ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৯:১১, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পূর্ব প্রকাশের পর) স্মর্তব্য যে ১৯৭৩ এ বাংলাদেশে একটি শিল্পমাধ্যম হিসেবে নাটকের নিয়মিত চর্চা শুরু হয় ৩রা ফেব্রুয়ারীতে। সেই যে শুরু তারপর নিরবিচ্ছিন্নভাবে নাট্যচর্চা চলতে থাকে। এরই মধ্যে চট্টগ্রামের নাট্যপ্রেমীরা নাটকের একটি ধারা সৃষ্টির জন্যে সচেষ্ট হয়। থিয়েটার ৭৩ এর মত দলের সেই ’৭৩ সালে ঢাকায় নবনাট্য চর্চার সময়েই। আমরা এও জানতে পারি যে উত্তর বাংলাদেশের রংপুরের শিখা সংসদ আবারও নাট্য চর্চায় আগ্রহী হয়ে কাজ শুরু করে। নাটক মঞ্চায়নে রংপুরের একটি ঐতিহ্য আছে এবং সেখানে শিশির কুমার ভাদুড়ীর নেতৃত্বে একটি দল টাউন হলে বেশ কিছুদিন নিয়মিত নাটক চর্চা করেছিল। কথিত আছে যে শিশির কুমার ভাদুড়ী টাউন হলের সামনের মাঠে তাঁবুর নিচে বসবাস করতেন সেই সময়ে। ঠিক একই ভাবে দিনাজপুরে একটি বলিষ্ঠ নাট্যধারা উপস্থিত ছিল বঙ্গভঙ্গের আগে। এ নিয়ে আমি কিঞ্চিৎ খোঁজ-খবর নিয়েছিলাম এবং আমার ধারনা জন্মেছিল যে বিভাগোত্তর বঙ্গে সাধারণত সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই এই ধরনের শিল্পকলা চর্চায় নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখতেন। বিশেষ করে দূর্গা পূজোর সময়ে তরুণ-তরুণীরা কলকাতা থেকে গ্রাম বাংলায় ফিরে আসতেন এবং পূজোর পরপর কোজাগরী পূর্ণিমার সময়ে সাধারণত নাটক মঞ্চায়নের আয়োজন করা হত। বস্তুতপক্ষে বাংলার মুসলমান সম্প্রদায় তখনও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে আগ্রহী ছিলনা। বাংলা বিভাগের পরে বেশিরভাগ শিক্ষিত হিন্দুরা ভারতে চলে যায়। ফলে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে আমরা এক ধরনের শূণ্যতা দেখতে পাই। ১৯৫২ এর ভাষা আেেন্দালনের পর বাঙালী মুসলমানের এই উপলব্ধি হয় যে বাঙালী সংস্কৃতি ঠিক ভাষার মতই আমাদের নিজস্ব সম্পদ। তখন থেকেই অল্প বিস্তর সংস্কৃতি চর্চায় আমরা ব্রতী হই। ’৬০ এর দশকে যখন আত্মঅধিকারের স্বার্থে পূর্ববঙ্গের বাঙালীরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্রমে সংঘবদ্ধ হচ্ছিল তখন ওই যুদ্ধে সংস্কৃতি একটি হাতিয়ার হিসেবে স্থান করে নেয়। ১৯৬১ তে আমরা সাড়ম্বরে রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবার্ষিকী পালন করি ঢাকায় এবং পূর্ববঙ্গের আরও কয়েকটি শহরে। ওই সময় ছায়ানটের মত বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্ম হয়। এই সময়ে আমরা এও আবিষ্কার করি যে বঙ্গ বিভক্ত হতে পারে কিন্তু বাংলা সংস্কৃতি অবিভাজ্য। আমরা তখন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দ্বীজেন্দ্রলাল, অতুল প্রসাদ, রজনীকান্ত দাশ এবং হিমাংশু দত্তের গান-কবিতা চর্চা শুরু করি অভিনিবেশ সহকারে। এই জন্য পাকিস্তান সরকার নানা ভাবে আমাদেরকে বিপর্যস্ত করবার চেষ্টা করে। অতএব, সংস্কৃতি সংরক্ষনের স্বার্থেই যেমন আমরা আবিষ্কার করি যে, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিস্তর ব্যবধান রয়েছে তেমনি কেবল আমাদের সংস্কৃতিকে সংরক্ষন করার জন্যই আমাদের এই ভিন্নতাকে একটি নিজস্ব জাতিস্বত্তা এবং স্বাধীন দেশের মর্যাদা দেয়া প্রয়োজন। আমি যখন সংস্কৃতির কথা বলছি তখন কেবল বিনোদন কিংবা অন্যান্য শিল্পকলার মধ্যে শব্দটিকে সীমাবদ্ধ না রেখে আমাদের জীবন ধারার কথাই বোঝাতে চাইছি। আমাদের সংস্কৃতির মধ্যেই রয়েছে আমাদের খাদ্য-বস্ত্র, ভাষা, জীবনচর্যা, সামাজিক আচার। এমনকি আন্তঃবিশ্বে চর্চিত বিভিন্ন ধর্মেরও চর্চা আমরা করে থাকি ভিন্ন ভাবে। (পর্ব- ৬) ’৭২ এ যখন আমরা নাটক নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করলাম তখন একটি বিষয় আমাদেরকে ভাবিত করে। নাটক তো জীবনেরই প্রতিরূপ। অর্থাৎ এখানে কেবল আমাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ত্যাগ-প্রাপ্তি ইত্যাদিই বর্ণিত হবে না। এতে পুরুষ এবং নারীর সমান প্রতিনিধিত্ব থাকাও একান্ত প্রয়োজন। অথচ আমাদেরই দেশের ঘটনা, দুর্ঘটনা নিয়ে আমাদেরই নাটকে নারী প্রতিনিধিত্ব কখনই সুষমভাবে হয় না। একটি রক্ষনশীল সমাজে নারীদের পক্ষে মঞ্চে অবতীর্ণ হওয়া বড়ই দুষ্কর। সেই কারনে নাট্যকারেরাও তাদের নাট্য রচনায় স্বযতেœ নারী চরিত্রকে সীমিত রাখেন এক কিংবা দুই এ। আবার অনেক নাটকই সম্পূর্ণ নারী চরিত্র বর্জিত হয়। ’৭২ এ নাটক শুরু করে আমরাও অভিনেত্রীর অপ্রতুলতা নিয়ে ঝামেলায় ছিলাম। আমাদের চেনা জানার মধ্যে আধুনিক প্রগতিশীলতা মনস্ক যে কয়জন মেয়ে ছিল তাদের প্রায় সবাই সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করার ফলে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড থেকে দূরে সরে গিয়েছিল এবং বয়সে নবীনতররা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করে পেশাগত জীবনে প্রবেশের জন্যে নিরন্তর কাজ করে যাওয়ায় সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁদের চিন্তা-ভাবনা করার অবকাশ ছিল না। এরকম একটি পরিস্থিতিতে নারী চরিত্র বিশিষ্ট ভালো নাটক অভিনয় করা সত্যিই দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। আমরা আমাদের পরিবার, আতœীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের স্মরণাপন্ন হই। সেই রকম একটি পরিবার থেকে নায়লা জামান, বর্তমানে প্রখ্যাত শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ড. নায়লা খান স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নাগরিকে নাটক করতে আসে। নায়লার আরও দুটি পরিচয় সে ’৭১ এ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেশের গান এবং জাতীয় সংগীত এ নিয়মিত অংশগ্রহন করেছিল। দ্বিতীয়ত, তার পিতা লে. কর্ণেল নুরুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেছিলেন। অতএব, স্বাধীনতাত্তর বাংলাদেশে এটাই স্বাভাবিক ছিল যে নায়লার মতো মানুষেরা একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ হবে। নির্দেশনার জন্যে আমাকে দেয়া নাটকটি ”বাকী ইতিহাস” এ দুটি নারী চরিত্র ছিল। একটি চরিত্রের নাম ছিল বাসন্তী নাগ এবং অন্যটি কণা চক্রবর্তী। নায়লা, বাসন্তী নাগ-এর চরিত্রের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। কিন্তু কণা চক্রবর্তী-কে নিয়ে কী করা যায়? এই সমস্যার সমাধানে নায়লাই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে আসে এবং ওদেরই পরিচিত একটি তরুণীকে অভিনয় করার জন্যে নিয়ে আসে এক সন্ধ্যায়। এই ভাবেই সারা, সারা আমিনের নাটকে আগমন। সারার বড় ভাই, আলাউদ্দীন মোহাম্মদ জাহিন নাটকে প্রচন্ড আগ্রহী ছিল। সে কলেজে থাকতেই একাধিক ইংরেজী এবং বাংলা নাটকে অভিনয় করেছিল। স্যামুয়েল বেকেটের ’ওয়েটিং ফর গডো’ নাটকে ভøাদিমির এবং এস্ত্রাগন উভয় চরিত্রেই সে সমান দক্ষতায় অভিনয় করত। এছাড়াও অন্যান্য বিশ্ব বিখ্যাত নাটকের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে বিভিন্ন সময়ে অভিনয় করেছিল আলাউদ্দীন মোহাম্মদ জাহিন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে চলে গিয়েছিল সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহন করার জন্যে। আর ফিরে আসেনি। ভাইয়ের এই নাটক প্রীতি বোনের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। তাই সারার নাটকে আগমন এর ব্যাপারটি ছিল স্বতস্ফুর্ত। অডিশন এর পর আমরা সারা-কে কণা চক্রবর্তী-র ভূমিকায় নির্বাচন করি। ঐ সময় তার নিষ্ঠা এবং একাগ্রতায় সে চরিত্রটিকে আয়ত্ত করে ফেলে। এই ভাবে শুরু হয়ে গেল নিয়মিত নাট্য কার্যক্রম। দল হিসেবে আমরা পুনর্গঠিত হলাম এবং ভবিষ্যতের কর্মকান্ড নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করলাম। আমি আগেই বলেছি যে, আমার তারুণ্য আর দশটি তরুণের মতো ছিলনা কখনো। জীবনের শুরু থেকেই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমি বাধ্য হয়েছি বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে। স্মরণ করা সম্ভব হবে যে আমার ছাত্র অবস্থাতেই আমার বাবা-মা এবং দিদি মারা যান। অতএব, পরিবারের অনেক জাগতিক দায়িত্ব আমার কাঁধে এসে ভর করেছে। এরপর আমার কর্মক্ষেত্রে খুব অল্প বয়সেই নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব আমাকে অর্পন করা হয়। অতএব, আর দশটি তরুণের মতো বাঁধনহারা যৌবনের গান আমি গাইতে পারিনি কোন কালেই। আমার সমবয়সী এক স্বাধীন যুবককে যখন দেখেছি যৌবনের বর্ণিল বিষয়গুলো নিয়ে আনন্দে মেতে থাকতে তখন আমার ঈর্ষা হয়েছে বৈকি। কিন্তু তার জীবন যে আমার জন্য নয় সেটাও মনে হয়েছে আমার। ফলে কৈশোর, যৌবনের বয়ঃসন্ধি কাল থেকে শুরু করে জীবনের তিনটি দশক পেরিয়েও প্রেম করা হয়ে ওঠেনি আমার। সেই সময় প্রেম নিয়ে অনেক অবাস্তব দিবাস্বপ্ন দেখা হয়েছে বটে কিন্তু সেগুলো দিবা স্বপ্নই রয়ে গেছে। অনেক সময় ভেবেছি যে, আমার জীবন লব্ধ অভিজ্ঞতায় অর্জিত যেসব আদর্শের গল্প আছে সেই সবেরই প্রতিভু হয়ে আমার জীবনে কোন একদিন এক নারীর আবির্ভাব হবে যার হাতে হাত রেখে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাব আমি। আমার জীবন দর্শন, রাজনীতি, ভালবাসার বিষয়গুলো সম্বন্ধে সেই নারীরও সমান ভালবাসা থাকবে। এখন জানি যে, এগুলো সবই ছিল অবাস্তব চিন্তা।
×