ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা বিশ্বে নজিরবিহীন;###;মামলা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে ॥ সংসদে প্রধানমন্ত্রী

বিএনপি-জামায়াত জোট বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বিএনপি-জামায়াত জোট বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল

সংসদ রিপোর্টার ॥ অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা ২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলাকে ‘পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন ভয়াবহ নিষ্ঠুর হামলা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, সেই সময়ের ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিরোধী দল নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করেছিল। গ্রেনেড হামলার পর যখন জানতে পারে যে, আমি বেঁচে আছি, তখন সেই রাতেই হামলাকারী তাজউদ্দিনসহ আরও কয়েকজনকে ক্ষমতাসীনরা দেশ থেকে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। ভয়াবহ এ হামলা মামলায় মোট ২২৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মামলাটি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার জাতীয় সংসদে টেবিলে উত্থাপিত প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ও গ্রেনেড হামলায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে প্রাণে বেঁচে যাওয়া বেগম নাসিমা ফেরদৌসীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই সময়ের ক্ষমতাসীন দল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিরোধী দল চিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র করেছিল। এ হামলায় মহিলা লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আহত শত শত দলীয় নেতাকর্মী দুঃসহ সেই স্মৃতি আজও শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে। তিনি বলেন, এ মামলাটি বর্তমানে রায় দেয়ার পূর্ববর্তী ধাপ অর্থাৎ যুক্তিতর্ক পর্যায়ে রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫২ জনের মধ্যে ১৮ আসামির যুক্তিতর্ক শেষ হয়েছে। অবশিষ্ট আসামিদের যুক্তিতর্ক শেষ হলেই এ মামলার রায়ের দিন ধার্য করা হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার একজন উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু ও তার ভাই মোহাম্মদ তাজউদ্দিন এ মামলার অন্যতম আসামি। গ্রেনেড হামলা চলাকালে টিয়ার সেল ছুঁড়ে হামলাকারীদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করা হয় এবং গ্রেনেড হামলার পর যখন জানতে পারে আমি বেঁচে আছি, তখন সেই রাতেই তাজউদ্দিনসহ আরও কয়েকজনকে দেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় হয়। যেখানে গ্রেনেড হামলা হয় সেই স্থানের সকল আলামত পরদিনই সরিয়ে ফেলা হয় ও রাস্তা ধুয়ে ফেলে অন্যান্য আলামতও নষ্ট করা হয়। গ্রেনেড হামলার ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন গ্রেনেড হামলা মামলার প্রকৃত আসামিদের আড়াল করার জন্য তথাকথিত জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে চার্জশীট দাখিল করে। পরবর্তীতে জানা যায়, জজ মিয়াকে এ নাটকে অংশ নেয়ার জন্য তাকে বেশ কিছুদিন মাসিক ভাতাও দেয়া হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ৬১ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করে যেনতেনভাবে তদন্ত সম্পন্ন করে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত শেষে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সকল আসামিকে অন্তর্ভুক্ত করে চার্জশীট প্রদান করে এবং ২০১৪ সাল থেকে আরও ১৬৪ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। এভাবে মোট ২২৫ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করে মামলাটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি ॥ স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদারের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির ফলে অনগ্রসর পার্বত্যাঞ্চল জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার মূল ধারার সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং এ এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য দেশীয় অর্থায়নে ও বৈদেশিক সহায়তায় নেয়া হয় নানা প্রকল্প। যার সফল বাস্তবায়নের সুফল জনগণ পেতে শুরু করেছে। তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, সামাজিক নিরাপত্তা, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, বিদ্যুত, যোগাযোগ, অবকাঠামো নির্মাণ, সক্ষমতা বৃদ্ধি, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চা ও বিকাশসহ বিভিন্ন প্রকার আর্থ-সামাজিক কর্মকা-ের উন্নয়নে এ মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে, যার অগ্রগতি খুবই আশাব্যঞ্জক। সংসদ নেতা বলেন, চুক্তির বাস্তবায়ন কার্যক্রম বেগবান করার লক্ষ্যে সম্প্রতি সংসদ সদস্য আবুল হাসনাত আবদুল্লাহকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। এছাড়া ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্কফোর্স, খাগড়াছড়ির কার্যক্রম বেগবান করার লক্ষ্যে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ॥ সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এম আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সন্ত্রাস ও সহিংস জঙ্গীবাদ দমনে আমাদের সরকার জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে আসছে। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় যথাযথ অংশগ্রহণ এবং বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহার করে যাতে কেউ সন্ত্রাস বা জঙ্গীবাদ সম্পর্কিত কোন কর্মকা- করতে না পারে, সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকার সদা সচেতন। এ কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি দায়িত্বশীল ও নির্ভরযোগ্য রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, অভিবাসন, সন্ত্রাসবাদ, জলবায়ু পরবর্তন ছাড়াও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন ইস্যুতে বাংলাদেশের সক্রিয় ও দৃশ্যমান ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক যুগান্তকারী ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ স্বীকৃতি বিশ্বব্যাপী জাতির পিতার নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রদর্শন বিষয়ে আলোচনা ও গবেষণার সুযোগ প্রশস্ত করবে। এ স্বীকৃতি অর্জনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বলতর হয়েছে। দেশ ও জাতির জন্য এ অর্জন এক বিরল সম্মান। এক বছরেই ১০ লক্ষাধিক কর্মী বিদেশে প্রেরণ ॥ সরকার দলীয় সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ঘোষণা করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টায় নতুন ৬৮টি দেশ কর্মী প্রেরণের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে আমরা ১৬৫টি দেশে কর্মী রফতানি করছি। তিনি বলেন, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মাত্র ৯৭টি দেশে কর্মী প্রেরণ হতো। আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিগত ৯ বছরে মোট ৫১ লাখ ৯৮ হাজার ৯১৪ জন কর্মী বিদেশে গমন করেছে। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালেই ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন কর্মী বিদেশে প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত বহুমাত্রিক কার্যকরী ও দূরদর্শী পদক্ষেপের ফলে বিদেশে কর্মী গমনের হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ॥ সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্য বেগম উম্মে রাজিয়া কাজলের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালী জাতির জীবনে সবচেয়ে আলোকিত অধ্যায় মহান মুক্তিযুদ্ধ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে এদেশের সর্বস্তরের জনগণ তাদের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দেশের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের এ আত্মত্যাগ বাঙালী জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আওয়ামী লীগ সরকার মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এ অসামান্য অবদানের প্রতি সম্মান দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কল্যাণে বিভিন্ন কল্যাণমুখী কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে আসছে। তিনি জানান, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এক লাখ মুক্তিযোদ্ধা মাত্র ৯শ’ টাকা করে ভাতা পেত। এটা বৃদ্ধি করে বর্তমান অর্থবছরে এক লাখ ৮৪ হাজার ৯৬১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ১০ হাজার টাকা করে ভাতা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া গত অর্থবছর থেকে প্রত্যেক সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা/ পরিবারকে প্রদত্ত মাসিক ভাতার সমপরিমাণ ১০ হাজার টাকা হারে বছরে দুটি উৎসব ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। তিনি জানান, ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে এ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়স বৃদ্ধি এবং তাদের পোষ্য/নাতি-নাতনিদের চাকরি সংক্রান্ত বিষয়ে প্রত্যয়ন কার্যক্রম শুরু হয়। এ পর্যন্ত নিয়োগ সংক্রান্ত ১৬ হাজার ৯৩৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রত্যয়ন করা হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ বৃদ্ধি ॥ জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমামের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সকল বেতন গ্রেডে মূল বেতন প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। সকল কর্মচারীদের মূল বেতনের শতকরা ২০ ভাগ হারে বাংলা নববর্ষভাতা চালু করা হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ম্যানুয়াল বেতন নির্ধারণ পদ্ধতির পরিবর্তে অনলাইনে বেতন নির্ধারণ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। তিনি জানান, কর্মচারীদের অবসরকালে অর্জিত ছুটি পাওনা সাপেক্ষে ১২ মাসের ছুটি নগদায়নের স্থলে ১৮ মাসের ছুটি নগদায়নের সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। শতভাগ পেনশন সমর্পণকারী কর্মচারীর মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী ও প্রতিবন্ধী সন্তানকে আজীবন এবং বিপতœীক স্বামীকে সর্বাধিক ১৫ বছর মাসিক চিকিৎসা ভাতা ও বছরে দুটি উৎসব ভাতা প্রদানের সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। সবনি¤œ মাসিক পেনশন ৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া যেসব পদে পদোন্নতির সুযোগ নেই বা খুবই সীমিত সেসব পদে পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে অর্গানোগ্রাম পুনর্বিন্যাস করার প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
×