ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আশরাফ পিন্টু

শওকত ওসমানের উপন্যাস

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

শওকত ওসমানের উপন্যাস

শওকত ওসমান (২ জানুয়ারি ১৯১৭Ñ১৪ মে ১৯৯৮) আধুনিক বাংলাসাহিত্যের একজন শক্তিশালী কথাশিল্পী। তাঁকে একজন প্রকৃত জীবনশিল্পী বলা যায়। সমাজ সচেতনতা ও আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসা তাঁর শিল্পীমানসের ধর্ম। তাঁর উপন্যাস ও গল্প আন্তরিকতার স্পর্শে সরল, সহজ ও প্রত্যক্ষ। এ ছাড়া এখানে ব্যঞ্জনাধর্মী রূপক ও প্রতীকের ব্যবহারে তাঁর বিবর্তনশীল মননের পরিচয় মেলে। দেশকালের প্রভাবেও শওকত ওসমানের বোধ ও বোধি লালিত ও বিকশিত। শ্রেণী-দ্বন্দ্বের যন্ত্রণা বৈষম্য ও সম্ভাব্য সমাধানের অস্পষ্ট প্রবণতা তাঁকে যেমন করেছে উৎকেন্দ্রিক, তেমনি নিরীক্ষাধর্মী। শওকত ওসমানের মোট উপন্যাসের সংখ্যা ১৫টি। এগুলো হল- বনী আদম, জননী (১৯৫৮), ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২), সমাগম (১৯৬৭), চৌরসন্ধি (১৯৬৮), রাজা উপাখ্যান (১৯৭১), জাহান্নাম হইতে বিদায় (১৯৭১), দুই সৈনিক (১৯৭৩), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩), পতঙ্গ পিঞ্জর (১৯৮৩), আর্তনাদ (১৯৮৫), জলাঙ্গী (১৯৮৬), রাজপুরুষ (১৯৯২), রাজসাক্ষী, বেড়ি। নিচে তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো আলোকপাত করা হলো। বনি আদম : ‘বনি আদম’ শওকত ওসমানের প্রথম উপন্যাস হলেও প্রকাশিত হয়েছে অনেক পড়ে। উপন্যাসটি বৃহৎ বাংলার বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের ত্রিশ দশকের পটভূমিতে লেখা। যৌবনের প্রারম্ভে লেখক উপন্যাসটি লিখেছিলেন কিন্তু এখানে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট পরিপক্ব। যে বয়সে লেখকের রোমান্টিক উপন্যাস লেখার কথা কিন্তু লেখক তা না লিখে লিখলেন এক প্রান্তিক মানুষের কাহিনী। উপন্যাসের নায়ক হারেস কিছুটা হাবাগোবা ধরনের। ছোটবেলা থেকেই গ্রামের এক বৃত্তশালীর বাড়িতে ভৃত্য হিসেবে থাকে। তার মা-ও ঐ বাড়িতে দাসীগিরি করত। ‘পেটভাতা’ আর বছরে দুটি লুঙ্গি-গামছা নিয়েই হারেস সন্তুষ্ট থাকে। এই হারেস একদিন অবিশ্বাস্য ঘটনাা ঘটিয়ে ফেলে। এই যন্ত্র-মানবটি একদিন তার মনিব সলিম মুন্সিকে বলে, ‘পনেরো বছর আপনার গোলামÑ তার কি কোন দাম নেই, বেতন নেই?’ এরপর হারেস চলে যায় বাড়ি থেকে। শহরে গিয়ে ওঠে এক বস্তিতে। রাজমিস্ত্রির জোগালে হিসেবে কাজ করে সেখানে। আরিফের সঙ্গে হয় বন্ধুত্ব। হারেস বিয়ে করে ঘর-সংসার শুরু করে। এ সময় গান্ধীর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন তুঙ্গে। এ আন্দোলনের প্রভাব পড়ে হারেসের উপরও। হারেস পালিয়ে বেড়ায়। উপন্যাসের শেষে হারেস ফিরে পায় তার স্ত্রী ও তিন বছরের ছেলে কিবরিয়াকে। সে আবার গ্রামের পথে যাত্রা করে। ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান হাবাগোবা হারেসকে ধীরে ধীরে অস্তিত্ববাদী করে তুলেছেন এ উপন্যাসে। যে হারেস জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরছে আবার তার নিজ গ্রামের পথে। জননী : প্রকাশের দিক দিয়ে ‘জননী’ শওকত ওসমানের প্রথম উপন্যাস। গ্রামীণ জীবন নিয়ে রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে শওকত ওসমানের ‘জননী’ উল্লেখযোগ্য। পল্লীজীবন, পল্লীর মানুষ এবং সামগ্রিকভাবে পল্লীর পরিবেশকে নিয়ে রচিত হয়েছে এ উপন্যাস। স্বামীহারা দরিদ্র চাষীর বৌ দরিয়া বিবি। সে আর্থিক সঙ্কটে পড়ে উঠতি ধনী ইয়াকুবের সংস্পর্শে আসে। পরবর্তীতে সে লালসার শিকারে পরিণত হয়। ‘জননী’তে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বৈরিতা, ঈশ্বরদ্রোহিতা এবং ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার চিত্র সুন্দরভাবে অঙ্কিত হয়েছে। চরিত্র সৃষ্টিও প্রশংসনীয়। কাহিনী যেমন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে পরিশেষে সামগ্রিকতা অর্জন করেছে, তেমনি চরিত্রগুলো কাহিনীর গতিময়তাকে ক্ষুণœ হতে না দিয়ে পাঠকের কৌতুহলকে বাস্তব জীবনবোধে উদ্দীপ্ত করেছে। গ্রামীণ নিবিড় পরিবেশের ভিতরে নানা ধরনের চরিত্র পাঠকের মনকে আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। সম্ভাব্য ঘটনা ও বিশ্বস্ত চরিত্রায়নের নিপুণ সংমিশ্রণে লেখক ‘জননী’তে যে শৈল্পিক সাফল্য অর্জন করেছেন, তা তাঁর পরবর্তী উপন্যাসগুলোতে পাওয়া যায় না; যদিও তাঁর প্রতিটি উপন্যাসই স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যে অধিকারী। ক্রীতদাসের হাসি : অনেকের মতে ‘ক্রীতদাসের হাসি’ শওকত ওসমানের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এটি একটি প্রতীকধর্মী উপন্যাস। আরব্য-উপন্যাসের একটি কল্পিত কাহিনীর মাধ্যমে সমকালীন জীবন তথা আয়ুব খানের সামরিক শাসনে লাঞ্ছিত সমাজের চিত্র উপন্যাসটিতে মনোরমভাবে অঙ্কিত হয়েছে। জুলুম, অত্যাচার আর শোষণের বিরুদ্ধে লেখকের যে বিস্ফোরিত ক্রোধ তাতে উপন্যাসটিতে এক বিশিষ্টতা দান করেছে; এতে সমগ্র কাহিনীকে আবেগের অগ্নুৎপাতে উত্তপ্ত করে তুলেছে যা ‘ক্রীতদাসের হাসি’র শেষাংশে নিপুণ শৈল্পিকতায় নিয়ন্ত্রিত হয়ে অসাধারণ এক মানবীয় আবেদন সৃষ্টি করেছে। বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে, কাহিনীর গতিময়তায়, যৌন আবেদনের চটকে এবং পিঙ্গল বাস্তবতার ধূসর গ-ি ছাড়িয়ে এক রোমান্টিক আবহে ‘ক্রীতদাসের হাসি’ পাঠকের মনোরঞ্জনে সহজেই সমর্থ। উপরন্তু এর প্রতীকী তাৎপর্য বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব দিকের সন্ধান দিয়েছে। পতঙ্গ পিঞ্জর : বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে ‘পতঙ্গ পিঞ্জর’ ‘ক্রীতদাসের হাসি’র মতোই অভিনবত্বের দাবিদার; যদিও ‘পতঙ্গ পিঞ্জর’র কাহিনী সমকালীন পারিপার্শ্বিকতার মাধ্যমেই উপস্থাপিত হয়েছে। এই উপন্যাসে গভীর মমত্ববোধ, তীক্ষè অন্তর্দৃষ্টি, তীব্র সমাজ সচেতনতার সঙ্গে জটিল ও দ্বন্দ্ব সংকুল সমস্যা রূপায়ণ লক্ষ্যযোগ্য। কাহিনীর কাঠামোতে প্রতীকী প্রভাবকে কাটিয়ে পাঠকের কাছে কাহিনীকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে লেখক ভাষাকে বেশ কিছুটা দুমড়িয়ে-মুচড়িয়ে তার মধ্য থেকে কিছুটা নতুন রস বের করে এনেছেন। যেমন : হররা, নাইয়র, মাকড়া প্রভৃতি শব্দ প্রয়োগ করে লেখক এক ধরনের আঞ্চলিক আবহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। অন্যান্য উপন্যাসের ন্যায় এ উপন্যাসেও অঙ্কিত নর-নারীর চরিত্র তীর্যক ও ঋজু। চৌরসন্ধি : চৌরসন্ধি উপন্যাসটি চোরদের নিয়ে লেখা। একজন তাগড়া মূর্খ রিক্সাঅলা কিভাবে মিল মালিকের ধর্মঘট ভাঙার সাহায্যে এসে কালু সর্দারে পরিণত হয়, তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে এখানেÑ যা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে। কাহিনীতে বেশ জট পাকানো হয়েছে। শহরে দুই চোরা দ্বন্দ্বে পড়ে যাচ্ছে : ব্যবসা দুই দলেরই মন্দা। এই উপন্যাসে একটি ধারণা বা কনসেপ্টকে রূপ দেওয়া হয়েছে। পাঠক বুঝতে পারে উচ্চবিত্তের মূল্যবোধ মধ্যবিত্ত বা সাধারণ জনগণের মতো নয়, এর মধ্যে আছে বিপুল পার্থক্য। এ উপন্যাসের কাহিনীকে প্রতীকী তাৎপর্যেও বিশ্লেষণ করা যায়। একদিকে পূর্ব (পূর্ব পাকিস্তান) আর একদিকে পশ্চিম (পশ্চিম পাকিস্তান); যেন দুই চোরের সন্ধি। পূর্বে মোনায়েম খান আর পশ্চিমে আয়ুব খান। তবে পূর্ব পশ্চিমের সন্ধিটি কার্যকর হয় মাত্র পঁচিশ বছর। সমাগম : ‘সমাগম’ শওকত ওসমানের ফ্যান্টাসি ধরনের উপন্যাস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন কালের নানা প্রতিভাবান ব্যক্তির সমাবেশে এর কাহিনী গড়ে উঠেছে। এতে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের জয়গানের সঙ্গে সা¤্রাজ্যবাদীদের ধ্বংস কামনা করা হয়েছে। বাচনভঙির অভিনবত্বে এবং রচনাকৌশলে উপন্যাসখানি আমাদের উপন্যাস সাহিত্যে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের দাবিদার। জাহান্নাম হইতে বিদায় : শওকত ওসমানের ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস। এ উপন্যাসের নায়ক গাজী রহমানের দৃষ্টিই এখানে লেখকের নিজস্ব দৃষ্টি। ব্যক্তি গাজী রহমানের চেতনার আড়ালে লুকিয়ে আছে যুদ্ধপীড়িত দেশের দেড় মাসের কিছু চালচিত্র। এ উপন্যাসে দেখা যায়, আতঙ্কজনক পরিস্থিতি, স্বজন হারানোর বেদনা, নরসিংদী থেকে নবীনগরের পথে গাজীর চৈতন্য ভেসে ওঠা বৃদ্ধের অভিব্যক্তি, ডেমরা ঘাঁটির চেকপোস্ট পার হয়ে ছইয়ের নিচে মাঝির অভিব্যক্তি, শীতলক্ষ্যা নদী তীরবর্তী জীবন, মাতারির ছেলের মুক্তিফৌজে যোগদান ইত্যাদি। এমন বিষয় উপন্যাসে মর্মন্তুদ একটি সময়ের বিবরণ হয়ে রয়। জাহান্নাম হইতে বিদায়’ উপন্যাসের কাহিনিতে তেমন কোন চাকচিক্য নেই, দ্বন্দ্ব এবং চরিত্রের বিকাশও তেমন চোখে পড়ে না। পাকবাহিনীর হাতে আক্রান্ত স্বদেশ, তাদের অত্যাচার-নির্যাতন, জ্বালাও-পোড়াও, হত্যাযজ্ঞের কারণে প্রিয় মাতৃভূমি এখন জাহান্নামে (দোজখে) পরিণত হয়েছে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র গাজী রহমানের মধ্যে লেখক শওকত ওসমানের আত্মচরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। তাই সমালোচক মন্তব্য করেছেন, ‘শওকত ওসমান এই উপন্যাসের গাজী রহমানের ভেতর দিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তসুলভ মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। সঙ্কট থেকে পলায়ন– কেবল নিজেকে বাঁচানোর জন্য ব্যাকুল, ব্যস্ততা গাজী রহমানের মধ্যে এই প্রবণতা বর্তমান।’ নেকড়ে অরণ্য : ‘নেকড়ে অরণ্য’ উপন্যাসটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে হায়েনারূপী পাকসেনাদের পাশববৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য কতিপয় বন্দিনী বাঙালী রমণীর এক মর্মন্তুদ আলেখ্য। এ উপন্যাসে পাকসেনার হাতে নির্যাতিত নারীদের লেখক বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : গুদামের পোস্তার ওপর শত শত বস্তা সারি সারি থাকে থাকে সাজানো থাকত কদিন পূর্বে। আজ সারি সারি মানুষ শুয়ে আছে। অবশ্যি স্তর অনুপস্থিত। কারণ কারও ওপর কেউ শুয়ে নেই। একদম সিমেন্টের ওপর, যাদের মানুষ বললাম, তারা শুয়ে আছে, মানুষের মধ্যে যাদের মানবী বলা হয়। কেউ সটান কেউ কুকড়ে গেছে, শীতের রাত্রের কুকুরের মত।‘ এরা এ উপন্যাসের নারীচরিত্র- তানিমা, জায়েদা, বালীদা, সখিনা, চাষি বউ আমোদিনী। এরা নেকড়ে অরণ্যে বন্দী। এদের জীবনের মূল্যবান সম্পদ নিঃশেষ; ধর্ষিতা এরা। পাকসেনারা এভাবেই বন্দী করেছে বাংলাকে, এ অরণ্য থেকে বাঙালী মুক্ত হয়েছে অনেক রক্ত ঝরিয়ে। নেকড়ে অরণ্য উপন্যাস নারীর বন্দিশালায় খানদের অত্যাচারের ইতিবৃত্ত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নারীদের এ-নিগ্রহ হানাদারদের কাছে একটা অনিবার্য বিষয় ছিল। নেকড়ে অরণ্যের কাহিনী তারই এক চালচিত্র। কিন্তু এই বন্দীশালাতেও মাঝে মাঝে এসেছে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবাদ, মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের বার্তা। দুই সৈনিক : গ্রামের পটভূমিতে লেখা শওকত ওসমানের আরেকটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস হল দুই সৈনিক। বেতারের সংবাদই তখন জীবন সঞ্জীবনী। কলকাতা বেতার শুনছে সাহেলী ও চামেলী। বাবা মখদুম মৃধা; তিনি মৌলিক গণতন্ত্রী ছিলেন, ঊনসত্তরে গণঅভ্যুত্থানের সময় সাজাও পেয়েছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি দ্বিধায় আছেন। একটি গ্রামীণ প্রতিবেশে উপন্যাসের কাঠামো নির্মাণ, ইতিহাসের সভ্যতা তার পরিপূরক হয়ে আসে। প্রথম দুপর্বে চরিত্রগুলোর পারস্পরিক কথোপকথনে জানা যায় একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে দেশের স্বাধীনতা, শেখ মুজিব কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন, নির্বাচনে জিতেছেন। মখদুম মৃধার দুই মেয়ে সারাক্ষণ ট্রানজিস্টার নিয়ে দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠ শুনছেন। রণেশদাশ গুপ্তের মতে, দুই সৈনিক হচ্ছে হানাদার বাহিনীর দুই মদমত্ত অফিসার। ৭১ সালের ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনী সারাদেশে যে হামলা চালায় তার দুই মূর্তিমন্ত প্রতীক। তাদের পাশবিক ক্রিয়াকলাপ উপন্যাসটির ঘটনা তরঙ্গ সৃষ্টি করে। এই জন্যই সম্ভবত উপন্যাসের নাম দুই সৈনিক। জলাঙ্গী : মুক্তিযুদ্ধের ঢেউ শহর ছাপিয়ে বাঁকাজোল গ্রামে পৌঁছেছে। জামিরালি শহর থেকে গ্রামে আসে। শেখ মুজিবের হুকুমে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি- সবকিছুই বন্ধ। ছয় দফা জনতার দাবি। অনিবার্যভাবেই বাস্তবতার একটা তাগিদ থেকেই রাজনীতি অনুষঙ্গী হয়ে পড়েছে মানুষ। চব্বিশ বছর আগে পাকিস্তান হওয়ার সময় সে কত কী আশা করেছিল। আরো স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত জীবন। কিছুই সহজে মেলেনি। যেটুকু পেয়েছি ¯্রফে গতরের জোরে। তার একটা বিহিত হওয়া দরকার। একটা মৌলিক প্রশ্নে দাঁড়িয়ে যায় গ্রামের মানুষ। প্রতিটি সংবাদ প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যায়; মুজিবের বার্তা মর্মে আঘাত হানে প্রত্যেকের। ৭ মার্চের সংবাদে লেখক বলেছেন : ইতিহাস যেন স্বকণ্ঠে রায় দিল। থরথর কম্পনে গোটা দেশ নড়ে উঠল বিরাট অজগরের মতো। সেই মোহ-বর্ণিল ভীতিময় অবয়ব সেই গর্জন এবং শীৎকারের আষ্টেপৃষ্ঠে লেজ-সাপটানি! আঘাতের সময় সরল, সমুন্নত। অধিকারের প্রশ্ন, বাঁচার স্বার্থ একটা গ্রামীণ জীবনে ভিন্ন অর্থ পায়; সময়ের পরিবর্তনে দ্বন্দ্ব আসে, অবস্থার পরিবর্তন হয়। শওকত ওসমানের উপন্যাসের পাঠক মাত্রই যে বিষয় লক্ষ্য করে, তাহলোÑসব ধরনের সামাজিক বৈষম্য ও অবিচারের প্রতি লেখকের প্রখর বিরাগ ও সুস্থ সামাজিক ব্যবস্থা গঠনে তার দুর্দমনীয় আগ্রহ। লেখকের বিষয়বস্তুর সঙ্গে শিল্পের চাহিদার এক সৌহার্দ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। শওকত ওসমান যে ধরনের বিষয়বস্ত (সাধারণ মানুষ ও গ্রামীণ পরিবেশ) নিয়ে কারবার করেনÑ তার ধারা একেবারে শুকিয়ে যায়নি; কেননা এই বৈশিষ্টের প্রভাব সমকালীন বা পরবর্তী ঔপন্যাসিক শহীদুল্লাহ কায়সার, আবু ইসহাক এবং বর্তমান সময়ের অনেক নবীন ঔপন্যাসিকের মধ্যেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লক্ষ্য করা যায়। তাই বলা যায়Ñ শওকত ওসমান ও তার উপন্যাস বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যে এক স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
×