ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মিক ॥ শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মিক ॥ শেখ হাসিনা

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী একাগ্রতা, কর্মদক্ষতা এবং নানাবিধ জনসেবামূলক কর্মকা-ের জন্য সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। যে কোন দুর্যোগে আর্তমানবতার সেবা ও জানমাল রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীর কর্তব্য ও দায়িত্বশীল ভূমিকা সবসময় প্রশংসিত হয়ে আসছে। পবিত্র সংবিধান, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ থেকে অভ্যন্তরীণ ও বাইরের যেকোন হুমকি মোকাবেলায় সেনাবাহিনীকে সদাপ্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দেশের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি জনকল্যাণমূলক কাজে ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে হবে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ৩৮ মিনিটে বরিশালে ‘শেখ হাসিনা সেনানিবাস’ উদ্বোধন এবং সদর দফতর ৭ পদাতিক ডিভিশনসহ ১১টি সদর দফতর, ইউনিটের পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেনাবাহিনীর সুনামের কথা উল্লেখ করে বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ এখন একটি ‘ব্র্যান্ড নেম’। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। ১৯ মিনিটের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পারিবারিক বলতে গেলে আত্মীক সম্পর্ক রয়েছে। কারণ আমার ভাই শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং দ্বিতীয় ভাই লে. শহীদ শেখ জামালও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৭৫ সালে সে রয়েল মিলিটারি একাডেমিতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করে। আমার ছোট ভাই শেখ রাসেলও বড় হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার সেই আশা পূরণ হয়নি। বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার পায়রা নদীর লেবুখালী অংশে নবনির্মিত দেশের ৩১তম ‘শেখ হাসিনা সেনানিবাস’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আবেগআপ্লুত হয়ে বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে আমার বাবাকে হারিয়েছি, মাকে হারিয়েছি, আমার তিন ভাইসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে হারিয়েছি। এমনকি আমার বাবার মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলকেও ঘাতকেরা নির্মমভাবে হত্যা করে। যেহেতু আমি এই পরিবারেরই মানুষ তাই স্বাধীন বাংলাদেশ সার্বভৌম বাংলাদেশের সশস্র বাহিনী গড়ে তোলা আমার কর্তব্য বলে মনে করছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ আকাক্সক্ষা আমার বাবা হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, দেশপ্রেমিক পেশাদার সশ¯্র বাহিনীকে বিশ্বমানের গড়ে তোলার ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে আমরা এই ডিভিশনটি স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ৭ পদাতিক ডিভিশনের ডিভিশন সদর দফতরসহ মোট ১১ ইউনিটের পতাকা উত্তোলন করতে পেরে নিজেকে অত্যন্ত গর্বিত মনে করে প্রধানমন্ত্রী মহান ভাষা আন্দোলনের ফেব্রুয়ারি মাসে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের সব ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। একইসঙ্গে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যার ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় নবগঠিত বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর অগ্রযাত্রা শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় চার নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ভাই-বোন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর যে সব সদস্য শহীদ হয়েছেন তাদের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সালাম জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। বিজয় অর্জনের পর জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি শক্তিশালী প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী গড়ে তোলার জন্য ১৯৭৪ সালে একটি প্রতিরক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করে যান। জাতির জনকের প্রণীত নীতিমালার আলোকে আমরা আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর আর্মড ফোর্সেস গোল ২০৩০ প্রণয়ন করে সেনাবাহিনীর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে আমরা সরকার গঠন করে ব্যাপক উন্নয়ন ও কল্যাণ সাধন করেছিলাম। কারণ জাতির পিতা মাত্র সাড়ে তিন বছর হাতে পেয়েছিলেন দেশ উন্নত করতে। ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হয়নি। আর সেনাবাহিনীও ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে হয়েছে। সেনাবাহিনীর সদস্যদের জীবন দিতে হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একটি স্বাধীন দেশের আধুনিক জ্ঞান সমৃদ্ধ সশস্রবাহিনী গড়ে তোলা হয়নি। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর আমরা সেনাবাহিনীর সার্বিক কল্যাণ ও উন্নয়নের কাজ করি। আজকের সেনাবাহিনীর অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আমরা কাজ করেছি। আমরা সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ব্রিগেড প্রতিষ্ঠার পর সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাসস্থান, মেস তৈরির পাশাপাশি বেতন ভাতা বৃদ্ধি করেছি। সেনাবাহিনীতে অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করেছি। এর আগে বেলা সোয়া ১১টার সময় প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টারযোগে সেনানিবাসের বরিশাল অংশের বাকেরগঞ্জ পৌঁছান। পরে পটুয়াখালীর লেবুখালী অংশে যান এবং রাষ্ট্রীয় অভিবাদন গ্রহণ করেন। সেনানিবাসে পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, ৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল সাইফুল আলম। পরে সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ পরিদর্শনের পর ৭ পদাতিক ডিভিশনসহ ১১টি ইউনিটের পতাকা উত্তোলন ও ইউনিটগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী নতুন এ সেনানিবাসের উদ্বোধনের পাশাপাশি সেনানিবাসের মাল্টিপারপাস হল, এসএম ব্যারাক, অফিস ভবনসহ ১৫টি স্থাপনার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। একইস্থান থেকে প্রধানমন্ত্রী পটুয়াখালী জেলার ১৪ উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন ও একটি কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেনানিবাসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহম্মেদ, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, সাবেক মন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি, মোঃ ফারুক খান, পঙ্কজ দেবনাথ এমপিসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। উল্লেখ্য, সেনাবাহিনীর নয় ডিভিশনের আওতায় দেশে ৩০ সেনানিবাস থাকলেও এতদিন দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় কোন সেনানিবাস ছিল না। দক্ষিণাঞ্চলের ছয় জেলায় বড় ধরনের কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে ২০০ কিলোমিটার দূরের যশোর সেনানিবাসের সহায়তা নিতে হতো। জাতীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তাসহ দক্ষিণ উপকূলের ছয় জেলার প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার দেড় হাজার একর এলাকায় আনুষ্ঠানিক সূচনা হলো ১৭ হাজার জনবলের নবনির্মিত শেখ হাসিনা সেনানিবাস।
×