ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রাবণী আক্তার সান

যুব বিশ্বকাপে ভারতের বাজিমাত

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

যুব বিশ্বকাপে ভারতের বাজিমাত

নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১২তম অনুর্ধ-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে ৮ উইকেটের বড় ব্যবধানে হারিয়ে রেকর্ড চতুর্থ শিরোপা জিতেছে ভারত। মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে অসিদের ছুড়ে দেয়া ২১৭/১০ (৪৭.২ ওভার) রানের সাদামাটা লক্ষ্যটা রাহুল দ্রাবিড়ের শিষ্যরা টপকে যায় ৬৭ বল হাতে রেখেই। সমান তিন বার করে চ্যাম্পিয়ন হয়ে লড়াইটা ছিল এই অসিদের সঙ্গেই। চতুর্থ সাফল্যে এবার দুর্দান্ত দাপটের সঙ্গে রেকর্ডটা এককভাবে নিজেদের করে নেয় ভারতের যুবারা। গ্র্যান্ড ফাইনালে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি (১০১*) হাকিয়ে হাঁকিয়ে ম্যাচসেরা বিজয়ী দলের ওপেনার মানজিত কারলা। এবারের আসরে কোন দলই ভারতকে সেভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেনি। ধারণা করা হয়েছিল শিরোপার লড়াইটা জমবে। কিন্তু সেখানেও ছিল রাহুল-শিষ্যদের দাপট। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা অস্ট্রেলিয়া ৫৯ রানে হারায় ৩ উইকেট। চতুর্থ উইকেটে ৭৫ রানের জুটি গড়েন জোনাথন মের্লো ও পরম উপল। উপল ফেরেন ৩৪ রানে। মের্লো করেন ৭৬। এই দুজন যখন উইকেটে ছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার সামনে সুযোগ ছিল অন্তত আড়াইশ রানের স্কোর গড়ার। কিন্তু পরে দারুণভাবে ম্যাচে ফেরে ভারত। ৩৩ রানে অস্ট্রেলিয়া হারায় শেষ ৬ উইকেট। যেখানে শেষ চারটি আবর ৪ রানের মধ্যে! ২১৮ রানের সহজ লক্ষ্যে যথারীতি সেই রান একরকম তুড়ি মেড়ে শুরু করে ভারত। ওপেনিংয়ে কারলা ও পৃথ্বিশ ৭০ বলে ৭২ রানের জুটি গড়ে। অধিনায়ক পৃথ্বিশ আউট হন ২৯ রান করে। দ্বিতীয় উইকেটে কারলা ও শুবমান গিল গড়েন ৬০ রানের আরও একটি কার্যকর জুটি। টুর্নামেন্ট জুড়ে অসাধারণ খেলা গিল ফাইনালে আউট হন ব্যক্তিগত ৩১ রানে। এরপর আর উইকেট হারাতে হয়নি ভারতকে। কারলা ও হার্ভিক দেসাই গড়েন ৮৯ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি। ১০২ বলে ১০১ রানে অপরাজিত থাকেন কারলা। হার্ভিক ৪৭ রানে। ম্যাচসেরা কারলা। আর ৬ ম্যাচে ১ সেঞ্চুরি ও ৩ ফিফটিতে ১২৪ গড়ে ৩৭২ রান করে টুর্নামেন্ট সেরা শুবমান গিল। বয়স নিয়ে সমস্যার জন্য কারলার খেলাই প্রায় বাতিল হতে বসেছিল। মাস চারেক আগে হওয়া অনুর্ধ-১৯ কোচবিহার ট্রফির দল বাছাইয়ের সময়ে বয়সের প্রমাণে পরীক্ষাও দিতে হয়েছিল তাঁকে। সেঞ্চুরি করে দিল্লীর সেই বাঁ-হাতি ওপেনারই ফাইনালের নায়ক। ঠিক ১০০ বলে অপরাজিত ১০১ রানের ইনিংসটিকে তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতসেরা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতের যুব বিশ্বকাপ জয়ের পর টুইটারে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন মোহম্মদ কাইফ, রবীন্দ্র জাডেজা, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনরা। মানজোতের ইনিংসকেও শুভেচ্ছায় ভরিয়ে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। ইতোমধ্যেই তাঁকে ভবিষ্যতের তারকা বলতেও শুরু করেছে ক্রিকেট মহল। এর আগে ২০০০, ২০০৮, ২০১২ সালে যুব বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শিরোপা জিতেছিল ভারত। অস্ট্রেলিয়া ১৯৮৮, ২০০২ ও ২০১০Ñএ। দীর্ঘ সাত বছর পর শিরোপার এত কাছে এসেও পারল না স্টিভেন স্মিথের উত্তরসূরিরা। খেলোয়াড়ি জীবনে ম্যাচের পর ম্যাচ অসাধরণ পারফর্মেন্স উপহার দিয়েও শচীন টেন্ডুলকর-সৌরভ গাঙ্গুলীদের ছাঁয়ায় ঢাকা পড়ে ছিলেন রাহুল। তা নিয়ে কখনো এতটুকু আক্ষেপ প্রকাশ করেননি। কারণ নেপথ্যের কারিগর হতেই পছন্দ করেন তিনি। এখন সেই শচীন- সৌরভদের কোচ বাছাই কমিটি জাতীয় দলের কোচিংয়ের জন্য রাহুলকে বিবেচনায় রাখলেও, বিনয়ের সঙ্গে সেটি প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘নিজেকে আরও একটু তৈরি করে নেই।’ তারই তত্ত্বাবধানে রেকর্ড চতুর্থবারের মতো অনুর্ধ-১৯ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতল ভারত। তবু বরাবারের মতোই বিনয়ী চলমান এ কিংবদন্তি। বরং সাফল্যের কৃতিত্ব শিষ্য ও সাপোর্টিং স্টাফের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন রাহুল দ্রাবিড়। ‘ছেলেদের কৃতিত্ব দিতেই হবে। আর কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন সাপোর্ট স্টাফরা। দুর্দান্ত কাজ করেছে গোটা টিম। পাশাপাশি নির্বাচক, বিসিসিআইও কৃতিত্বের দাবিদার। ছেলেদের জন্য গর্বিত। আমি কেবল সাহায্য করেছি, এছাড়া এই সাফল্যে আমার তেমন কৃতিত্ব নেই।’ পৃথ্বিশদের (অনুর্ধ-১৯ অধিনায়ক) উদ্দেশে তাদের কোচ আরও বলেন, ‘এই মুহূর্তটা ওরা উপভোগ করুক। কিন্তু চাইব, এই মুহূর্তটা দিয়েই যেন লোকে ওদের না চেনে। আরও অনেক গৌরব যেন আদায় করে নিতে পারে। ওদের বুঝতে হবে সামনের পথটা আরও কঠিন।’ যেন বরাবরের সেই দ্রাবিড়িয়-সভ্যতা। সাফল্যে গাছের ছায়া খুঁজো না। তৈরি হও আরও দুর্গম পথ পেরুনোর জন্য। রাহুল দায়িত্ব নেয়ার পর টানা দু-বার যুব বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠল ভারত। গত বার ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারলেও এ বার অস্ট্রেলিয়াকে উড়িয়ে দিয়েছে পৃথ্বিশের দল। অথচ কৃতিত্বের এতটুকু দাবি করছেন না রাহুল ‘দ্য ওয়াল’ দ্রাবিড়। পৃথ্বিশরা ‘ওয়াল’Ñএর উপর দাঁড়ানোয় তাদের উচ্চতা এতটাই বেড়ে গেছে যে, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলও সেই উচ্চতার ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি। শিরোপা-উৎসবের দিনে জয়টা আসে ৮ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে। ভারতের মতো একটা দেশের অন্যতমসেরা পারফর্মার হয়েও ক্যারিয়ারে বরাবরই থেকেছেন প্রচারের আড়ালে। তারকা হয়েও কখনোই তারকার জীবন কাটাতে চাননি। কোচ হিসেবে বিশ্বকাপজয়ের পরও রাহুল যেন ঠিক তেমনই আছেন। শিষ্যদেরও মাটিতে পা রাখাতে বলেছেন রাহুল। অধিনায়ক পৃথ্বিশের মুখেও কোচে মুগ্ধতা ‘রাহুল স্যারের কথা আর কি বলব। অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। গত দুই বছর আমাদের নিয়ে যারা কাজ করেছেন, এই কৃতিত্ব তাদের সবার।’ শিরোপা-উৎসবের আগে সেমির ম্যাচটাও ছিল আলোচিত, যেখানে ভারতের প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান। চিরশত্রুদের উড়িয়ে দেয়ার দিনে দুর্দান্ত বোলিং করেন ঈশান পোড়েল। ১৭ রান দিয়ে নেন ৪ উইকেট। উন্মদনা ওই ম্যাচে জয়ের নায়ক বলেন, ‘ম্যাচ জেতার পর রাহুল স্যার আমার খুব প্রশংসা করেছেন। আমাকে বলেছেন যে, প্রথম ম্যাচে চোট না পেলে হয়তো বিশ্বকাপের অন্যতম্যসেরা বোলার হতে পারতাম আমি। যা আমাকে আর ভাল করতে অনুপ্রাণিত করবে।’ রাহুলকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন শত্রুদেশ পাকিস্তান কিংবদন্তি জাবেদ মিয়াদাদ, ওয়াসিম আকরাম আর শোয়েব আকতারসহ আরও অনেকেই।
×