ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাপের সরলরেখায় চলাচলের কৌশল উদ্ঘাটন!

প্রকাশিত: ০৯:০১, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সাপের সরলরেখায় চলাচলের কৌশল উদ্ঘাটন!

সাপ তাদের বিশিষ্ট ইংরেজী ‘ঝ’ -আকারে চলনপদ্ধতির জন্য পরিচিত। তবে তাদের মধ্যে তুলনামূলক কম লক্ষণীয় একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তাদের একটি অনন্য ক্ষমতার অধিকারী করে। সাপ সরল রেখায় চলতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব সিন্সিনাটির জীববিজ্ঞানী ব্রুস জেন সাপের চলাচলের কৌশল নিয়ে গবেষণা করেছেন, এটা বোঝার জন্য যে কিভাবে একটি সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে ট্রেন চলার মতো করেই তারা নিজেদের সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সাপ নিয়ে গবেষণা রোবটিক্সে অগ্রগতি সাধন করতে পারে যার মাধ্যমে দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে সঙ্কীর্ণ সুড়ঙ্গপথে চলাচল করা সম্ভব। জেন বলেন, ‘সীমাবদ্ধ পরিসরে চলাচল করার জন্য এটি খুব ভাল একটি উপায়। অনেক ভারিদেহী সাপ এই চলনপদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে, যেমন ভাইপার, বোয়া, এনাকন্ডা ও পাইথন প্রজাতি।’ ‘ক্রওলিং উইথআউট উইগলিং’ শিরোনামে তার গবেষণাপত্রটি ডিসেম্বরে গজার্নাল অফ এক্সপেরিমেন্টাল বায়োলজি সাময়িকিতে প্রকাশিত হয়। সাপ সাধারণত তাদের মেরুদ-কে সর্পিল কু-লি আকারে বাঁকিয়ে সাঁতার কাটে, গাছে চড়ে বা হামাগুড়ি দিয়ে চলে। তাদের গতিবিধির বৈচিত্র্যের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো সাইডওয়াইন্ডার র‌্যাটেলস্নেক প্রজাতির নামকরণ। সিন্সিনাটির ম্যাকমিকেন কলেজ অব আর্টস এ্যান্ড সায়েন্সের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক জেন ইতোমধ্যে সাপের তিন প্রকারের চলন কৌশল উদ্ঘাটন করেছেন, এ পদ্ধতি তিনটি যথাক্রমে কন্সার্টিনা, সার্পেন্টাইন এবং সাইডওয়াইন্ডিং। তবে সাপের সরলরৈখিক চলনপদ্ধতি, যাকে রেক্টিলিনিয়ার লোকোমোশন বলা হয়, গবেষণাক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে স্বল্প আগ্রহের বিষয়। ১৯৫০ সালে জীববিজ্ঞানী হান্স লিসম্যান প্রথম সাপের ত্বক ও পেশি কার্যকলাপের এই সমন্বয় পরীক্ষা করে দেখেন। তিনি অনুমান করেন যে সাপের পেশি ও এর শিথিল, নমনীয় ও স্যাঁতসেঁতে ত্বকের সমাবেশ একে মেরুদ- বাঁকানো ছাড়াই সোজাসুজি এগোতে সক্ষম করে। জেন বলেন, ‘প্রায় ৭০ বছর হয়ে গেছে, এ ধরনের সঞ্চারণ পদ্ধতি ভালভাবে বোঝা ব্যতীতই।’ জেন এবং তার স্নাতক ছাত্র ও সহ-লেখক স্টিভ নিউম্যান ১৯৫০ সালে অপ্রাপ্য সরঞ্জাম ব্যবহারে লিসম্যানের ধারণা পরীক্ষা করে দেখেন। জেন উচ্চ মাত্রার ডিজিটাল ক্যামেরার সাহায্যে বোয়া পেষক সাপের গতিবিধি লক্ষ্য করেন এবং এর বিশেষ কিছু পেশি হতে উৎপন্ন বৈদ্যুতিক স্পন্দন রেকর্ড করেন। এটি ইসিজি অর্থাৎ ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাফির মতো একটি ইলেক্ট্রোমাইওগ্রাম বা গ্রাফিক চিত্রগ্রহণ করে যা সাপের পেশি, ত্বক এবং এর দেহের মধ্যকার সমন্বয় প্রদর্শন করে। গবেষণার জন্য নিউম্যান এবং জেন বিশালদেহী বোয়া পেষক সাপ ব্যবহার করেন, যেগুলো বনের মাঝে সরলরেখা বরাবর ভ্রমণ করার জন্য পরিচিত। তারা নির্দেশচিহ্ন খচিত অনুভূমিক পৃষ্ঠে সাপের চলাচল রেকর্ড করেন। গবেষকরা সাপের আঁশযুক্ত ত্বকের সূক্ষ সঞ্চারণ অনুসরণ করার জন্য তাদের দেহের পার্শ্বীয় অংশেও নির্দেশবিন্দু এঁকে দেন। যখন একটি সাপ সামনে এগিয়ে যায়, তখন এর তলদেশের ত্বক এর পাঁজর বা পৃষ্ঠদেশের ত্বকের তুলনায় অনেক বেশি প্রসারিত হয়। তলদেশের আঁশগুলো গাড়ির চাকার ট্রেড বা খাঁজকাটা নক্সার ন্যায় কাজ করে, ভূমির সঙ্গে ঘর্ষণজনিত আকর্ষণ প্রদান করে এবং কঙ্কাল পেশিসমূহ সাপের দেহের অন্তঃস্থ গঠনকে তরঙ্গাকারে টেনে নিয়ে যায় যা দ্রুত চলাচলের সময় তরলিত এবং সুসঙ্গত রূপ নেয়। গবেষণাটিতে আংশিকভাবে সহযোগিতা করেছে ন্যাশেনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন। সাপের অগ্রভাগ থেকে লেজ পর্যন্ত পেশিসমূহ উল্লেখযোগ্য প্রক্রিয়ায় সংলগ্নভাবে ক্রমানুসারে সক্রিয় হয়। মুখ্য দুইটি পেশি পাঁজর (কসটো) থেকে ত্বক (কিউটেনিয়াস) পর্যন্ত প্রসারিত হয়। এদের একত্রে ‘কসটোকিউটেনিয়াস’ বলে। নিউম্যান জানান, ‘মেরুদ-টি ধ্রুবহারে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। এক স্তর মাংসপেশি ত্বককে সামনে টেনে নিয়ে গিয়ে অবস্থান করে। অপর একস্তর বিপরীত মাংসপেশি মেরুদ-কে এগিয়ে নিয়ে যায়।’ বীবর জাতীয় এবং মাটির নিচে বসবাসরত অন্যান্য প্রাণী ভক্ষণকারী কোন শিকারির জন্য এ ধরনের চলনরীতি নিঃসন্দেহে সুবিধাজনক। ‘বিবর্তনধারায় সাপের পূর্বপুরুষরা গর্তবাসী ছিল। দেহ বাঁকিয়ে এবং কোন বস্তু সরিয়ে চলাচল করার তুলনায় এই উপায়ে আপনি অনেক সঙ্কীর্ণ গর্ত বা সুড়ঙ্গরূপ স্থানে সহজেই মানিয়ে নিতে পারবেন,’ বলেন নিউম্যান। জেন বলেন, ‘লিসম্যানের ১৯৫০ সালের বর্ণনা অনেকাংশে সঠিক ছিল। তবে তিনি অনুমান করেন যে সাপের অগ্রসর হওয়ার প্রক্রিয়া ছিল পেশি কর্তৃক ত্বকের সঙ্কোচন, এ ধারণাটি ভুল।’ জেন আরও বলেন, ‘তবে যে ক্ষুদ্র সময়ের পরিসরে তিনি গবেষণাটি করেছিলেন, তার সক্ষমতায় আমি বিস্মিত। আমার মতামতে তার অন্তর্দৃষ্টি প্রশংসিত।’ রোবটিক শিল্পে পাইপলাইন এবং অন্যান্য জলাবদ্ধ সরঞ্জাম পরীক্ষাকারী রোবটে সাপের এরূপ প্রত্যঙ্গহীন, সর্পিল গতিবিধি অনুকরণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। নিউম্যানের মতে যেসকল রোবট সাপের সরলরৈখিক গতি অনুসরণ করতে পারবে সেগুলো অধিকতর উপযোগী হয়ে উঠবে। ‘এই গবেষণাটি রোবটিক্সকে অবগত করতে পারে। ক্ষুদ্র এবং সংকীর্ণ স্থানে সরলরেখায় চলাচল করতে পারা অনেক বড় একটি সুবিধার বিষয় হবে। তারা ধসেপড়া ভবন এবং ধ্বংসস্তূপে অনুসন্ধান ও উদ্ধারকার্য পরিচালনার জন্য সর্পিল গঠনের রোবট ব্যবহার করতে পারে,’ বলেন নিউম্যান। রেক্টিলিনিয়ার লোকোমোশন সাপের জন্য একটি স্বল্পগতি সম্পন্ন চলনপদ্ধতি হলেও ক্ষেত্র বিশেষে তা দ্রুতগতি প্রাপ্ত হতে পারে। তারা সাধারণত নিরাপদ পরিবেশে শিথিল অবস্থায় এই পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন যে সাপ বিচলিত হলে বা তাদের অবস্থান দ্রুত পরিবর্তন করার সময় গতানুগতিক কন্সার্টিনা বা সার্পেন্টাইন পদ্ধতিতে প্রত্যাবর্তন করে। জেন, যিনি একজন শৌখিন সাইক্লিস্ট, রিভশেলের একটি গবেষণাগারে সাইক্লিংয়ের শরীরবৃত্তি ও বলবিদ্যা অধ্যয়ন করেছেন। আরোহীদের কার্ডিওভাস্কুলার ফিটনেসের উপর তার চলমান গবেষণা রয়েছে। সাইক্লিস্টরা তাদের পেশির ল্যাক্টেজ খরচ করার ক্ষমতা কিভাবে বৃদ্ধি করে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য তিনি তাদের দেহের ওজনের প্রতি কিলোগ্রামের এক মিনিট সময়ে অক্সিজেন ক্ষয় করার হার পরিমাপ করেন। তার গবেষণা ৭০টিরও বেশি সাময়িকীতে প্রবন্ধ আকারে প্রকাশিত হয়েছে, অধিকাংশতেই সাপের আচরণ বা জীববিজ্ঞান বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরীক্ষা করা হয়েছে। সম্প্রতি, জেন সাপের গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করছেন, বিশেষত কিছু প্রজাতির গাছে চড়ার বিস্ময়কর ক্ষমতা নিয়ে। জেন ইউনিভার্সিটি অব সিন্সিনাটিতে মেরুদণ্ডী প্রাণীবিদ্যা এবং মানব শরীরবিদ্যা ও জীববলবিদ্যা বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। সাপের প্রতি জেনের জীবনব্যাপী আগ্রহ পূর্বে অনিবন্ধিত বেশ কিছু আচরণের প্রতি বিজ্ঞানের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচন করেছে। তিনি মালয়েশিয়াতে কাঁকড়াভুক সাপ নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং বর্তমানে সিন্সিনাটিতে তার নিজস্ব অস্থায়ী অপটিক্যাল ল্যাবে সাপের দৃষ্টিশক্তির তীক্ষ্মতা পরীক্ষা করছেন। সাপের গতিশীলতার সীমা নিয়ে পরীক্ষা করার মাধ্যমে জেন সাপের জটিল গতি নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন। এটি মানুষ কিভাবে সমন্বিত গতিবিধি কার্যকর করতে পারে সে বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে পারবে। ‘পেশি পরিচালনার উপর স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণের বৈচিত্র্য বা নমনীয়তাই তাদের বিভিন্ন দিকে চলাচল এবং ত্রিমাত্রিক জটিলতার সঙ্গে খাপ খেয়ে চলতে সক্ষম করে তোলে।’ জেন জানান, ‘যদি একটি প্রাণীর কোন কিছু করতে পারার শারীরিক ক্ষমতা থেকেও থাকে, তার সেই স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণ নাও থাকতে পারে।’ সাপের অসাধারণ বিকৃতির পেছনে এর সূক্ষ্ম গতি নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অবদান কতোটুকু সে বিষয়ে জেন আরও বিস্তর গবেষণা করতে চান। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
×