ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফিরেই ক্যারিয়ার সেরা বোলিং

রাজের ‘রাজসিক’ প্রত্যাবর্তন

প্রকাশিত: ০৭:৩৮, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

রাজের ‘রাজসিক’ প্রত্যাবর্তন

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ আসলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন! রাজাদের ফিরে আসাটা এমনই হয়। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে আগে যেমনটা দেখা যায়নি, এবার তা ঘটল। ৩৫ বছর বয়সে, দীর্ঘ ৪ বছর জাতীয় দলের বাইরে থেকে অবশেষে জাতীয় দলের হয়ে খেলতে নামলেন আব্দুর রাজ্জাক। বাঁহাতি এ স্পিনারের ডাক নাম ‘রাজ’। প্রত্যাবর্তন করলেন তিনি মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে এবং আগে খেলা ১২ টেস্টে যা করতে পারেননি, সেটাই করে দেখিয়েছেন। ক্যারিয়ারসেরা বোলিং করে ৬৩ রান দিয়ে নিয়েছেন ৪ উইকেট। যেন যেখানে শেষ করেছিলেন, সেখানেই শুরু করলেন। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে একই প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্ট খেলেছিলেন। চট্টগ্রামে হওয়া সেই ম্যাচটি শেষ হয়েছিল ৮ ফেব্রুয়ারি। সেই একই তারিখে শুরু করলেন আবার নতুন করে। ৪ বছর বঞ্চনার জবাবটা কী দিয়েই দিলেন এর মাধ্যমে? কিন্তু রাজ বহুদিন পর সংবাদ সম্মেলনের আসনে বসে উল্টো স্বপ্ন দেখালেন বাইরে থাকা অন্য সিনিয়র ক্রিকেটারদের এবং ধন্যবাদ জানালেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিবি)। চার বছর আগে যখন টেস্টের পর ওয়ানডে থেকেও বাদ পড়েছিলেন তখন রাজ্জাক জনকণ্ঠকে বলেছিলেন, ‘নির্বাচকরা মনে করেছেন আমার চেয়ে অন্যরা এখন ভাল তাই তারা আমাকে বাদ দিয়েছেন। এটা নিয়ে আমি দুশ্চিন্তা করি না। চেষ্টা করব নিজের নৈপুণ্যের উন্নতি ঘটিয়ে আবার ফিরে আসার।’ সেই চেষ্টা তিনি গত ৪ বছর ধরে জাতীয় ক্রিকেট লীগ (এনসিএল), বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগ (বিসিএল) এবং প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগে (ডিপিএল) করে গেছেন। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ৫০০ উইকেট শিকারের মালিক হয়েছেন। এর মধ্যে দলের অন্যতম স্পিন স্তম্ভ সাকিব আল হাসানের ইনজুরি রাজ্জাকের দিকে আরেকবার নির্বাচকদের দৃষ্টিকে নরম করেছে। চট্টগ্রাম টেস্টের জন্য ঘোষিত দলেই ফিরেছিলেন, কিন্তু খেলা হয়নি। ওই সময় বলা হয়েছিল, ‘রাজ্জাকের চেয়ে অনুশীলনে সানজামুল ইসলামকেই বেশি ভাল মনে হয়েছে!’ সেই সানজামুল খেললেন চট্টগ্রাম টেস্টে এবং ১৫৩ রান খরচা করে মাত্র ১ উইকেট নিতে পেরেছেন। মিরপুর টেস্টের দল থেকেই ছিটকে যান সানজামুল, কিন্তু রাজ্জাক থেকে যান। তখনই নিশ্চিত হয়েছিল স্পিন স্বর্গ মিরপুরেই ঘটবে রাজের প্রত্যাবর্তন। তাই হয়েছে। বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দিনেই রাজের হাতে বল উঠেছে ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে। কারণ, টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামে শ্রীলঙ্কা। রাজ্জাক জানালেন, প্রথম দিকে বল হাতে নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি ও ¯œায়ুচাপে ছিলেন এবং বুকের ধুকপুকানিটাও বেড়ে গিয়েছিল। টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে আবার দেশের হয়ে খেলার একটা চাপ! তবে স্বাভাবিক হতে সময় লাগেনি রাজ্জাকের। ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারে প্রথম আঘাতটা তিনিই হানেন। ফিরিয়ে দেন লঙ্কান ওপেনার দিমুথ করুণারতেœকে দুর্দান্ত স্পিনে বিভ্রান্ত করে। শুরুটা সেখান থেকেই- প্রথম স্পেলে টানা ৫ ওভার বোলিং করে ১ মেডেনসহ ১৮ রান দিয়ে ওই উইকেটটাই নিতে পেরেছিলেন। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার দ্বিতীয় স্পেলে ফিরেছেন, এবার মাঝে একটি ওভার বিরতি দিয়ে প্রান্ত বদলেছেন শুধু- করেছেন টানা ৭ ওভার। এই স্পেলেই তিনি তার বোলিং ক্যারিশমা দেখান বলে অস্বাভাবিক টার্ন, বাউন্স এবং স্কিড করিয়ে। ৭ ওভারে ১ মেডেনসহ ২৭ রানে তুলে নেন তিনি দানুষ্কা গুণাথিলাকা ও অধিনায়ক দিনেশ চান্দিমালের উইকেট। মেরুদ- ভেঙ্গে দেন লঙ্কান ইনিংসের। বিশেষ করে চান্দিমালকে যেভাবে পরাস্ত করে বোল্ড করে দিয়েছেন সেটা স্বপ্নের ডেলিভারি যেকোন স্পিনারের। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চান্দিমাল পেছন ফিরে দেখেছেন তার অফস্টাম্প কাত হয়ে গেছে বলের আঘাতে। তৃতীয় স্পেলে ২ ওভারে ১৪ রান দেন তুলে নেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উইকেটটি। কুসাল মেন্ডিস অর্ধশতক হাঁকিয়ে ক্রমেই দলকে ভাল অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাকেও মধ্যাহ্ন বিরতির পর দ্বিতীয় বলেই বোল্ড করে দেন সরাসরি। পরে আরও দুই ওভার বোলিং করেছেন কিন্তু উইকেটের দেখা আর পাননি। শেষ পর্যন্ত ১৬ ওভারে ২ মেডেনসহ ৬৩ রানে ৪ উইকেট নিয়ে নিজের প্রত্যাবর্তন ম্যাচে প্রথম ইনিংসের বোলিং শেষ করেন রাজ। এর আগে ইনিংসে সেরা বোলিং ছিল তার ৯৩ রানে ৩ উইকেট। ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রামে ওই কীর্তি দেখিয়েছিলেন। রাজের ফেরাটা এক রূপকথার গল্পের মতোই। বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার খুব কম বয়সে শুরু হয়ে ৩০ পেরোতে না পেরোতেই শেষ হয়ে যায়। এমনটা অনেক ক্রিকেটারের ক্যারিয়ারেই ঘটেছে। এমনকি অনেকে কোচিং পেশায় চলে গেছেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি রাজ্জাক। এখন তার বয়স এখন ৩৫। ২৩ বছর বয়সে তিনি সাগরিকায় জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে টেস্ট ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ২০০৬ সালের এপ্রিলে হওয়া সেই টেস্টে এক ইনিংস বোলিং করার সুযোগ পেয়ে ৩০ ওভারে ৯৯ রান দিয়ে ছিলেন উইকেট শূন্য। চট্টগ্রামের সেই মাঠেই শেষ টেস্ট খেলে ফেলেছিলেন, আর ফিরতেই পারবেন না সেটা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলা সেই টেস্টে ৪ ওভার বোলিং করার পর হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে আর মাঠেই নামা হয়নি। আর টেস্ট দলেও ফেরা হয়নি। কিন্তু নিজের কীর্তি দেখিয়ে ঠিকই ফিরলেন এবং নিজের যোগ্যতা, সামর্থ্য প্রমাণ করলেন। এ বিষয়ে রাজ্জাক বলেন, ‘এখানে জবাব দেয়ার কিছু নেই। বিসিবিকে ধন্যবাদ যে এতদিন পরেও আমাকে খেলার সুযোগ করে দিয়েছেন। এটা অন্য সিনিয়র খেলোয়াড়দের জন্যও বার্তা যে সময় এখনও শেষ হয়নি, সামর্থ্যরে প্রমাণ দিতে পারলে ফেরা সম্ভব যেকোন সময়ে। এজন্য খাদ্যাভ্যাস ও ফিটনেস ঠিক রাখা জরুরী।’
×