মিথুন আশরাফ ॥ চার বছর আগে ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির বিকেল আর ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির সকালের মধ্যে কত পার্থক্য! দুই সময়েরই প্রতিপক্ষ দল এক, শ্রীলঙ্কা। কিন্তু সেই বিকেলে এক স্পিনারের পতন হয়েছিল। আর এই সকালে সেই স্পিনারেরই যেন পুনর্জন্ম হয়েছে। সেই স্পিনার হচ্ছেন আব্দুর রাজ্জাক। চার বছর পর আবার টেস্ট আঙ্গিনায় পা রেখে কী চমকই না দেখালেন তিনি। তার বোলিংয়ের সঙ্গে ৪ উইকেট নেয়া তাইজুল ইসলাম ও ২ উইকেট নেয়া মুস্তাফিজুর রহমানের বিধ্বংসী বোলিংয়ে দ্বিতীয় টেস্টে শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং ধস এমনই হলো, প্রথম ইনিংসে ২২২ রানের বেশি করতেই পারল না তারা। কিন্তু এরপর বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা এমনই ভুল করতে থাকলেন, তাতে করে সুন্দর একটি দিনের অপমৃত্যু ঘটল। যে দিনটি হতে পারত বাংলাদেশের। সেই দিনটি হয়ে গেল শ্রীলঙ্কার। ৪ উইকেট যে হারিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ। ৫৬ রান করে ১৬৬ রানে পিছিয়েও আছে।
শ্রীলঙ্কার ইনিংস শেষে দ্বিতীয় বলেই মিডঅনের সামনে দিয়ে দুর্দান্ত বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ইনিংস শুরু করেন ওপেনার তামিম ইকবাল। সুরঙ্গ লাকমালের করা পরের বলেই কট এ্যান্ড বোল্ড হয়ে যান তামিম (৪)। পরের ওভারের তৃতীয় বলে নিজের ভুলে রান আউট হয়ে যান মুমিনুল হকও। রান নিতে গিয়ে ব্যাট পপিং ক্রিজে সময়মতো রাখেননি। আয়েশিভাবে রান নিতে গিয়ে আউট হয়ে যান মুমিনুল। তামিম, মুমিনুল নিজেদের ভুলে আউট হয়েছেন। ১২ রানের সময় মুশফিকুর রহীম (১) যে আউট হয়েছেন তা তো আত্মহত্যা!
এতটাই রক্ষণাত্মক ব্যাটিং করেছেন, ২২ বল খেলেছেন। শেষপর্যন্ত লাকমালের করা লাইনের বলটি ছেড়ে বোল্ড হয়েছেন। যা মুশফিকের মতো নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে কখনোই প্রাপ্য নয়। এরপর ইমরুল-লিটন মিলে যেভাবে খেলছিলেন, মনে হচ্ছিল; দিনটি তারাই শেষ করবেন। কিন্তু একেবারে দিনের শেষে ২ ওভার বাকি থাকতে দলের ৪৫ রানে ইমরুলও (১৯) আউট হয়ে যান। দিলরুয়ান পেরেরার বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ‘রিভিউ’ নিয়েও বাঁচতে পারেননি ইমরুল। শেষ পর্যন্ত ৪ উইকেট হারিয়ে ৫৬ রান নিয়ে বাংলাদেশ প্রথমদিন শেষ করে। লিটন কুমার দাস ২৪ রানে ও মেহেদী হাসান মিরাজ ৫ রানে অপরাজিত থাকেন। আজ দ্বিতীয় দিনে এই দুইজন ব্যাট করতে নামবেন।
কী অসাধারণ বোলিং করলেন রাজ্জাক। তার স্পিন ঘূর্ণিতে শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যানরা যেন চোখে আঁধার দেখতে শুরু করে দেন। একবার হ্যাটট্রিকের সুযোগ তৈরি করাসহ এক এক করে ৪ উইকেট তুলে নিয়েছেন রাজ্জাক। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি যে টেস্ট শেষ হয়েছিল, সেই টেস্টেই সর্বশেষ খেলেছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটে ৫০০ উইকেটের মালিক রাজ্জাক। এরপর পড়তি ফর্ম থাকায় আর টেস্টে খেলার সুযোগই পাননি। সাকিব আল হাসান না থাকায় একজন অভিজ্ঞ স্পিনারের প্রয়োজন পড়ে। তাতে করে রাজ্জাকের দিকেই দৃষ্টি দেয়া হয়। চট্টগ্রাম টেস্টের দলে রাজ্জাককে নিলেও একাদশে রাখা হয়নি। তাকে এতদিন পর টেস্টে ফিরিয়েও আবার ঘরোয়া ক্রিকেটে ফিরিয়ে দেয়া হয়। অগ্রণী ব্যাংকের হয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগে খেলে ২টি উইকেটও পান। আবার রাজ্জাককে দ্বিতীয় টেস্টের দলে নেয়া হয়। এবার রাজ্জাককে একাদশেও রাখা হয়। রাজ্জাক বীরের বেশেই যেন ফিরলেন। মধ্যাহ্ন ভোজে যাওয়ার আগে শ্রীলঙ্কার ইনিংসের বারোটা বেজে যায়। ৪ উইকেট হারিয়ে বসে লঙ্কানরা। রান করে ১০৫। এই চার উইকেটের মধ্যে রাজ্জাকই ৩ উইকেট শিকার করেন। চার বছর আগে সর্বশেষ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে উইকেটশূন্য থাকেন রাজ্জাক। দ্বিতীয় ইনিংসেতো বোলিংই পাননি। আর এবার উইকেট নেয়া দিয়েই পুনর্জন্ম শুরু হয় রাজ্জাকের। শ্রীলঙ্কার রানের খাতায় ১৪ রান যোগ হতেই রাজ্জাকের ঘূর্ণিতে কাবু হয়ে যান দিমুথ করুনারত্মে (৩)। স্ট্যাম্পিং হয়ে যায়।
এরপর ৬১ রান হতেই আরেকটি উইকেটের পতন ঘটে। এবার ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা (১৯) সাজঘরে ফেরেন। তবে এবার অসাধারণ একটি বলে ধনাঞ্জয়াকে আউট করে দেন তাইজুল ইসলাম। তার ঘূর্ণি বলটি লাফিয়ে ওঠে। তা বুঝতে পারেননি ধনাঞ্জয়া। ব্যাটের ছোঁয়া লেগে বল স্লিপে যায়। সাব্বির ক্যাচ ধরেন। শুরুতেই ২ উইকেটের পতনে শ্রীলঙ্কা বিপাকে পড়ে যায়।
রাজ্জাক তো শ্রীলঙ্কাকে বিপদেই ফেলে দেন। একদিকে উইকেট পড়তে থাকলেও, আরেকদিকে ওপেনার কুশল মেন্ডিস ঠিকই প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি ধানুষ্কা গুনাথিলাকাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চান। টার্ন উইকেটে ব্যাটিং করা খুবই কঠিন। সেই কঠিন পথ মেন্ডিস পাড়ি দেয়ার চেষ্টায় সফল হলেও বাকিরা ব্যর্থ হতে থাকেন। রাজ্জাক যে ঘূর্ণি জাদু দেখাতে থাকেন। মেন্ডিস ও গুনাথিলাকার জুটি যখন ৩৫ রানে যায়, ঠিক এমন মুহূর্তে রাজ্জাক আবার নিজের জাদুময় বোলিংয়ের ছোঁয়া ছড়িয়ে দেন।
শ্রীলঙ্কা ৯৬ রানে যেতেই টপাটপ ২ বলে ২ উইকেট শিকার করে ফেলেন। গুনাথিলাকা (১৩) ও অধিনায়ক দিনেশ চান্দিমালকে আউট করে দেন। নিজের ষষ্ঠ ও শ্রীলঙ্কার ২৮তম ওভারের প্রথম দুই বলেই দুই উইকেট শিকার করে নেন রাজ্জাক। প্রত্যাবর্তনেই বাজিমাত করেন। হ্যাটট্রিকের আশা তৈরি করেন। শেষপর্যন্ত তা হয়নি। তবে সকালের সেশনেই যে শ্রীলঙ্কার নাভিশ্বাস উঠে যায়, তা রাজ্জাকের রাজকীয় ফেরাতেই সম্ভব হয়!
দ্বিতীয় সেশন যখন শুরু হয়, সেশনেই দ্বিতীয় বলেই রাজ্জাক দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। এবার এমন উইকেটই শিকার করেন রাজ্জাক, যা খুবই দরকার ছিল। হাফসেঞ্চুরিয়ান মেন্ডিসকে (৬৮) বোল্ড করে দেন। তাতে করে ২৩ টেস্টের ক্যারিয়ারে এক ইনিংসে সেরা বোলিংটাও করে ফেলেন। এরআগে এক ইনিংসে দুইবার ৩ উইকেট নিয়েছিলেন। এবার চার উইকেট নিয়ে ফেলেন। ১০৯ রানে মেন্ডিস আউটের পর ১ রান যোগ হতেই নিরোশান ডিকভেলাকে (১) বোল্ড করে দেন তাইজুল। দেড় শ’ রান হওয়ার আগে আরেকটি উইকেট যেতে পারত। কিন্তু মুস্তাফিজুর রহমানের দুর্দান্ত বলটিতে দিলরুয়ান পেরেরার ক্যাচটি স্লিপে ধরতে ব্যর্থ হন সাব্বির। সেই পেরেরাকে (৩১) দলের ১৬২ রানে গিয়ে আউট করেন তাইজুল। তবে দেখতে দেখতে যে দলটির ২০০ রান করার কথা নয়, তারা সেটি করেও ফেলল। টার্ন উইকেট থেকে হঠাৎ করে ব্যাটিংবান্ধব উইকেট হয়ে গেল যেন। রোদ ভালভাবে উঠতেই ব্যাটিং সহায়ক উইকেটের চেহারা দেখা যেতে শুরু করল। চা বিরতির আগে ১টি বল হয়, সেই বলটিতেই আবার ১টি উইকেট পড়ে। এবার উইকেটটি নেন মুস্তাফিজ। আকিলা ধনাঞ্জয়াকে (২০) আউট করে দেন। তাতে করে ৮ উইকেটও পড়ে শ্রীলঙ্কার। তবে স্কোরবোর্ডে ২০৫ রান জমা হয়ে যায়। টপঅর্ডারে ধস নামার পর টেলএন্ডাররা নিজেদের মেলে ধরেন। তাতেই শ্রীলঙ্কার স্কোরবোর্ড মজবুত হতে থাকে। ২০৭ রানে গিয়ে রঙ্গনা হেরাথকেও (২) আউট করেন মুস্তাফিজ। ২২২ রানে যখন রোশেন সিলভাকে (৫৬) আউট করে দেন তাইজুল ইসলাম, তখন শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংস শেষ হয়। রাজ্জাকের বোলিং নিয়েই যত আলোচনা হয়েছে। কারণ, তিনি যে চার বছর পর ফিরে নিজেকে মেলে ধরেছেন। তবে তাইজুলও দেখিয়েছেন ঝলক। তিনিও রাজ্জাকের মতই ৪ উইকেট শিকার করেছেন। সঙ্গে ২ উইকেট নেয়া মুস্তাফিজের বোলিং তোপে শ্রীলঙ্কাকে বড় স্কোর গড়তে দেয়নি বাংলাদেশ। কিন্তু নিজেরাও যেন ডুবছে!
দিনের শুরুটা যেখানে বোলারদের জন্য বাংলাদেশের হয়েছে, সেখানে তামিম, মুমিনুল, মুশফিক, ইমরুলের ভুলে ভরা আউটগুলোতে দিনের শেষটা শ্রীলঙ্কার হয়ে গেছে। সেই শেষ ঝলকে মিরপুর টেস্টের প্রথম দিনটিও শ্রীলঙ্কারই হয়েছে। ব্যাটসম্যানদের ভুলে বাংলাদেশের সুন্দর একটি দিনের অপমৃত্যু ঘটেছে।
শীর্ষ সংবাদ: