ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বকাপকথন-৫॥ তৃতীয় বিশ্বকাপ : ফ্রান্স ১৯৩৮

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বিশ্বকাপকথন-৫॥ তৃতীয় বিশ্বকাপ : ফ্রান্স ১৯৩৮

এরই মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল বাজতে শুরু করেছে। যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে বিশ্বকাপ হবে কী হবে না তা নিয়ে সংশয়ও দেখা দিতে শুরু করেছে। অবশেষে সব শঙ্কা, সব সংশয় কাটিয়ে ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করল। এবারে বিশ্বকাপ আয়োজকের দায়িত্ব পেয়ে অবশেষে শেষ হাসি হাসল ফরাসীরা। অবশেষে বলছি এ কারণে, বিশ্বকাপের প্রথম আসর বসার কথা ছিল ফ্রান্সে। মঞ্চ তৈরিও ছিল। কিন্তু সে মঞ্চে উঠতে পারল না ফিফা সভাপতি মঁশিয়ে জুলেরিমের দেশ ফ্রান্স। উঠল সেই সুদূর পশ্চিমা দেশ উরুগুয়ে। পরের বারও ইতালির কাছে ভোটের দৌড়ে হেরে যেতে হয়েছে। তবে এবার আর কারও কাছে হারতে হলো না। এবারে ফিফার ৫৪টি দেশের প্রতিনিধিদের আয়োজক নিয়ে খুব বেশি ভাবতে হলো না। সর্বসমম্মতিতে তৃতীয় বিশ্বকাপের আয়োজকের দায়িত্ব পেল ফ্রান্স। বিশ্বকাপ এবার যে ফ্রান্সে হবে তা নিয়ে যদিও কারও মনে আগে থেকেই এতটুকু সন্দেহ ছিল না। রীতি অনুযায়ী কেবল সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা। প্রথম দুইবারের মতো এবারও আলোচনার শীর্ষে ছিল ফ্রান্স। কণ্ঠভোটও তাদেরই পক্ষে বেশি পড়ে। যথারীতি ১৬টি দেশ তৃতীয় বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে অস্ট্রিয়া নাটকীয়ভাবে নাম প্রত্যাহার করে নেয়ায় এবারের বিশ্বকাপের মূল পর্বে অংশ নেয় ১৫টি দেশ। এই ১৫টি দেশ নির্বাচন করা হয় বাছাইপর্বের ৩৬টি দেশের মধ্যে থেকে। মজার ব্যাপার হলো এই ১৫টি দলের মধ্যে ১২টিই ছিল ইউরোপের। ইউরোপের বাইরে থেকে আসে মাত্র ৩টি দেশ। অঞ্চলভিত্তিক দলগুলো হলো : ইউরোপ থেকেÑ ইতালি, জার্মানি, হাঙ্গেরি, বেলজিয়াম, চেকোশ্লাভাকিয়া, নেদারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, রুমানিয়া, পোল্যান্ড, নরওয়ে; কনকাকাফ থেকেÑ কিউবা, ডাস্ট ইস্ট ইন্ডিজ; এবং কনমোবল থেকে একমাত্র ব্রাজিল তৃতীয় বিশ্বকাপে অংশ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় ইউরোপের বাইরের দলগুলো আসতে রাজি হয়নি। তারপরও ইউরোপের বাইরে থেকে ব্রাজিল, কিউবা এবং ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ এ বিশ্বকাপে অংশ নেয়। ব্রাজিল হচ্ছে একমাত্র দল যারা সবগুলো বিশ্বকাপ খেলেছে। ফুটবলের জনক ইংল্যান্ড এ বিশ্বকাপেও অংশ নেয়নি। অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়া থেকে এবারও কোন দেশ খেলার সুযোগ পায়নি। বাছাই পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ১৭টি ম্যাচ। আর মূল পর্বে অনুষ্ঠিত ১৮টি ম্যাচ। ফ্রান্সের ৯টি স্টেডিয়ামে এই ১৮টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে ১৩টি দলকে ৪টি গ্রুপে ভাগ করা হলেও এবারেও সেই অদ্ভুত নিয়মে খেলা হয়। এ অবাক নিয়ম অনেকে মন থেকে মানতে পারেননি। এবারের বিশ্বকাপে ১৫টি দল অংশ নিলেও গ্রুপিং করা কঠিন ছিল না। তা না করে আয়োজকরা নক আউট পদ্ধতিতে খেলার সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ কারো বোধগম্য হয়নি। অর্থাৎ ১৫টি দল প্রথম রাউন্ডে নক আউট পদ্ধতিতে খেলে। যার কারণে প্রথম রাউন্ডেই ৭টি দল বাদ পড়ে যায়। আর যারা বাদ পড়ে তার মধ্যে বেশির ভাগই ছিল ফেবারিট দল। বিশ্বকাপের মতো এতবড় আসরে একটা মাত্র ম্যাচ দিয়ে একটি দলকে বিচার করা যায় না। তারপরও সেটাই করা হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে জার্মানি, নেদাদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, নরওয়ের মতো দল প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়ে যায়। ফলে শুরুতেই বিশ্বকাপের অনেকটা ফিকে হয়ে যায়। গ্রুপ পর্বের ফলাফল : সুইজারল্যান্ড-১ জার্মানি-১; রিপ্লে : সুইজারল্যান্ড-৪ জার্মানি-২; কিউবা-৩ রুমানিয়া-৩; রিপ্লে : কিউবা-২ রুমানিয়া-১; হাঙ্গেরি-৬ ডাস্ট ইস্ট ইন্ডিজ-০; ফ্রান্স-৩ বেলজিয়াম-১; চেকোশ্লাভাকিয়া-৩ নেদারল্যান্ড-০; ব্রাজিল-৬ পোল্যান্ড-৫; ইতালি-২ নরওয়ে-১ দ্বিতীয় রাউন্ড : ইতালি-৩ ফ্রান্স-১; ; ব্রাজিল-১ চেকোশ্লাভাকিয়া-১; রিপ্লে : ব্রাজিল-২ চেকোশ্লাভাকিয়া-১; হাঙ্গেরি-২ সুইজারল্যান্ড-০ ও সুইডেন-৮ কিউবা-০ সেমি-ফাইনাল : ইতালি-২ ব্রাজিল-১ ও হাঙ্গেরি-৫ সুইডেন-১ তৃতীয় স্থান : ব্রাজিল-৪ সুইডেন-২ ফাইনাল : ইতালি-৪ হাঙ্গেরি-২। দ্বিতীয় বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ইউরোপের দুই পরাশক্তি জার্মানি বনাম সুইজারল্যান্ড। উদ্বোধনী ম্যাচ ১-১ গোলে ড্র (টাই) হয়। যেহেতু নকআউট ম্যাচ সে কারণে ‘রিপ্লে’র প্রয়োজন হয়। রিপ্লেতে শেষ হাসি হাসে সুইজারল্যান্ড। তারা ৪-২ গোলে জার্মানিকে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছে যায়। এ পরাজয়ের ফলে বাদের তালিকায় প্রথম নাম লেখা হয় শিরোপার অন্যতম দাবিদার জার্মানির। রোমানিয়া বনাম কিউবার ম্যাচও টাই হওয়ায় রিপ্লেতে নিষ্পত্তি হয়। এতে শেষ হাসি হাসে কিউবা। রিপ্লেতে তারা রোমানিয়াকে ২-১ গোলে হারায়। প্রথম লেগে বিজয়ীদের তালিকায় ছিল চ্যাম্পিয়ন ইতালি, রানার্স আপ চেকোশ্লাভাকিয়া, স্বাগতিক ফ্রান্স, ব্রাজিল, হাঙ্গেরি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড ও কিউবা। আর বাদের তালিকায় ছিল জার্মানি, রোমানিয়া, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, নরওয়ে, নেদারল্যান্ড ও ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ। প্রথম রাউন্ডে হাঙ্গেরি ৬-০ গোলে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজকে হারায়। ব্রাজিল ৬-৫ গোলে হারায় পোল্যান্ডকে। ইতালি, হাঙ্গেরি, ব্রাজিল, সুইডেন দ্বিতীয় রাউন্ডে জিতে সেমি-ফাইনালে ওঠে। দ্বিতীয় রাউন্ডে সুইডেন ৮-০ গোলে কিউবাকে হারিয়ে চমক দেখালেও সেমিতে হাঙ্গেরির কাছে ১-৫ গোলে হারায় সুইডেনের সে চমক পরিহাসে পরিণত হয়। প্রথম সেমি-ফাইনালে শিরোপার অন্যতম দাবিদার টপ ফেবারিট ব্রাজিল অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে যায় ইতালির কাছে। এ বিশ্বকাপের হট ফেবারিট দল ছিল ব্রাজিল। তাদের হারিয়ে প্রথম দল হিসেবে ফাইনালে ওঠে দ্বিতীয় রাউন্ডে স্বাগতিক ফ্রান্সকে হারিয়ে সেমি-ফাইনালে আসা চ্যাম্পিয়ন ইতালি। অপর সেমি-ফাইনালে আরেক ফেবারিট হাঙ্গেরি ৫-১ গোলে হারায় আরেক ইউরোপিয়ান দল সুইডেনকে। প্যারিসে আবার ‘অল ইউরোপ গ্রান্ড ফাইনালের এক তরফা লড়াইয়ে স্টেডিয়ামে উপস্থিত লাখো ফুটবলানুরাগীকে সুখ-সাগরে ভাসিয়ে আবারও শেষ হাসি হাসে ইতালি। এই প্রথমবার কোন স্বাগতিক দেশ বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ে বঞ্চিত হলো। বিরতির আগেই ইতালি ৩-১ গোলে এগিয়ে থাকে। তৃতীয় বিশ্বকাপে ইতালির নেতৃত্ব দেন মিজ্জা আর হাঙ্গেরির সর্সি। ব্রাজিল পায় তৃতীয় স্থান। এ বিশ্বকাপে সুইডেনের ওয়াল্টার ট্রোয়েম বিশ্বকাপের ২০০তম গোলটি করেন। দ্বিতীয় বিশ্বকাপেও মোট ৮৪টি গোল হয়। তৃতীয় বিশ্বকাপে সর্বাধিক গোল করেন ব্রাজিলের লিওনিডাস ডা সিলভা। তিনি এ বিশ্বকাপে ৭টি গোল করে ‘টপ স্কোরার’ হন। লিওনিডাস ডা সিলভা ছিলেন ফুটবলের এক নিপুণ শিল্পী। তাঁর মতো এত বড় মাপের ফুটবলার খুব কম ফুটবলারই বিশ্বকাপে খেলেছে। লিওনিডাস মাত্র তিন ম্যাচ খেলে এই ৭ গোল করেন। ১৯৪২ ও’৪৬ সালে বিশ্বকাপের আসর না বসায় বিশ্বের ফুটবলানুরাগীমহল লিওনিডাস ডা সিলভার অসাধারণ ফুটবল নৈপুণ্য দেখা থেকে বঞ্চিত হয়। তৃতীয় বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করেন ফ্রান্সের রেফারি ক্যাপডিভিল। অনেক কারণে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ দর্শকদের কাছে ‘নন্দিত-নিন্দিত’ হয়ে থাকবে। যদিও এবারে ইতালি চ্যাম্পিয়ন দলের মতোই কাপ জিতেছে। দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জিতে যে আনন্দ উপভোগ করতে পারেনি এবারে তা পূর্ণতা পায়। তবে স্বাগতিকদের কাপ জিততে না পারা, আয়োজনের পদ্ধতি, লটারিসহ অনেক বিষয়ে অনেকদিন ধরে আলোচনা চলতে দেখা যায়। (চলবে) লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ লেখক পরিষদ e-mail : [email protected]
×