ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থ আত্মসাত মামলায় প্রথম জেলে গেলেন কোন প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

অর্থ আত্মসাত মামলায় প্রথম জেলে গেলেন কোন প্রধানমন্ত্রী

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ দেশে এই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী কোন রাজনৈতিক নেতা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পর বিচারে দ-িত হয়ে জেলে গেলেন। তিনি দু’বার ছিলেন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। আরেকবার প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের দলকে ক্ষমতায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেছিলেন। ফলে এর স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ১৫ দিন। জনরোষের মুখে তিনি এবং তার দল ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। এসব ছাড়াও ক্ষমতায় থেকে নির্ধারিত ট্যাক্স পরিশোধ না করে পরবর্তীতে বিপুল অঙ্কের কালো টাকাকে সাদা করার ক্ষেত্রে চিহ্নিত এদেশের একমাত্র প্রধানমন্ত্রীও তিনি। বিগত এক/এগারো সরকার আমলে তিনি অবৈধ উপায়ে অর্জিত অপ্রদর্শিত আয়ের বিপরীতে প্রায় ৩০ লাখ টাকা দিয়ে ওই অর্থ সাদা করার সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন। বিষয়টি ছিল পুরো দেশের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য এবং জাতির জন্য চরম লজ্জাকর বিষয়। সরকারে বা বিরোধীদলে থেকে এসব অপকর্মের এ নায়ক হলেন দেশের অন্যতম বিরোধীদল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান। দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তার পদবি চেয়ারপার্সন। তার নাম খালেদা জিয়া। তার জন্ম তারিখও একাধিক। এ নিয়ে কোন আগ্রহী মহল যদি আদালতে গিয়ে এ ব্যাপারে প্রকৃত তথ্য জানতে চায় সেখানেও তার জন্য বয়ে আনতে পারে লজ্জাজনক আরেক পরিস্থিতি। এছাড়াও আরেকটি বড় ঘটনা হচ্ছে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির প্রাক্কালে বিরোধীদলে থেকে তিনি এর বিরুদ্ধে লংমার্চ করে ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে এ চুক্তি তিনি বাতিল করবেন। বলেছিলেন, এ ধরনের চুক্তি হলে দেশের এক-দশমাংশ প্রতিবেশী দেশের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। ওই এলাকায় যেতে বাংলাদেশীদের ভিসা গ্রহণ করতে হবে। পরে তিনি ক্ষমতায় গিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু ওই চুক্তি বাতিল দূরে থাক, এতে কোন স্পর্শও লাগাননি। এছাড়া ওই এক দশমাংশ এলাকা কোন দেশের বা কোন মহলের নিয়ন্ত্রণেও যায়নি, সেখানে যেতে বাংলাদেশী কোন নাগরিকের ভিসাও লাগছে না। এ জাতীয় বহু অপকর্ম ও আবোল তাবোল বক্তব্য দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে তিনি রীতিমতো পারদর্শী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। ভুয়া এতিমখানার নামে বিদেশ থেকে টাকা এনে তা আত্মসাতের দায়ে খালেদা জিয়াসহ ৬ জনকে আদালত বৃহস্পতিবার কারাদ- দিয়েছে। তন্মধ্যে তার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক জিয়াও রয়েছেন। এ নিয়ে তারেক জিয়া দুটি মামলায় দ-িত হলেন। বর্তমানে তিনি ল-নে পালিয়ে থেকে অবস্থান করছেন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরও প্রায় তিন ডজন দুর্নীতির মামলা চলমান রয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারীর বিরুদ্ধে এহেন দুর্নীতির ঘটনা বিরল ঘটনা হিসেবে ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য ছিল আগে থেকে। এ মামলায় ২শ’ দফারও বেশি শুনানির দিন পড়েছিল। বেগম জিয়া ১৫০ দফায় সময় নিয়েছেন। আর বহু দফায় আদালত বদল করার দাবিও জানিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তিতর্কে কোন কিছুই ধোপে টেকেনি। সরকার পক্ষ ও আসামি পক্ষের দফায় দফায় যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার বেগম জিয়াসহ ৬ জন এ মামলায় দ-িত হলেন। এ মামলায় আসামিরা যে দোষী সাব্যস্ত হবেন তা আগেভাগে আইনজীবী মহল থেকে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল। তবে কত বছর দ- হবে তা কারও জানা ছিল না। আদালত বৃহস্পতিবার দুপুরে বেগম জিয়ার বার্ধক্য এবং সম্মানের দিক বিবেচনা করে তাকে ৫ বছর এবং অন্যদের সকলকে ১০ বছর করে দ-িত করেছেন। এছাড়া প্রত্যেককে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা করে জরিমানাও করেছেন। বৃহস্পতিবারের এ মামলায় রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সারাদেশের মানুষের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজমান ছিল। সরকারও বিষয়টিকে আমলে নিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার রেখেছিল। পক্ষান্তরে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করতে সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মাঠে সরব উপস্থিতিও ছিল। এ ঘটনায় দুর্নীতিবাজদের আদালত যেমন ছাড় দেয়নি, তেমনি তাদের সমর্থকদের মাঠে ময়দানেও বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টির কোন সুযোগ দেয়া হয়নি। ফলে সারাদেশের জনগণ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে রায় ঘোষণার পর আজ শুক্রবার দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিল ও আগামীকাল শনিবার দেশব্যাপী প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এরপরে হয়ত অন্য কোন কর্মসূচীও দেয়া হতে পারে। বেগম জিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের খুশি করতেই বিএনপি নেতারা এ ধরনের অপরাজনীতির পথে ধাবিত হয়েছেন বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা নিয়ে বেগম জিয়ার গুলশানের বাস ভবন থেকে বকশীবাজার এলাকায় স্থাপিত বিশেষ আদালত এবং সেখান থেকে দ-াদেশ মাথায় নিয়ে নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কারাগারে গমনের দৃশ্য সারাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। স্যাটেলাইট টিভির লাইভ প্রচারের সুবাদে মানুষ পুরো দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে। এতেও বিস্ময়কর কিছু ঘটনার অবতারণা হয়েছে। সাধারণত যে কোন আদালতে আসামিরা অপেক্ষা করে আদালত কখন এজলাসে উঠবেন। কিন্তু বেগম জিয়ার ক্ষেত্রে দেখা গেল এর ব্যতিক্রম। আদালতের বিচারক সকাল সাড়ে ১০টা থেকে আসামি বেগম জিয়ার জন্য অপেক্ষারত ছিলেন। বেগম জিয়া তার বহর নিয়ে গুলশানের বাস ভবন থেকে রওনা দিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে আদালতে পৌঁছেন দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে। এরপর আদালত বেলা আড়াইটার দিকে এ মামলার রায়ের চুম্বক অংশ পড়ে শোনান। বেগম জিয়া ৫ বছরের জন্য দ-িত হয়েছেন এ সংবাদ দ্রুতগতিতে দেশের এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে প্রচার শুরু হয়ে যায়। বিশ্বের মানুষ জেনে যায়, ইতোপূর্বে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুর্নীতিবাজ হিসেবে জরিপে আসা বেগম জিয়া নিজ দেশের আদালতে ৫ বছরের জন্য দ-িত হয়েছেন একটি ভুয়া এতিমখানার নামে বিদেশ থেকে টাকা এনে তা আত্মসাত করার দায়ে। আদালত থেকে বেগম জিয়াকে নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারে নেয়া হয়েছে পুলিশের বিশেষ প্রোটেকশনে। সরকার পক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, নাজিমউদ্দিন রোডের এ পুরনো কারাগারে বেগম জিয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। চারকক্ষ বিশিষ্ট ভবনে তিনি জেল খাটবেন। এতিমের টাকা মেরে দিয়ে দ-িত হয়ে একজন আসামির জন্য এহেন ব্যবস্থা ইতোপূর্বে হয়েছে কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। স্যাটেলাইট টিভির লাইভ প্রচারে প্রত্যক্ষ করা গেছে, বেগম জিয়া তার চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী সাজগোজ করে নিজ গাড়িযোগে আদালতে গেছেন এবং আদালত থেকে কারাঅভ্যন্তরে পৌঁছেছেন। এ দৃশ্য যারা দেখেছে তারা সকলে রীতিমতো হতভাগই হয়েছে। কেননা, দ-িত হলে যে কারও মুখ লুকানোর বিষয়টি প্রায় পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু বেগম জিয়াকে দেখা গেছে অনেকটা হাসিমুখে। এই হাসি কি তার অন্তর্জ্বালার বহির্প্রকাশ না দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য করেছেন তা কেবল তিনিই জানেন। যাই হোক, টানা প্রায় দশ বছর এ মামলাটি আদালতে গড়ানোর পর বৃহস্পতিবার এর পরিসমাপ্তি ঘটেছে। আগামীতে উচ্চ আদালতে এ মামলা কত সময় গড়াবে এবং এ নিয়ে আরও কি অপরাজনীতি হবে তা একমাত্র ভবিষ্যতই বলে দেবে বলে সকল অভিজ্ঞ সূত্রসমূহের ধারণা।
×