ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

১৩০০ কোটি ডলার ছাড়ানোর আশঙ্কা

বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বহির্বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসেই ঘাটতি সাড়ে ৭০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। অর্থবছরের বাকি সময়ে এ ঘাটতি ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু বাণিজ্য ঘাটতিই নয়, এ অর্থবছরে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও বড় ঘাটতির আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। এর পরিমাণ প্রায় ৪৩৪ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতির ঘোষণাপত্রে এ আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। সম্প্রতি মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির বলেন, আমদানি ব্যয়ের আকস্মিক স্ফীতি বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের চলতি খাতে ঘাটতি স্ফীত করে টাকার মূল্যমানে ২ দশমিক ৫ শতাংশ অবচিতির সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতির ওপরও চাপ বৃদ্ধি করেছে। রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় যেটুকু বেশি, তার পার্থক্যই বাণিজ্য ঘাটতি। আর চলতি হিসাবের মাধ্যমে দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝানো হয়। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানি ব্যয় বাড়ছে অস্বাভাবিক গতিতে। আর আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণেই চলতি হিসাবের ভারসাম্যে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে আমদানি ব্যয় বাড়লেও প্রকৃত আমদানির চিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, আমদানির সাথে বিনিয়োগ গতির সামঞ্জস্য নেই। দেশে যে পরিমাণ মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি তথ্য আসছে সে অনুযায়ী বিনিয়োগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। কাজেই আমদানির আড়ালে অর্থপাচার কিংবা আমদানি ব্যয় অতি মূল্যায়িত হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-নবেম্বর সময়ে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ মোট দুই হাজার ১৯৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে; যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৭২২ কোটি ৪০ লাখ ডলার। অন্যদিকে, এ সময়ে বিভিন্ন দেশে পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশের আয় হয়েছে এক হাজার ৪৩৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার; যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ে পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছিল ১ হাজার ৩৩৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এই হিসাবে সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৬০ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জুলাই-নভেম্বর সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৮৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এদিকে, চলতি মুদ্রানীতিতে অর্থবছর শেষে বাণিজ্য ঘাটতি ১ হাজার ৩১০ কোটি ৪০ লাখ ডলার দাঁড়াবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে; ৯৯৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ২০১১-১২ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯৩২ কোটি ডলার। আর গত অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল ৯৪৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। এ সময়ে সেবা খাতেও ঘাটতি বেড়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নবেম্বর সময়ে সেবা বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের এই পাঁচ মাসে ঘাটতি ছিল ১৪৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। মূলত বীমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য পরিমাপ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। জুলাই-নভেম্বর সময়ে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪৩ কোটি ২০ লাখ ডলারে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় সাত এবং পুরো বছরের চেয়ে চার গুণ বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই হিসাবে ঘাটতি ছিল ১৪৮ কোটি ডলারের মতো। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে ৪২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে চলতি অর্থবছরে জুলাই-নবেম্বর সময়ে মোট ১৩৮ কোটি ডলারের সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ১৫ শতাংশ কম। এর মধ্যে নিট এফডিআই এসেছে ৮৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আগের বছরের এই পাঁচ মাসে এসেছিল ৮৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে মোট যে এফডিআই আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যে অর্থ অবশিষ্ট থাকে তাকেই নিট এফডিআই বলা হয়।
×