ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অভিযুক্ত শিক্ষক ঢাবির হল প্রাধ্যক্ষ ॥ প্রশাসন বলছে অভিযোগ ভিত্তিহীন

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

অভিযুক্ত শিক্ষক ঢাবির হল প্রাধ্যক্ষ ॥ প্রশাসন বলছে অভিযোগ ভিত্তিহীন

সোহেল তানভীর ॥ নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত শিক্ষককে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া সংক্ষেপে তালাবা নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্ত ওই শিক্ষকের জঙ্গী কানেকশনের তথ্য মেলে। তবে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, অভিযোগের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ ভিত্তিহীন। প্রাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ওই শিক্ষক হলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান। গত ৪ ফেব্রুয়ারি তাকে বিশ^বিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হল প্রাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় তুলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি নীল দলের সিনিয়র শিক্ষকরা। এছাড়া ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অন্তত পাঁচটি তদন্ত রিপোর্ট রয়েছে। বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, ওই শিক্ষক সিনিয়র ও উপযুক্ত হওয়ায় তাকে প্রাধ্যক্ষ করা হয়েছে। সাইফুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে গবেষণা প্রবন্ধ চৌর্যবৃত্তি, অন্যের প্রবন্ধ নিজের নামে প্রকাশ, জঙ্গীবাদে সহায়তা করাসহ একাধিক অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে তদন্তাধীন। বিশ^বিদ্যালয় প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ তদন্তাধীন থাকা একাধিক অভিযোগের বিষয়ে স্বীকার করেছেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে এমফিল পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তার নিজের বিভাগের এ্যাকাডেমিকসহ সকল পরীক্ষা ও থিসিস সুপারভাইজিংয়ের কার্যক্রম থেকে তিন বছরের জন্য অব্যাহতিও দেয়া হয়। সাইফুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে বিশ^বিদ্যালয়ে তদন্তাধীন অভিযোগগুলোÑ ঢাকা ইউনিভার্সিটি জার্নাল অব পারসিয়া এ্যান্ড উর্দু নামক বিভাগীয় গবেষণা জার্নালে ‘বাংলা কবিতায় ফার্সি ভাবধারা’ শিরোনামে ফার্সি ভাষায় প্রবন্ধে ছৈয়দ আহমদুল হকের ‘প্রবন্ধ বিচিত্রা’ নামক গ্রন্থ থেকে লেখা চুরি করা। অন্যটি হলো সাবেক সচিব জেহাদুল ইসলামের ফার্সি ভাষায় লিখিত ‘দিওয়ান-ই-মঈনুদ্দিন’ নামক গ্রন্থ নিজের নামে প্রকাশ করা। বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সময় এই দুই অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান বিশ^বিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ। এছাড়া এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমফিল পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত বছরের ১৬ আগস্ট বিশ^বিদ্যালয়ের এক সিন্ডিকেট সভায় সকল পরীক্ষা এবং থিসিস সুপারভাইজিংয়ের কার্যক্রম থেকে তিন বছরের জন্য অব্যাহতি দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্তে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ ॥ ২০১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ‘ঢাবি শিক্ষকের জঙ্গী কানেকশনের তথ্য তদন্ত প্রতিবেদনে, ফার্সি ও উর্দু বিভাগের এই শিক্ষক জঙ্গী সংগঠন তালাবার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত’ শিরোনামে দৈনিক জনকণ্ঠে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়া সংক্ষেপে তালাবা নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে ওই শিক্ষকের তৎপরতা থাকার তথ্য মিলেছে। সংগঠনের তৎপরতায় সহায়তা করার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর এবং ফার্সি ও উর্দু বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাওলানা ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে। মাওলানা সাইফুল ইসলাম খান পিরোজপুরের কুখ্যাত রাজাকার ও পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের ডেপুটি আমির মাওলানা আব্দুর রহিমের অনুসারী বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে। জানা গেছে, বিশ^বিদ্যালয় উপাচার্য প্রাধ্যক্ষ নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে যাকে যোগ্য মনে করেন তাকে নিয়োগ দেন। এক্ষেত্রে কোন ধরনের আবেদন করতে হয় না। হল প্রাধ্যক্ষ তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। একজন শিক্ষক দুই মেয়াদে মোট ছয় বছর হল প্রাধ্যক্ষ থাকতে পারেন। স্যার এ এফ রহমান হলের সদ্য সাবেক প্রাধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক ড. মোঃ আফতাব উদ্দিন। তার মেয়াদ তিন বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তাকে সরিয়ে অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম খানকে প্রাধ্যক্ষ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সদ্য সাবেক হল প্রাধ্যক্ষ অভিযোগ করছেন বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের তোষামোদি না করার কারণে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর কয়েকটি অভিযোগ তদন্তাধীন। কিন্তু শাস্তির বদলে তাকে পুরস্কৃত করা হলো। এতে অপরাধীরা আরও উৎসাহ পাবে। এই ঘটনা বিশ^বিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করবে এবং বিশ^বিদ্যালয়ের দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে মানুষ নিরুৎসাহিত হবে। এ বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, অনেকে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ তুলেছেন। তবে কোন অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিতর্কিত সাবেক উপাচার্যকে খ-কালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শামসুন্নাহার হলের ছাত্রীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত সেই বিতর্কিত সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরীকে খ-কালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতারা। এই নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান এই নিয়োগ বাতিল করেন। জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, বিভাগ এই নিয়োগ দিয়েছে। পরে যখন এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয় তখন এই নিয়োগ বাতিল করেছি। জানা গেছে, ২০১৫ সালে তার নামে গঠিত ট্রাস্ট ফান্ড শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বাতিল করে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। সে সময় বিতর্কিত এই শিক্ষকের নামে ভবিষ্যতে ট্রাস্ট ফান্ড গঠন না করারও সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। ২০০২ সালের ২৩ জুলাই মধ্যরাতে শামসুন্নাহার হলের ছাত্রীদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রদলের ক্যাডার দিয়ে নির্যাতনের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী। সে সময় তার বিরুদ্ধে হামলার নির্দেশ দেয়ার অভিযোগ উঠেছিল। এরপর থেকে প্রতিবছর সেই নিন্দনীয় ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে ‘শামসুন্নাহার হল নির্যাতন’ দিবস পালিত হয়। দিনটিতে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন আলাদা আলাদা কর্মসূচী পালন করে থাকেন। শামসুন্নাহার হলে ছাত্রীদের আন্দোলন দমনে পুলিশ ও ছাত্রদল ক্যাডারদের হামলায় প্রায় দুই শ’ ছাত্রী আহত হয়। পরদিন এ হামলার ‘নির্দেশদাতা’ উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরীর পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ-সমাবেশ চলাকালেও পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হয় প্রায় পাঁচ শ’ শিক্ষার্থী। এছাড়া পাঁচ শিক্ষক ও ১০ সাংবাদিকও আহত হন। পরে শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ওই বছরের পহেলা আগস্ট তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
×