ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের কৃষির প্রতি নজর দেয়া উচিত

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের কৃষির প্রতি নজর দেয়া উচিত

জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে বিশ্বের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সুইজারল্যান্ডের ডাবোস শহরে। সম্মেলনটির শিরোনাম : ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ অর্থাৎ বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম। এতে বিশ্বের তাবত বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী লোকেরা। সবার নামের দরকার নেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন অনেক বিশ্ব নেতার মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ধনীদের মধ্যে কে উপস্থিত ছিলেন না, কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের কে উপস্থিত ছিলেন না এই প্রশ্ন অবান্তর। টেলিভিশনভর্তি খবর এদের। অন্তত দিন তিনেক। একজন উপস্থিত ছিলেন এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ধনী। তার নাম অনিল আম্বানি, ধীরুভাই আম্বানির পুত্র, বিখ্যাত রিলায়েন্স কোম্পানির মালিক। তার নাম, তার বাড়ি বিশ্বব্যাপী আলোচনার বিষয়বস্তু। তিনি কত টাকার মালিক এই আলোচনাও অবান্তর। তবে পাঠকদের কাছে তার একটি খবর অবান্তর মনে হবে না। গত ৮ ডিসেম্বর ‘ফ্রন্ট লাইন’ নামীয় বিখ্যাত ম্যাগাজিনে একটি খবর ছাপা হয়। তাতে দেখা যায় সুপ্রীমকোর্ট ভারত সরকারকে সে দেশের ‘শ্রেষ্ঠ’ ঋণখেলাপীর তালিকা দিতে হুকুম দেয়। কিন্তু সরকার এখনও তা কোর্টকে দেয়নি। কারণ, হিসেবে অনেকে সন্দেহ করেন একটি বিষয়কে। ‘ক্রেডিট সুইস’ নামীয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠান বলছে, ‘রিলায়েন্স কোম্পানি’ বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে লাখো কোটি রুপিরও অধিক ঋণী এবং তারা শীর্ষ ঋণখেলাপীদের অন্যতম। পত্রিকাটির খবর মতে শীর্ষ ঋণখেলাপীদের মধ্যে ‘আদানি গ্রুপ’সহ আছে আরও বিখ্যাত কোম্পানি। এসব কারণেই নাকি ভারত সরকার তাদের নাম প্রকাশ করছে না। শত হোক শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপী তিন লাখ কোটি রুপিরও অধিক বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ধার করেছে। অনুমান করতে অসুবিধে নেই তারাও বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। আমাদের দেশ থেকে কেউ গেছেন কী-না তা আমার জানা নেই। এই অজ্ঞতার জন্য আমি দুঃখিত। আমি এই খবরটি দিয়ে শুরু করলাম একটি কারণে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন একটি মুখরোচক আলোচনার বিষয়। তাদের জ্ঞাতার্থে এই তথ্যটি দিলাম যে, প্রতিবেশী দেশও এই ক্ষেত্রে কম যায় না। আরেক প্রতিবেশী পাকিস্তান ও চীনের খবর আজকে দিলাম না, অন্যদিনের জন্য সংরক্ষিত রাখলাম। আজকের বলার বিষয় অন্য একটা। তাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব এবং ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ও প্রধান নির্বাহীরা বক্তৃতা দিলেন কী? প্রধান নির্বাহীরা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। তারা বক্তৃতা করলেন। কার সামনে? শত শত কোটি টাকার মালিকদের সামনে। বিষয়বস্তু কী? বিষয়বস্তু: উন্নয়ন, অসাম্য, বৈষম্য এবং দারিদ্র্য। খুবই মজার বিষয় নয় কী? প্রতি বছর তারা এসব বিষয়ে কথা বলেন। আর ‘অক্সফামের’ তথ্যানুযায়ী প্রতি বছর যে সম্পদ বিশ্বে তৈরি হয় তার ৯৯ শতাংশই হস্তগত করেন এই বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এবং তাদের প্রধান নির্বাহীরা। আরও মজার বিষয় এই যে, তারা জিডিপির কথা বলেন, বিনিয়োগের কথা বলেন, কারিগরি জ্ঞানের কথা বলেন, জলবায়ুর কথা বলেন; কিন্তু কৃষি ও কৃষকের কথা বলেন না। যে কৃষি এই সমস্ত নির্বাহী এবং ধনাঢ্য ব্যক্তির খাবার যোগায়, চাল, গম থেকে শুরু করে ফল-মূল, শাক-সবজি, মাছ-মাংস যোগায় তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা কেউ বলেন না গুরুত্ব দিয়ে। অনেক খাবার, খাদ্যবস্ত্র যোগান দেয় আমাদের মতো উন্নয়নশীল ও গরিব দেশের কৃষকরা। অতীব দুঃখের বিষয় এই ধনাঢ্য ব্যক্তিরা কৃষি ও কৃষকের কথা বলেন না। কখনও কী শুনেছি ‘রিলায়েন্সে’র নির্বাহীদের মুখ দিয়ে কেন ভারতের হাজার হাজার কৃষক কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে আত্মহত্যা করছে। সে দেশের সরকার পেরেশান, বিরোধী দল সোচ্চার; কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানি এবং নব্য ধনী, বিশ্বধনী, এশীয় ধনী ব্যক্তিরা তাদের কথা বলেন না। এমনি এক অবস্থা আমাদের দেশেও। সারা বছর ব্যবসায়ীদের, ধনী ব্যক্তিদের, চেম্বার নেতৃবৃন্দের কত বক্তৃতার কথা কাগজে পাঠ করি, কই কৃষি ও কৃষকের কথা তো সেখানে নেই। বিশ্ব ধনীদের অনুকরণ করে আমাদের ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও ‘জিডিপি’, মাথাপিছু আয়, বিনিয়োগ, অবকাঠামো, বিদ্যুত ইত্যাদি সম্পর্কেই কথা বলেন বেশি। কৃষিতে যে বিনিয়োগ নেই, কৃষি উৎপাদনশীলতা যে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে এ সম্পর্কে তারা কী ভাবছেন এটা তো আমরা বুঝতে পারছি না। চালের দাম কেজিপ্রতি কত হওয়া উচিত এর কথা কি কেউ বলছেন। এই শূন্যতার মধ্যে দুইদিন আগে সরকারের দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী চালের দাম কেজিপ্রতি কত হওয়া উচিত সে সম্পর্কে তাদের মত দিলেন। দুইজনই বললেন ৪০ টাকার কথা। কেন ৪০ টাকা? কেন ১০০ টাকা নয়, কেন ৩০ টাকা নয়? এই প্রশ্নের জওয়াব হওয়ার দরকার। জওয়াব হওয়ার দরকার কৃষকের দৃষ্টিকোণ থেকে। এটা ন্যায্য দাবি। তারা ন্যায্যমূল্য চায়। পাট, ধান, বেগুন, টমেটো, দুধ, মাছ-মাংস থেকে শুরু করে যাবতীয় কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য চায়। আমার মতে এখানে ইস্যু ‘ন্যায্যমূল্য’ নয়। এটা ‘সমাজতান্ত্রিক’ ধারণা। এই ধারণা এখন অচল। ন্যায্যমূল্য সরকার নির্ধারণ করে। অথচ আমরা ‘বাজার অর্থনীতির’ অনুসরণকারী। এই বাজারে চাহিদা ও সরবরাহ দাম ঠিক করবে। অতএব চালের দামও বাজার নির্ধারণ করবে। বন্যায় ধানের ক্ষতি হয়েছে, চালের দাম বাড়বে। অথচ বাড়লে চিৎকার। চিনির ঘাটতিতে যদি চিনির দাম বাড়তে পারে তাহলে চালের ঘাটতিতে চালের দাম বাড়বে না কেন? বাড়া উচিত। তাই নয় কী? না, বাজার অর্থনীতি চালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ এটা না হলে মানুষ উপোস করে মারা যাবে। অতএব এর দাম নিচে রাখতে হবে। কিন্তু কত নিচে? মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কত? ক্রয়ক্ষমতা অনেকের নেই। তাদের দিতে হবে ভর্তুকির চাল, বিশাল ভর্তুকির চাল। অবশ্যই ভারতের মতো এক টাকা কেজিতে চাল নয়। তাহলে কত টাকার? এসব হচ্ছে প্রশ্ন। মূল প্রশ্ন অতএব একটা। কৃষি একটা লোকসানি কারবার। ধান-চাল ফলালে অথবা যে কোন ফসল ফলানে কৃষকের লোকসান। এই লোকসানি কারবার কৃষক কেন করবে? তাও দিনের পর দিন। এর একটা উত্তর আছে। এমন কিছু লোক আছে যাদের জমি চাষ করা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। তাই তারা ভোরে নামাজের পূর্বে ঘুম থেকে উঠে মাঠে যায়। বিকেল বেলা নদীতে স্নান-গোসল করে। সকালের নাস্তা ক্ষেতেই তারা খায়। সন্ধ্যায় ভাত খেয়ে কোন আলো না জ্বালিয়ে তারা নিদ্রায় যায়। এই হচ্ছে তাদের জীবন। এমন একটা পেশার কাজ লোকসানি। ভাবা যায় তার ক্ষেতে সেচের জল নেই, নদী নেই, খাল-বিল নেই যে, এসব থেকে সেচের জল পাওয়া যাবে। গাছ নেই যে তার নিচে শুয়ে বিশ্রাম নেবে। এর পাতা পচিয়ে সার তৈরি করবে। গরু নেই যে, সে তার গোবর ব্যবহার করবে। ঘাস নেই যে, সে গরু পালবে। এমন একটা বৈরী পরিবেশে সে দিনের পর দিন হালচাষ করে আমাদের পেটের ভাত যোগাচ্ছে, আমাদের ভুক্ত রাখছে, পুষ্টি যোগাচ্ছে। মেধা দান করছে। আজকাল কিছুটা রক্ষা। সরকার ভর্তুকি দিয়ে কিছু সাহায্য করে। কিন্তু নদী-নালা, খাল-বিলে জল না থাকলে কৃষিতে জল কোত্থেকে আসবে? মাটির নিচের জলের স্তর আরও গভীরে চলে যাচ্ছে। বৃষ্টি অফুরন্ত নয়। এই হচ্ছে কৃষির অবস্থা। লোকসানি একটা কারবার। এর কথাÑ বিস্ময়ের বিষয়Ñ কেউ বলে না। কৃষকের ছেলেরাও কৃষিতে নিয়োজিত থাকতে চায় না। সব যেতে চায় সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে। জমির চিন্তা তার মাথায় নেই। দেশে থাকলে অল্প শিক্ষা হলেও সবাই সরকারী অফিসে চাকরি চায়। আগে পিয়ন হতে পারত তারা। কিছু বেতনও ছিল। এখন সব আউট সোর্সিং অল্প টাকায়। তবু তারা তা চায়। কৃষিতে শ্রম দেয়া মানে বোকামি। কৃষি সকলের করুণার বস্তু। সার আনতে গেলে সারের ডিলারের করুণার পাত্র। কীটনাশকেও তাই। আজকাল শ্রমিক লাগলে সেখানেও শ্রমিকদের করুণার পাত্র কৃষক। ফসল বিক্রির সময় তো বটেই। অতএব কৃষির পেশা ছাড়। ভালই তো! কৃষি থেকে লোক সরে আসছে। কৃষি শ্রমিকমুক্ত হচ্ছে। ঢুকছে যন্ত্রপাতি। যান্ত্রিকীকরণ করা হচ্ছে কৃষি। কিন্তু তাতে তো কৃষি লাভজনক হবে না। তাতে বরং খরচ বাড়বে। আর যান্ত্রিকীকরণ বাংলাদেশে কঠিন। খ- খ- জমি। মালিকানা ছোট ছোট। এর যান্ত্রিকীকরণ কঠিন এবং তাকে এভাবে লাভজনক করা হবে আরও কঠিন। ইতোমধ্যে কৃষির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে। জন্মহারের তুলনায় উৎপাদনশীলতার হার কম দেখা যাচ্ছে। জমির ‘টপ সয়েল’ থাকে বলে তা ধীরে ধীরে অনুর্বর হচ্ছে। এক সময় কৃত্রিম সার ব্যবহারের ফলে তা বালুচরে পরিণত হতে পারে। প্রাকৃতিক সার উঠেই যাচ্ছে। তাহলে দেখা যাচ্চে সমূহ বিপদ ভবিষ্যতে। প্রচুর গম আমদানি করতে হয় আমাদের। কারণ গম বেশি দেশে হয় না। আবার সামান্য বন্যা হলে ফসলের যে ক্ষতি হয় তা পোষাতে বহু বেগ পেতে হয়। অর্থাৎ পেশাটাই লোকসানি। এর থেকে বের হওয়ার উপায় কী? ৮০ টাকা দরের চাল, না ১০০ টাকা দরের চাল, না ৩০ টাকা দরের চাল। কী করলে কৃষকও বাঁচে, তার পেশাও লাভজনক হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ ভোক্তারাও খেয়ে-পরে বাঁচে এই চিন্তা এখন থেকেই করতে হবে। কোন শিল্পায়নই কাজে লাগবে না যদি না আমরা কৃষিকে লাভজনক পেশায় পরিণত করতে পারি। কী ভাবছেন দেশের বুদ্ধিজীবীরা? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×