ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সৌন্দর্য আর ঐশ্বর্যের স্বপ্নপুরী দ্য প্যালেস

প্রকাশিত: ০৯:০৪, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সৌন্দর্য আর ঐশ্বর্যের স্বপ্নপুরী দ্য প্যালেস

সুজলা, সুফলা শস্য শ্যামলা নয়নাভিরাম বাংলাদেশ সত্যিই নৈসর্গিক ঐশ্বর্যের সম্রাজ্ঞী। নদীমাতৃক এই আবহমান বাংলার উর্বর মাটি ফসল উৎপাদনে যে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে আসছে তা শুধু আর্থিক ব্যাপারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তার চেয়েও বেশি মনোরম প্রাকৃতিক বৈভবের এক অবারিত দানেরও বটে। সুরম্য লীলা নিকেতনের সমৃদ্ধ সম্পদে দেশের প্রতিটি জেলায়ও দৃশ্যমান হয় অঞ্চলগত বৈশিষ্ট্য। চা শিল্পের নগরী সিলেট ও তার নিজস্ব পারিপার্শ্বিক মহিমায় এক ভিন্ন মাত্রার আবেদনে শিল্পী-সাহিত্যিক তো বটেই ভ্রমণপিয়াসীদের জন্যও অনিন্দ্যসুন্দর, মনোমুগ্ধকর নগরী হিসেবে বিশেষ খ্যাত এবং পরিচিত। হযরত শাহজালালের মাজার পরিবেষ্টিত আধ্যাত্মিক নিমগ্নতা ও রূপসী সিলেটের অন্যমাত্রার সংযোজন। হাসন রাজার দেশ সিলেটের সাংস্কৃতিক আঙ্গিনা ও নিজস্ব বৈচিত্রিক প্রভায় উদ্ভাসিত। সব মিলিয়ে সিলেটের রূপ মাধুর্য সত্যিই আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন। নিজস্ব বিত্তবৈভব ছাড়াও আধুনিকতার জোয়ার এই ঐতিহ্যিক নগরীকে যে মাত্রায় নিয়ে গেছে তা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব আর উপলব্ধি করতে না পারলে এই সৌন্দর্যে অবগাহন করা আসলেই অসম্ভব। আধুনিকতার নতুন ছোঁয়ার সঙ্গে অবিমিশ্র প্রাকৃতিক সম্ভারে সিলেট জেলার অন্যতম শহর হবিগঞ্জ এখন পর্যটকদের জন্য এক বিশেষ দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নান্দনিক শোভায় বর্ণিল হবিগঞ্জের সৌন্দর্যস্নাত পরিবেশের সঙ্গে যুগ আর সময়ের দাবি মেটানোর সমস্ত আধুনিক আয়োজনও সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। তেমনি একটি অত্যাধুনিক বিলাসবহুল রিসোর্ট ‘দ্য প্যালেস’ আজ পর্যটন শিল্পে তার যুগান্তকারী অবদান রেখে যাচ্ছে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ী এলাকার অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ওপর কোনরকম আঘাত না হেনে যেভাবে এই মনোরম রিসোর্ট তৈরি করা হয় তা শুধু ভ্রমণকারীর জন্যই নয় সৃজনশীল মানুষের জীবন ও কর্মে অপার সম্ভাবনার দ্বারও স্বাগত জানাচ্ছে। ব্যয়বহুল এই রিপোর্টে আমোদ-প্রমোদের সমস্ত রুচিশীল আয়োজন এমনভাবে সম্পৃক্ত করা হয়েছে যা শুধু দর্শনীয়ই নয় উপভোগ্যও বটে। ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে ৩০০ ফিট পার হয়ে পূর্বাচলের রাস্তা দিয়ে সিলেটে যাওয়ার যে পথপরিক্রমা তা অনেকটা যানজটবহির্ভূত। শুধু তাই নয়, প্রাকৃতিক মাধুর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশকে নিজস্ব মহিমায় দেখারও এক সুবর্ণ সুযোগ। কোলাহলপূর্ণ নগরী থেকে শুরু করে যানজটে আক্রান্ত প্রতিদিনের ঢাকা শহরের যান্ত্রিক দৃশ্য দেখে ক্লান্ত, অবসন্ন মন যখন অসাড় হওয়ার উপক্রম সে সময় এমন একটি ভ্রমণযাত্রা পারিবারিক আবহে সত্যিই লোভনীয় এবং সময় কাটানোর এক অন্য রকম আয়োজন। নিসর্গের অবারিত দানে পরিপুষ্ট বাংলাদেশকে এমন মুগ্ধতার সঙ্গে অনুভব করতে করতে স্মরণে এসে যায় রবীন্দ্রনাথের দুই বিঘা জমির বস্তুচ্যুত উপেনের সেই বিমোহিত অবগাহনÑ নমো নমো নমো, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি, গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি। অবারিত মাঠ, গগন ললাট, চুমে তব পদধূলি, ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়, ছোট ছোট গ্রামগুলি। পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলা দেহ, স্তব্ধ অতল, দীঘি কালো জল নিশীথ শীতল স্নেহ। এভাবে জীবনানন্দের রূপসী বাংলা ও যাত্রাপথকে বিচিত্র রঙে রাঙিয়ে দেয়। মনে পড়ে নজরুলের মুগ্ধ করা সেই চিরায়ত বাণীÑ কী অপরূপ রূপে মা তোমার হেরিনু পল্লী জননী, ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবণী। একসময় আমরা বাংলাদেশের আর এক শিল্প নগরী ‘নরসিংদী’ জেলায় যাত্রাবিরতিতে কিছু সময় পার করি। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মতো নরসিংদীও এক অপরূপ মোহনীয় সম্ভার নিয়ে দর্শনার্থীর নয়ন জুড়ায়, ভ্রমণবিলাসীরা আপন ঐতিহ্যিক ধারায় আপ্লুত হয়। নরসিংদী হয়ে আমরা আর এক বিখ্যাত জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া অভিমুখে আমাদের গন্তব্যে এগিয়ে যাই। মনে পড়ে যায় ভারত উপমহাদেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী সঙ্গীত সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর কথা। একদা যাঁর সুরের মূর্ছনায় অবিভক্ত ভারত আন্দোলিত হতো। সে মহান সঙ্গীতজ্ঞের পৈত্রিক বাড়ি এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কিছুদিন আগে এই ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর জাদুঘরে মৌলবাদীরা হামলা চালিয়ে তাঁর ঐতিহ্যিক স্মারকগুলো নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টায় মেতে ওঠে। এক সময় যাঁর নিবেদিত সঙ্গীত সাধনায় অগণিত মুগ্ধ শ্রোতা শ্রদ্ধায়-ভালবাসায় নিজেদের সমর্পণ করত। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য নিজ জেলার সীমানায় তাঁর পুণ্য স্মৃতিকে এমন অপমান আর অসম্মান ভাবাই যায় না। গুণীর কদর করতে না জানলে সে দেশে নাকি গুণী জন্মায় না। আমাদেরও কি তেমনই আধোগতির সময় অপেক্ষা করছে! এখানে আমাদের দুপুরের আহার সেরে নিতে হলো। মাননীয় অর্থমন্ত্রীর পিএস ফয়জুর ভাই আমাদের সঙ্গে ছিলেন। সেভাবে মধ্যাহ্ন ভোজন আমরা উপহার হিসেবেই পেলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমানা পার করেই আমরা ঢুকলাম হবিগঞ্জে। আর এখান থেকেই আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর তাগিদ শুরু যায়। দুই ঘণ্টার মধ্যেই আমরা হবিগঞ্জের সেই ‘দ্য প্যালেসের’ কাছাকাছি চলে আসি। হবিগঞ্জের মূল সড়ক থেকে প্রায় ৬-৭ কিলোমিটার ভেতরে এই মনোরম রিসোর্টটি। প্রথমে উল্লেখ করা হয় অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই ভ্রমণ। কারণ ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া এখানে আসা সত্যিই কঠিন। স্টেশন থেকে স্থানটি অনেক দূরে। বড় রাস্তা থেকে আমরা ভেতরের দিকে যেতে শুরু করলাম। চারপাশে হরেক রকম গাছের মহড়া দেখে মনে হলো কোন এক শান্ত-স্নিগ্ধ সুরম্য পল্লীবালার নির্জন জায়গায় নিজেদের সমর্পণ করছি। দুই পাশে উঁচু-নিচু পাহাড়ের দৃষ্টিনন্দন মনোহর দৃশ্য। বিমুগ্ধ নয়নে এমন রূপবৈচিত্র্য উপভোগ করতে করতে আমরা কাক্সিক্ষত সেই রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালাম। সত্যিই রাজসিক সমস্ত আয়োজনে পুরো জায়গাটির যে মন্ত্রমুগ্ধ করার আবেদন তা শুধু রাজা বাদশাদের পক্ষেই সম্ভব। রিসোর্টের রুম ভাড়ার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য প্রাতঃরাশ। মধ্যাহ্ন এবং নৈশ ভোজে ভ্রমণকারীদের আলাদা বাজেট। অবশ্য এটাই আন্তর্জাতিক নিয়ম। হরেক রকম রুমের আয়োজনে রিসোর্টটির যে বিশিষ্টতা তা একেবারেই ভিন্নমাত্রার। আধুনিকতার সঙ্গে বাংলার চিরয়িত প্রকৃতির এক অদ্ভুত সমীকরণ। চারপাশে বিচিত্র বৃক্ষরাশির মিলনমেলা সুশোভিত বাংলাকে নতুন করে চিনিয়ে দেয়। আর যখন কটেজে প্রবেশ করি তখন সমস্ত আধুনিকতার ছোঁয়া। এমনকি দরজাও কার্ড স্পর্শে খুলতে হয়। ভেতরে চা-কফির সমস্ত আয়োজন। তিনটে বড় বড় বেডরুম। প্রতি বেডরুম সংলগ্ন ওয়াশরুম। ড্রইং এবং লিভিং রুম ও শোয়ার জন্য ব্যবহারযোগ্য। টিভি, ওভেন, গিজার থেকে আরম্ভ করে স্নানাগারে টাওয়েল, স্যান্ডেল, বডিওয়াশ, সাবান, ব্রাশ এমনকি পেস্টও থরে থরে সাজানো। অত্যাধুনিক বলতে যা বোঝায় একেবারে আন্তর্জাতিক মানের সমস্ত কিছু। বিচিত্র গাছের মনোরম বেষ্টনীতে পুরো আঙিনাটিতে আরও লক্ষণীয়Ñ সুইমিং পুলশ, সিনেমা হল এমনকি দর্শনীয় লেকও। গ্রামীণ নির্মল পারিপার্শ্বিক আবহে নতুন সময়ের যাবতীয় সামগ্রী হাতের মুঠোয়। তবে সাধারণ মানুষের আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। রিসোর্টের মূল ভবনে প্রতিদিনের আবশ্যকীয় প্রায়ই সবই হাতের নাগালেÑ দাম যতই লাগামহীন হোক, এমনকি মহিলাদের চাহিদা মেটানোর শাড়ি এবং প্রসাধন সামগ্রী ক্রয় করার মতো বিপণিও দৃশ্যমান। তবে গুরুত্বপূর্ণ আরও একটি বিষয় কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় আসা অত্যন্ত জরুরী। এখানে কোন ওষুধের দোকান নেই যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমাদের সঙ্গে দু’জন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার ছিলেন কিন্তু ওষুধের অভাবে এক সহযাত্রীর চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। পরে জানা যায়, তাদের একটি জরুরী চিকিৎসা কল সেন্টার আছেÑ নির্ধারিত নম্বরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চিকিৎসকের পরামর্শ পাওয়া যায়। তবে আশপাশে কোথাও ফার্মেসি নেই। এ ব্যাপারটি গুরুত্ব দিলে অনেক অসহায় অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। ইজিবাইকের মতো তবে আকারে বড় কিছু গাড়ি আছে ভেতরে ভ্রমণকারীদের জন্য ব্যবহার করা হয়। কটেজে যাওয়ার পথে ছোট্ট উড়াল সেতু সত্যিই আকর্ষণীয়। পাহাড়ী এলাকা হওয়ায় রাস্তার ওপর-নিচুও নজর কাড়ার মতো। সৌন্দর্যস্নাত বাংলার আবহমান রূপমাধুর্যকে যেভাবে অক্ষয় ঐশ্বর্যে গড়ে তোলা হয়েছে সে কৃতিত্বের পুরো দাবিদার নিশ্চয়ই একজন বিজ্ঞ স্থপতি যিনি ঐতিহ্য এবং নতুন সময়কে এক সুতায় বেঁধে দিয়েছেন। এমন পরিকল্পিত আয়োজন যা শুধু বিমুগ্ধ হওয়ার মতোই। পল্লী জননীর অপরিমেয় সম্ভারকে অবিকৃত রেখে সময়ের মিছিলের অপার কর্মযজ্ঞকে যে কিভাবে একীভূত করা যায় তা হবিগঞ্জের এই সাম্রাজ্যে অনুপ্রবেশ না করলে কোনভাবেই উপলব্ধিতে আসবে না। তবে সাধারণ মানুষের জন্য এর দ্বার উন্মোচিত না হলে প্রাপ্তি হবে আংশিক।
×