ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তরুণ প্রজন্মের সামনে দ্বিতীয় অধ্যায়- স্বাধীনতাবিরোধীদের আশ্রয়দাতাদেরও রুখতে হবে -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

তরুণ প্রজন্মের সামনে দ্বিতীয় অধ্যায়- স্বাধীনতাবিরোধীদের আশ্রয়দাতাদেরও রুখতে হবে -স্বদেশ রায়

৫ ফেব্রুয়ারি ছিল গণজাগরণ মঞ্চ শুরুর দিন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ- হলে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম ফুঁসে উঠেছিল। দিনের একটা সময়ে ক্ষুব্ধ এই তরুণরা ধীরে ধীরে জড়ো হয়েছিল শাহবাগে। তারা যোগাযোগ করেছিল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। তার পরে শাহবাগে কী হয়েছিল সে ইতিহাস সকলের জানা। সেদিন ওই তরুণদের বুকের আবেগকে, চেতনাকে উপলব্ধি করে যেমন পত্রিকার হেডিং করেছি ‘শাহবাগ বসন্ত’, তেমনি প্রতিদিন চেষ্টা করেছি তাদের আন্দোলনের লিটারেচারকে মানুষের কাছে তুলে ধরার। প্রতিদিন তখন লিখেছি তরুণদের সেই আন্দোলন ও চেতনা নিয়ে। এই লেখা লিখছি ৬ ফেব্রুয়ারি। এ লেখার আগের দিন ছিল ৫ ফেব্রুয়ারি। অন্য হাজার হাজার তরুণের মনের মতো আমারও এই প্রৌঢ় শরীরের ভেতরে থাকা তরুণ মনটি একবারের জন্য হলেও নড়ে উঠেছিল ৫ ফেব্রুয়ারি। আমি এখন হৃদয়ের আবেগ হৃদয়ে সামলাতে পারি, তাই তরুণদের মতো ফেসবুকে কোন পোস্ট দেইনি। তবে সারাদিন নানা কাজের ফাঁকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ রেখেছি। দেখেছি, সেখানে তরুণরা কীভাবে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করছে। শাহবাগের অনেক স্লোগান এখনও আমাকে আপ্লুত করে, আমার চোখের কোণ বেয়ে জল এনে দেয়। আমার অনেক লেখায় উল্লেখ করেছি সেই তরুণটির স্লোগানÑ ‘আমার মা বীরাঙ্গনা, আমি আপোস জানি না।’ আমাদের স্বাধীনতার জন্য সাড়ে পাঁচ লাখ মা-বোন তাদের ইজ্জত দিয়েছিলেন। সৈয়দ মুজতবা আলী থেকে ধার নিয়ে বলা যায়, তাঁদের ইজ্জত দিয়ে তাঁরা দেশের ইজ্জত রেখেছিলেন। এই সাড়ে পাঁচ লাখের ক’জনকে আমরা খুঁজে পাই। কয়েক হাজারকেও খুঁজে পাই না। কারণ, আমাদের সমাজ, আমাদের ব্যর্থতা বাধ্য করেছে তাঁদের সমাজের আড়ালেÑআবডালে মুখ লুকাতে। সমাজের কোথায় কোন কুঁড়েঘরে, কোন্ প্রান্তে আমাদের সেই সব মা-বোন নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেনÑ আমরা জানি না। খোঁজও নেইনি। বরং আমরা কী করেছি, এই মা-বোনদের যারা প্রতিদিন পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দিত, সেই আলবদর মতিউর রহমান নিজামীকে, আলী আহসান মুজাহিদকে শহীদের রক্তে ভেজা, আমাদের মা-বোনের শ্লীলতা হারানোর বিনিময়ে পাওয়া দেশে মন্ত্রী বানিয়েছি। তাদের গাড়িতে উড়েছে আমার ভাই ও পিতার রক্তে এবং মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে কেনা জাতীয় পতাকা। শুধু এটাই নয়, সামাজিকভাবে এই রাজাকার, আলবদরদের এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল যে, লজ্জায় আমাদের মুখ লুকাতে হতো। আলী আহসান মুজাহিদ, কাদের মোল্লা যে বীরদর্পে প্রেসক্লাবে এসে নামত, তা দেখে লজ্জায় প্রেসক্লাব ত্যাগ করা ছাড়া কোন পথ ছিল না। এভাবেই এ দেশে রাজাকার, আলবদরদের প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। আমাদের ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী এই স্বাধীনতাবিরোধী কোলাবরেটরদের ভোটাধিকার ছিল না, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করারও অধিকার ছিল না। অন্যদিকে দালাল আইনে যেমন রাজাকার, আলবদরদের বিচার শুরু হয়েছিল, তেমনি যখন দেখা গেল দালাল আইনে অনেকে তার অপরাধের প্রাপ্য সাজা পাচ্ছে না, তখন যুদ্ধাপরাধের বিচার আইন প্রণয়ন করা হয়। তাই যে বড় মাপের স্বাধীনতাবিরোধী বা নরহত্যাকারীরা ওই সময়ে দালাল আইনে কম সাজা পাচ্ছিল, পরবর্তীতে তাদের ঠিকই যুদ্ধাপরাধ আইনে বিচার হতো। এগুলো বাস্তবায়নের আগেই বঙ্গবন্ধুকে এই স্বাধীনতাবিরোধীরা হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর থেকেই স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্প্রতিষ্ঠা করা শুরু হয়। এ ইতিহাস এখন তরুণ প্রজন্ম কম-বেশি জানে। তারা খোঁজ নিলে আরও জানতে পারবে, খালেদা জিয়া যেমন স্বাধীনতাবিরোধী চিহ্নিত নরহত্যাকারী, ধর্ষক আলবদরকে এ দেশে প্রথম মন্ত্রী করেন, জিয়াউর রহমান তেমনি পাঁচজন নরহত্যাকারী, ধর্ষক জামায়াতে ইসলামীকে তার দলের মাধ্যমে নির্বাচিত করে স্বাধীন দেশের পবিত্র পার্লামেন্টে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেয়। জিয়াউর রহমানের ’৭৯-এর পার্লামেন্টে তার দলের পাঁচজন মেম্বার ছিল, যারা ১৯৭০-এ জামায়াতের প্রার্থী ছিল এবং একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নরহত্যা ও ধর্ষণে সহায়তা করে। তাই ইতিহাসের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর থেকে জিয়া-এরশাদ ও খালেদা জিয়া সকলেই এই স্বাধীনতাবিরোধী নরহত্যাকারীদের, ধর্ষকদের রাজনীতিতে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এবং সকলেই এদের মন্ত্রী বানিয়েছে, পার্লামেন্ট মেম্বার বানিয়েছে। আজ এরাই সমাজে একটি কথা খুব সুচতুর পথে ছড়ায় যে, দেশকে বিভক্ত করা হচ্ছে। যখন দেশে ঐক্যের প্রয়োজন, সে সময়ে বিভক্তি ছড়ানো হচ্ছে। বাস্তব সত্য হলো, বাংলাদেশে কোন বিভক্তি নেই। বাংলাদেশের সমস্যা একটিই যে, নানাভাবে এখনও স্বাধীনতাবিরোধীদের এবং স্বাধীনতাবিরোধী চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। আজ যেটাকে সমাজের বিভক্তি বলা হচ্ছে, এটা দূর করার একমাত্র পথ বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী কেউ সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পাবে না। বাংলাদেশকে বাংলাদেশ হিসেবে রাখতে হলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রবাহিত করতে হলে এদের উৎখাত করতে হবে। এদের রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতি থেকে উৎখাত করার প্রথম পথ হলো বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলকে স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী হতে হবে। যেমনটি ছিল ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বা চেতনার সব রাজনৈতিক অধিকার বন্ধ করে দিতে হবে। যেমন, আমাদের নির্বাচন কমিশনে যে রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন তৈরি করা হয়েছে, ওই আইন অসম্পূর্ণ আইন। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কোনরূপ অবিশ্বাস যাদের আছে বা যারা লিখিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোন একটি অংশকে স্বীকার করে না, তারা কীভাবে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধিত হয়? ঐতিহাসিকভাবে, সাংবিধানিকভাবে ও বিচার বিভাগীয় রায়ের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জাতির পিতা। বিএনপি, ইসলামী ঐক্যজোটসহ যেসব দল তাদের গঠনতন্ত্রে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকার করে না, তারা কীভাবে নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পায়? একজন ক্ষুদ্র সাংবাদিক হিসেবে আমার ধারণা, কেউ যদি বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হন, আর ওই বিচারপতি যদি স্বাধীনতার চেতনাকে, বাংলাদেশকে বুকে ধারণ করেনÑ তাহলে সেখান থেকে জাতির জনকের সম্মান উর্ধে তুলে ধরার পথ বেরিয়ে আসবে। অন্যদিকে বিচারপতি যদি সিনহার মতো বা দস্তগীরের মতো হন, তাহলে অবশ্য রায়ে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করে এসব স্বাধীনতার চেতনায় অবিশ্বাসী দলগুলোকেই উর্ধে তুলে ধরা হবে। বাংলাদেশকে সব সন্ত্রাস ও বিভেদমুক্ত হিসেবে ভবিষ্যতের দিকে এগুতে হলে, যে কোন মূল্যে হোক স্বাধীনতার চেতনাকে রাষ্ট্রের সবখানে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। উৎখাত করতে হবে সব জায়গা থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের ও স্বাধীনতাবিরোধী চেতনাকে। শেখ হাসিনা মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর, রাজাকারদের বিচার শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। আর এ পথে তাঁকে সব থেকে বড় সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম। তরুণ প্রজন্ম শুধু শাহবাগে জড়ো হয়নি, শাহবাগ একটি প্রতীক হয়ে গেছে। তরুণ প্রজন্ম নেমেছিল সারাদেশে। ঢাকা-সিলেটসহ নানা স্থানে এই তরুণ প্রজন্ম প্রাণ দিয়েছে। ’৭১-এর এই নরঘাতক, ধর্ষকদের বিচার করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে এ দেশের তরুণ প্রজন্মের পুলিশ, বিজিবি ও সেনাসদস্য। তার পরেও সেই ঘাতক দলের একটি জামায়াতে ইসলামী, নির্বাচন কমিশনে যাদের নিবন্ধন নেই, তাদের ঠিকই নিজের জোটে রেখেছেন খালেদা জিয়া। তাদের সঙ্গে নিয়মিত মিটিং করছেন। শুধু তাই নয়, আরেক যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জন্য ৩ ফেব্রুয়ারি তার দলের নির্বাহী কমিটিতে শোক প্রস্তাব এনেছেন। এরপরে নিশ্চয়ই তরুণ প্রজন্মের আর বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, যতদিন বাংলাদেশে স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী শক্তিকে আশ্রয় দেয়ার এই রাজনৈতিক শক্তি টিকে থাকবে, ততদিন তরুণ প্রজন্ম যে চেতনা নিয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে বসন্ত সৃষ্টি করেছিল, তরুণ প্রজন্ম যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ চায় তা কখনই বাস্তবায়িত হবে না। শেখ হাসিনা বর্তমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল বাতিঘর। তার পরেও তিনি ক্ষমতার রাজনীতি করেন। আবার তিনি ক্ষমতার রাজনীতি করতে পারছেন বলেই বাংলাদেশে ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বিজয়ী হচ্ছে। তবে যারা তরুণ তাদের ঘাড়ে তো কোন ক্ষমতার রাজনীতির ধীরে চলার দায় নেই। বরং তাদের আছে তারুণ্যের প্রবল প্রতাপ। প্রবল প্রতাপে তারা তারুণ্যের পাখা নেড়ে ঝড় তুলেছিল শাহবাগে। যা দেখে সারাদেশের রাজপথে, এমনকি গ্রামের পথে পথেও গড়ে উঠেছিল গণজাগরণ মঞ্চ। যার ফলে ’৭১-এর ঘাতক শিরোমণিদের ফাঁসি হয়েছে। এখন বাংলাদেশের সবখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাঁড় করাতে হলে আবার প্রবল প্রতাপে তরুণদের রাজপথে আসতে হবে। তাদের হুঙ্কার ছাড়তে হবে, এই দেশে কোন রাজাকার-আলবদরের আশ্রয়দাতার স্থান হবে না। বাংলাদেশে রাজাকার-আলবদর সঙ্গে নিয়ে, ওই চেতনা নিয়ে কোন রাজনীতি করা যাবে না। ’৭১-এর ঘাতকদের যেমন এ দেশ ফাঁসি দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষকারী প্রধান বিচারপতি যেমন নিজের মুখে নিজেই ময়লা লাগিয়ে দেশত্যাগ করেছেন, তেমনি এদেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের আশ্রয়দানকারী কোন ব্যক্তির স্থান হবে না। তিনি যত বড় হোন না কেন, তরুণ প্রজন্মের দায় রয়েছে আঘাতে আঘাতে তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার। আর সেই ধ্বংসাবশেষের ওপরেই গড়ে তুলতে হবে স্বাধীনতার চেতনার নতুন নতুন শক্তি। যাতে এ দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেই আসুক, মানুষ কখনও চিন্তিত হবে না এই ভেবে যে, ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আবার কি নরহত্যা হবে! আর এটাও সত্য যে, স্বাধীনতাবিরোধীদের এই আশ্রয়দাতাদের আশ্রয়স্থল ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতার পক্ষের তরুণদের জীবনও নিরাপদ নয়। এরা ক্ষমতায় এলে আবারও হাজার হাজার তরুণ তাদের চাপাতির আঘাতে নিহত হবে। কোটি মানুষের মৃতদেহ জমে উঠবে এই দেশে। তাই আবার ফেব্রুয়ারি এসেছে নতুন ডাক নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের আশ্রয়দাতাদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিতে এই বাংলাদেশ থেকে। [email protected]
×