তার বিজ্ঞ আইনজীবীরাই দায়ী। খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ার পর খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান হওয়া প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, যার আগে ৭ বছরের সাজা হয়েছে, মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় তিনি দ-িত ব্যক্তি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায়ও তার দশ বছরের দ- ও ২ কোটি টাকা জরিমানা হয়েছে। আর বিএনপির গঠনতন্ত্র থেকে কেন ৭ম ধারা তুলে দেয়া হয়েছে তাও এখন পরিষ্কার। এর ফলে দুর্নীতিবাজদের তাদের দলের নেতা হতে এখন কোন বাধা নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির এক সিনিয়র নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, বিএনপি এখন নতুন করে সঙ্কটে পড়েছে না সঙ্কট উত্তোরণ করে আরও ভাল অবস্থানে যাবে তা সময়ই বলে দেবে। রাজনীতিতে আগবাড়িয়ে কিছু বলা ঠিক না। কারণ, রাজনীতিতে যে কোন ঘটনা যে কোন দিকে পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। খালেদা জিয়া কারাগারে গেলেও দলের অগণিত ত্যাগী নেতাকর্মী আছে। তারা ঠিক থাকলে দলের নেতৃত্ব যার হাতেই থাকুক সঠিক সময়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। যেমন, ওয়ান-ইলেভেনের সময় কেউ ধারণা করেনি বিএনপি তার অবস্থান ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু এক সময় দেখা গেল সংস্কারপন্থীরা লেজ গুটিয়ে চলে গেল, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আবার দল ঐক্যবদ্ধ হলো।
×