ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া

যে কোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ॥ জেল বা সাজার ভয় দেখিয়ে কাজ হবে না

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

যে কোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ॥ জেল বা সাজার ভয় দেখিয়ে কাজ হবে না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় কোন দুর্নীতি হয়নি দাবি করে এ মামলায় ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। বুধবার বিকেলে গুলশান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আদালত রায় দেয়ার আগেই শাসক দলের নেতারা চিৎকার করে বলে বেড়াচ্ছেন, আমার নাকি জেল হবে। যেন বিচারক নয়, সরকারই রায় ঠিক করে রেখেছে। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তিনি বলেন, আপনাদের খালেদা জিয়া কোন অন্যায় করেনি। কোন দুর্নীতি আমি করিনি। ন্যায়বিচার হলে আমার কিছু হবে না, আমি বেকসুর খালাস পাব। আর যদি শাসক মহলকে তুষ্ট করার জন্য অন্য কোন রায় হয়, তাহলে তা কলঙ্কের প্রতীক হয়ে থাকবে। খালেদা জিয়া বলেন, আমাকে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখতেই এ মামলায় সাজানো রায় দেয়া হচ্ছে। আমাকে রাজনীতি ও নির্বাচনের মাঠ থেকে দূরে রাখতে আদালতকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে তিনি বলেন, আমি যে কোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত। জেল বা সাজার ভয় দেখিয়ে কাজ হবে না। আমি মাথানত করব না। জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি থেকে পিছু হটব না। আর আমাকে জেলে পাঠালেও সরকারের খালি মাঠে গোল দেয়ার ও একদলীয় শাসন দীর্ঘায়িত করার খায়েশ পূরণ হবে বলে আমি মনে করি না। খালেদা জিয়া বলেন, দেশে এখন ন্যায়বিচার নেই। আমি যেখানেই থাকি যেমন থাকি দেশবাসীকে কখনও ছেড়ে যাব না। আল্লাহই আমার একমাত্র ভরসা। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা চাপের মুখে পদত্যাগ করেছেন উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, আদালত চাপ উপেক্ষা করে আমার মামলার রায় দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে আমি সন্দিহান। তিনি বলেন, জনগণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, হেনস্তা ও অপমানের ভয়ে নাগরিক সমাজ স্বাধীন মত প্রকাশের সাহস হারিয়ে ফেলেছে। এই দুঃসহ অবস্থার মধ্যেও একদল উচ্ছিষ্টভোগী স্তাবকের গুণকীর্তনে মানুষ অতীষ্ট হয়ে উঠেছে। দলীয়করণ, ভীতিপ্রদর্শন ও নানা অপকৌশলের মাধ্যমে দেশের বিচার ব্যবস্থাকে আজ প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। খালেদা জিয়া বলেন, দেশের অসংখ্য মানুষ হামলা, মামলা, হুলিয়া, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আজকের দুঃশাসনের হাত অনেক নিরপরাধ মানুষের রক্তে রঞ্জিত। এই রক্তপিপাসু শাসকদের কবল থেকে গণতন্ত্রকে মুক্ত করা সহজসাধ্য কাজ নয়। কিন্তু আমরা হার মানিনি। জনগণ পরাজিত হবে না। দুঃশাসন একদিন থাকবে না। কিন্তু যে কলঙ্কের ইতিহাস তারা রচনা করছে সেই কলঙ্কের ছাপ চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। আমার বিরুদ্ধে তেমনি এক মামলায় আগামীকাল (আজ বৃহস্পতিবার) রায় হবে। এই রায়কে কেন্দ্র করে শাসক মহল আমাদের চেয়ে বেশি অস্থির ভীত হয়ে জনগণের চলাচলের অধিকার প্রতিবাদের অধিকার সভা-মিছিলের সাংবিধানিক অধিকার, প্রশাসনিক নির্দেশে বন্ধ করা হয়েছে। ভিত্তিহীন ও মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদের ভয়ে ভিত হয়ে এ হীন পথ খুঁজে নিয়েছে সরকার। সারাদেশে তারা বিভীষিকা ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। জনগণের প্রতিবাদের সম্ভাবনাকে তারা এতটাই ভয় পায়! বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, রাজনীতির অঙ্গনে পা রাখার পর থেকে আমি জনগণকে যতটা সময় দিয়েছি, পরিবার ও সন্তানদের ততটা সময় দিতে পারিনি। কারাগারে থাকতে আমি আমার মাকে হারিয়েছি। অফিসে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় আমি একটি সন্তান হারিয়েছি। আরেকটি সন্তান নির্যাতনে পঙ্গু হয়ে দূরদেশে এখনও চিকিৎসাধীন। আমার এই স্বজনহীন জীবনেও দেশবাসীই আমার স্বজন। আল্লাহ্ আমার একমাত্র ভরসা। আমি যেমন থাকি, যেখানেই থাকি যতক্ষণ বেঁচে থাকব দেশবাসীকে ছেড়ে যাব না। খালেদা জিয়া বলেন, দেশবাসীর প্রতি আমার আবেদন, আমাকে আপনাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হলেও বিশ্বাস করবেন আমি আপনাদের সঙ্গেই আছি। আপনারা গণতন্ত্রের জন্য, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, জনগণের সরকার কায়েমের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। দেশে সব সময়ই ছাত্র-যুবক তরুণেরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সৈনিক, ছাত্র-জনতার মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। এই ছাত্র-জনতা আন্দোলনেই স্বৈরাচার পরাজিত হয়েছে। আজ গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সেই ছাত্র, জনতাকে আহ্বান জানাই এগিয়ে আসতে। বিএনপি, ২০ দলসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক দল, কৃষক শ্রমিকসহ সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে আমি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। লিখিত বক্তব্যে খালেদা জিয়া আরও বলেন, দেশজাতির চরম সঙ্কটের সময়ে আজ আপনাদের মাধ্যমে প্রিয় দেশবাসীর উদ্দেশে কিছু কথা নিবেদন করতে চাই। ভাষা শহীদের মাসে মাতৃভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, আমি শুরুতেই তাঁদের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। আমরা সকলেই জানি, এ দেশের জনগণ গণতন্ত্রপ্রিয়। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই এই জাতিকে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পথে এগিয়ে দিয়েছিল। তাই স্বাধীনতার পর জনগণের সব অধিকার কেড়ে নিয়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হলে এ দেশের মানুষ তা মেনে নেয়নি। সে কারণেই দেশের জনগণের প্রিয় নেতা জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলেন। জনগণকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কেড়ে নেয়া সব অধিকার। এরপর আবারও স্বৈরশাসন চেপে বসলে এদেশের মানুষ প্রতিবাদ-মুখর হয়ে উঠে। আমরা ছাত্র, তরুণ, পেশাজীবীসহ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্রের জন্য আপোসহীন সংগ্রাম শুরু করি। দেশের ছাত্র-জনতা বুকের রক্ত ঢেলে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনে। জরুরী অবস্থা জারির নামে দেশে অগণতান্ত্রিক শাসনকেও এদেশের সাধারণ মানুষ মেনে নেয়নি। ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের কারণেই তাদের শাসন দীর্ঘায়িত করার খায়েশ পূরণ হয়নি। খালেদা জিয়া বলেন, গণতন্ত্রের প্রতি এদেশের জনগণের প্রবল অনুরাগের কারণেই আমরা রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্রকেই বেছে নিয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এদেশের মানুষের। তারা রক্ত ঢেলে দিয়ে গণতন্ত্র এনেছে। বারবার সেই গণতন্ত্র এবং এদেশের মানুষের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। দেশের জনগণ তাদের কষ্টার্জিত গণতন্ত্র এবং অধিকারগুলো আজ আবার হারিয়ে ফেলেছে। তথাকথিত উন্নয়নের নামে শোষণ, বঞ্চনা, লুটপাট ও অত্যাচারের এক দুঃসহ দুঃশাসন আজ জনগণের বুকের ওপর চেপে বসেছে। এই স্বৈরশাসন জনগণকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তারা মানুষকে আজ ভাতে মারছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। মানুষের কাজের সংস্থান নেই। চাকরির খোঁজে লুকিয়ে বিদেশে যাবার পথে আমাদের তরুণেরা সাগরে ডুবে মরছে। খালেদা জিয়া বলেন, আমি কম বয়সেই স্বামী হারিয়েছি। দেশের জন্য জিয়াউর রহমান জীবন দিয়েছেন। দলের নেতাকর্মীদের দাবিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় রাজনীতির বিপদসঙ্কুল পথে পা বাড়িয়েছি। আরাম-আয়েশ, সুখ-শান্তি ও নিন্তরঙ্গ জীবন বিসর্জন দিয়েছি। আমার প্রিয় দেশবাসী আমাকে তার প্রতিদান দিয়েছে অপরিমেয় ভালবাসায়। প্রতিবারের নির্বাচনে পাঁচটি করে আসনে আমাকে নির্বাচিত করেছেন। কোন নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে আজ পর্যন্ত আমি পরাজিত হইনি। জনগণের সমর্থনে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হবার গৌরব আমি অর্জন করেছি। তিন-তিনবার তারা আমাকে প্রধানমন্ত্রী করেছেন। এখনও আমি দেশের যে প্রান্তেই যাই উচ্ছ্বাসিত জনজোয়ারে আমি তাদের ভালবাসায় অভিষিক্ত হই। আমি রাষ্ট্র পরিচালনায় কিংবা বিরোধী দলে যেখানেই থাকি এই জনগণ সুখে-দুঃখে, শান্তিতে-সংগ্রামে আমার সাথী হন। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে শোডাউনের চেষ্টা করবে বিএনপি ॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে আজ রাজধানীতে রাস্তা বন্ধ করে সভা, সমাবেশ, মিছিল রাজপথে অবস্থানে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও তা উপেক্ষা করে শোডাউনের চেষ্টা করবে বিএনপি। আর আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করবে মামলার রায় দেখে। আগেই দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আন্দোলন কর্মসূচী চূড়ান্ত করার বিষয়ে খালেদা জিয়ার ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। তাই মামলার রায়ের পর তিনি যে ধরনের আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণার ইঙ্গিত দেবেন বিএনপি সে ধরনের কর্মসূচীই দেবে। জানা যায়, রাজপথে প্রকাশ্যে অবস্থানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে বিএনপি নেতাকর্মীরা আদালতের আশপাশের এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নিরাপদ স্থানে থেকে মামলার রায়ের জন্য অপেক্ষা করবে। রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ফেটে পড়বে। র‌্যাব-পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় করবে এ বিষয়টি মাথায় রেখেই তারা রাজপথে নামার চেষ্টা করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। একইভাবে সারাদেশের সকল- জেলা-উপজেলায়ও প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু করবে। আর রাজপথে তাৎক্ষণিক কর্মসূচী পালনের পাশাপাশি বিএনপির পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে।
×