ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ বাংলা ভাষায় মুসলিম অবদান

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ বাংলা ভাষায় মুসলিম অবদান

কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : খালাকাল্ ই্নসানা আল্লামাহুল বাইয়ান্Ñ তিনি (আল্লাহ) মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তাকে মনের ভাব প্রকাশ করার শিক্ষা দিয়েছেন। (সূরা আর রহমান : আয়াত ৩-৪), আমি (আল্লাহ) প্রত্যেক রাসূলকেই তার নিজ কওমের ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছি। (সূরা ইবরাহীম : আয়াত ৪) আর তার (আল্লাহর) নিদের্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশম-লী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। (সূরা রূম : আয়াত ২২)। কুরআন মজিদের এসব নির্দেশনা মুসলিম মননে প্রত্যেক জাতির বা সম্প্রদায়ের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান ও মর্যাদা দানের স্পৃহা গেঁথে দেয় এবং ইসলাম যেখানেই গিয়েছে সেখানকার অধিবাসীদের মাতৃভাষাকে সম্মান ও মর্যাদা দান করেছে। বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের পূর্বে এখানকার অধিবাসীদের কথা বলার বুলি দারুণ অবহেলিত অবস্থায় ছিল। ডক্টর শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন, মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোন কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীনবেশে পল্লী কুটিরে বাস করিতে ছিল। বাংলা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় বঙ্গীয় চাষার গানে কথঞ্চিত আত্মপ্রকাশ করিতে ছিল। প-িতেরা নস্যাদার হইতে নস্য গ্রহণ করিয়া শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তি করিতে ছিলেন এবং ‘তৈলাধার পাত্র’ কিংবা ‘পাত্রাধার তৈল’ এই লইয়া ঘোর বিচারের প্রবৃত্ত ছিলেন। সেখানে বঙ্গভাষার স্থান কোথায়? ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গ ভাষাকে প-িতম-লী দুর দুর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাঁড়ি ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকতেন। বঙ্গভাষা তেমনিই সুধী সমাজের কাছে অপাঙ্ক্তেয় ছিল, তেমনি ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিল। কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর অপেক্ষা করিয়া থাকে বঙ্গভাষা তেমনি কোন শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতে ছিল। মুসলমান বিজয় বাংলা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। বঙ্গ সাহিত্যকে একরূপ মুসলমানের সৃষ্টি বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। (দ্রষ্টব্য : শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন, বঙ্গ ভাষার ওপর মুসলমানের প্রভাব)। প্রাচীন বাংলার উৎস-স্বরূপ খুঁজতে গিয়ে কেউ কেউ চর্যাপদকে চিহ্নিত করেছেন। এই চর্যাপদ বৌদ্ধ সহজিয়াদের মধ্যে বন্দীদশায় ছিল- তাকে বাংলাভাষা বলাও দুরূহ। বাংলা ভাষায় যখন থেকে আরবী, ফারসি, তুর্কী শব্দ ভাষার তাগিদেই ব্যবহৃত হতে লাগল তখন থেকে এ ভাষা প্রাঞ্জল ও প্রাণবন্ত ভাষা হিসেবে ক্রমান্বয়ে বিকশিত হতে লাগল। মুসলিম শাসনে এসে তা প্রাণচাঞ্চল্যে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। ডক্টর আহমদ শরীফ মধ্যযুগের সাহিত্য সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন : তুর্কী আমলে রাজশক্তির পোষকতা পেয়ে বাংলা লেখ্য শালীন সাহিত্যের বাহন হলো। উল্লেখ্য, ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির পর থেকে আরবের বাইরের বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয় যার ব্যাপকতা সঞ্চারিত হয় ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে বিদায় হজের পরবর্তীকালে। ওই সময় চীন-সুমাত্রাগামী আরব বাণিজ্য নৌজাহাজে করে প্রচুর পা-িত্যের অধিকারী কোন কোন সাহাবি বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরে সফর বিরতি দিয়ে এখানে ইসলাম প্রচার করেন। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেননি। তাদের কারও কারও মাজার শরীফ এখনও চীনের ক্যান্টন নগরীর ম্যাসেঞ্জার মসজিদ প্রাঙ্গণে রয়েছে। অ্যানসেস্টরস গ্রেবইয়ার্ড নামে তা পরিচিত। বাংলাদেশে ব্যাপকহারে ইসলাম প্রচার শুরু হয় দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুর খিলাফতকালের মধ্যভাগ নাগাদ অর্থাৎ ৬৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। তারপর থেকে এখানে দলে দলে আরব, ইরান, ইরাক, তুরস্ক, মিসর, ইয়েমেন, খোরাসান প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ইসলাম প্রচারকের আগমন ঘটে। তারা বাংলাদেশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গিয়ে ইসলাম প্রচার করেন। এসব প্রচারক বাংলাদেশের মানুষের ভাষা শিখে সেই ভাষাতেই ইসলামের শিক্ষা সৌকর্য সবার সামনে তুলে ধরেন। তখন থেকেই আরবী, ফারসি, তুর্কি শব্দ বাংলা ভাষায় আত্মভূত হয়ে এ দেশের মানুষের মুখের ভাষার অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষা প্রকৃত অবয়ব লাভ করে এরই ফলে। বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন হয় ১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ ইবনে বখতিয়ার খিলজির বিজয়ের মধ্য দিয়ে। মুসলিম শাসন কায়েম হওয়ার পূর্বে এখানে যেসব রাজার শাসন ছিল তারা বাংলাভাষাকে নিষিদ্ধ ভাষা করে দিয়েছিল। বলা হয়েছিল অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানিচ/ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌবং নরকং ব্রজেৎ অর্থাৎ অষ্টাদশ পুরাণ, রামচরিত ইত্যাদি মানব ভাষায় (বাংলা) চর্চা করলে রৌরব নরকে যেতে হবে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতেই (১২০১ খ্রিঃ) বাংলাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার সুদূরপ্রসারী দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার আস্বাদনেও নিজেদের অভিসিক্ত করতে সমর্থন হন। বাংলার মুসলিম শাসকগণ বাংলার মানুষের খাদিম বা সেবক হিসেবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এসব শাসক সুলতান অভিধায় অভিহিত ছিলেন, তারা শাহে বাঙ্গালা, সুলতানে বাঙ্গালা খিতাবে ভূষিত ছিলেন এবং এ দেশের মানুষের জাতীয় পরিচয় ছিল বাঙ্গালিয়ান। এটাই সত্যি যে, স্বাধীন বাঙ্গালা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় সুলতানী আমলেই। বাংলাভাষা ও সাহিত্য আজকে যে সুবিস্তৃত দিগন্তব্যাপী ঔজ্জ্বল্য, এই যে জগতজোড়া খ্যাতি ও সমৃদ্ধি সৌরভে সমুজ্জ্বল তার স্থপতি নির্ণয়ে আমাদের যেতেই হয় বাংলার সুলতানী আমলে। আর সেই সুলতানী আমলই হচ্ছে বাংলার সোনালি যুগ। সে যুগ যেমন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সোনালি ছিল, তেমনি সামাজিক উন্নতির দিক দিয়েও সোনালি যুগ ছিল, শান্তি ও সমৃদ্ধির দিক দিয়েও সোনালি যুগ ছিল, শিক্ষা-দীক্ষার দিক দিয়ে যেমন সোনালি যুগ ছিল তেমনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেরও সোনালি যুগ ছিল। বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় সুলতানগণ বাংলার সব ধর্মের মানুষকে সমানভাবে উদ্বুদ্ধ ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। অন্যদিকে ব্রাহ্মণগণ বাংলাভাষা চর্চার প্রবল স্রোতকে রোধ করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যান। সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় কৃত্তিবাস রামায়ণ এবং কালীদাস মহাভারত অনুবাদ করলে ব্রাহ্মণ প-িতরা তাদের রৌরব নরকের অধিবাসী বলেই ক্ষান্ত হননি, তারা একটি বচন বানিয়ে জনগণের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেয় আর তা হচ্ছে : কৃত্তিবেশে, কালীদেসে আর বামুন ঘেঁষে/এই তিন সর্বনেশে। চলবে... লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা)
×