ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সভা মিছিল নিষিদ্ধ ॥ ৮ ফেব্রুয়ারি ভোর চারটা থেকে

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সভা মিছিল নিষিদ্ধ ॥ ৮ ফেব্রুয়ারি ভোর চারটা থেকে

শংকর কুমার দে ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ৮ ফেব্রুয়ারি ঘোষণার দিনকে ঘিরে জনমনে সৃষ্ট আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার অবসানে জানমালের নিরাপত্তায় হার্ডলাইন বেছে নিয়েছে সরকার। ৮ ফেব্রুয়ারি রায়ের দিন ভোর চারটা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় সভা, সমাবেশ, মিছিল ও ছুরি, চাকু বা ধারালো অস্ত্র, বিস্ফোরকদ্রব্য, দাহ্য পদার্থ বহন নিষিদ্ধ থাকার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। রাজধানীর ৭ প্রবেশপথে ১৩টি তল্লাশি চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি শুরু করা হয়েছে। নিরাপত্তা বিধানে আকাশে টহল দেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেলিকপ্টার, রাস্তায় থাকবে জলকামান, ডগস্কোয়াড, সিসি ক্যামেরা, জলপথে থাকবে কোস্টগার্ডসহ নৌ পথ রক্ষাকারী নিরাপত্তা বাহিনী। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মোতায়েন থাকবে বিজিবি। র‌্যাব, পুলিশ, ডিবি, দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন ছাড়াও টহল দেবে রায়ের দিন। জঙ্গী, সন্ত্রাসী, দলীয় ক্যাডার, দুর্বৃত্ত, এজাহারভুক্ত ও ওয়ারেন্টের আসামি, সন্দেহজনক ব্যক্তিদের গ্রেফতারের জন্য বিশেষ অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ সদর দফতর থেকে সারাদেশের মেট্রোপলিটন কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের কাছে ৮ ফেব্রুয়ারি রায়ের দিনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত দিক নির্দেশনার বার্তা পাঠানো হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঢাকা পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতৃবৃন্দের অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি-জামায়াত জোট যদি পরিবহন চলাচলের সময়ে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও পরিবহন শ্রমিকরা আক্রান্ত হন তাহলে তারা দ্রুত গতিতে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, মহাখালী বাস টার্মিনাল-এই ৪ টার্মিনালে রায়ের দিন ২০ হাজার পরিবহন শ্রমিককে জমায়েত রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সমিতি। বেগম খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে ঘিরে ইতোমধ্যেই আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও রাজনৈতিক মহলে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য, বিবৃতিতে জনমনে আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। নাশকতা, নৈরাজ্য, সহিংস সন্ত্রাস চালানোর মতো ঘটনার আশঙ্কায় পুলিশ সদর দফতর ও ঢাকা মহানগর পুলিশ প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা অবনতি ঘটানোর জন্য যে কেউ চেষ্টা করবে তাকে কঠোর হস্তে দমন করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি। ডিএমপির প্রেস বিজ্ঞপ্তি ॥ আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার রায়ের দিন রাজধানীতে মিছিল বা জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশের এক ‘বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে’ বলা হয়, ৮ ফেব্রুয়ারি ভোর ৪টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ঢাকা মহানগরে সব ধরনের লাঠি, ছুরি, চাকু বা ধারালো অস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য ও দাহ্য পদার্থ বহন নিষিদ্ধ থাকবে। যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা বসে কোন ধরনের মিছিল করা যাবে না। ডিএমপি কমিশনারের দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিচারাধীন একটি মামলার রায়কে কেন্দ্র করে ঢাকা মহানগরীতে কোন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে জননিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা বিঘেœর অপপ্রয়াস চালাতে পারে মর্মে বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য, ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ার সূত্রে জানা যায়। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, যেহেতু ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, সেহেতু আমি মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া বিপিএম-বার পিপিএম, পুলিশ কমিশনার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স (অর্ডিন্যান্স নং- ওওও/৭৬) এর ২৮ ও ২৯ ধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ (বৃহস্পতিবার) সকাল ৪টা (ভোর রাত) থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সব ধরনের বা লাঠি, ছুরি, চাকু বা ধারালো অস্ত্র, বিস্ফোরকদ্রব্য ও দাহ্যপদার্থ বহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করছি। যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও রাস্তায় দাঁড়িয়ে/বসে কোন ধরনের মিছিল করা যাবে না মর্মে ঘোষণা করছি। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য সবার সহযোগিতা কামনা করছি। নিরাপত্তার প্রস্তুতি ॥ বেগম খালেদা জিয়ার ৮ ফেব্রুয়ারি রায়ের দিন ও রায়ের আগে পরে যাতে সহিংস ঘটনা এড়ানো যায় সেজন্য রাজধানী ঢাকাসহ দেশবাসীর নিরাপত্তা বিধানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। আকাশ পথে নিরাপত্তা বিধানে আকাশে চক্কর দেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আকাশ থেকে মাটিতে নজরদারি ও প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার (এপিসি), রায়ট কন্ট্রোল কার (আরসিসি), ডগ স্কোয়াড, জলকামান, বম ডিসপোজাল, এ্যাম্বুলেন্স, সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হবে স্থল পথের এলাকাগুলোকে। জলপথে কোস্টগার্ড ও নৌপথ রক্ষাকারী বাহিনীগুলো টহল দেবে, যাতে দুর্বৃত্ত চক্র নৌপথে এসে কোন ধরনের নাশকতা চালাতে না পারে। স্টাইকিং ফোর্স হিসেবে বিজিবিকে স্ট্যান্ডবাই রাখা হবে। র‌্যাব, পুলিশ, দাঙ্গা পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইউনিটগুলোর সদস্যদের সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হবে যাতে তারা তাৎক্ষণিক অবনতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। রায়ের দিন ৮ ফেব্রুয়ারি ভোর ৪টা থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল সদস্যকে নিজ নিজ দায়িত্বরত স্থানে কর্তব্যরত অবস্থায় দৃশ্যমান হবে বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে স্পর্শকাতর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন থাকবে। ডিএমপির একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার রায়কে সামনে রেখে রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয়া হবে। রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে কোনরকম অরাজকতা সৃষ্টির সুযোগ কাউকে দেয়া হবে না। রাজধানীর গুলশান থেকে বকশীবাজার আদালত প্রাঙ্গণ পর্যন্ত এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা গড়ে তোলা হবে। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হবে ঝুঁকিপূর্ণ বলে পরিচিত হিসেবে আদালত প্রাঙ্গণ, নাজিম উদ্দিন রোডের পুরাতন কারাগার, গুলশানের খালেদা জিয়ার বাসভবন ফিরোজা ভবন এলাকা। আদালত প্রাঙ্গণ, পুরাতন কারাগার এলাকায় তল্লাশি করে বিচার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনকে শুধুমাত্র প্রবেশ করতে দেয়া হবে। রায় ঘোষণার দিনে নাশকতা, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় গোটা নগরীকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়ার আওতায় আনা হবে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসি ক্যামেরা তো স্থাপন করা হচ্ছেই, এমনকি বিভিন্ন এলাকায় বিপুলসংখ্যক ভিডিওচিত্র ও আলোকচিত্র গ্রাহক দল কাজ করবে। তারা খালেদা জিয়ার সমর্থনকারীদের নামে সৃষ্ট নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির ভিডিও ফুটেজ ও স্টিল ছবি তুলে রাখবে, যাতে পরে ছবি দেখে দোষীদের গ্রেফতার করা যেতে পারে। বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও সহিংসতা ॥ পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি রাজনীতির নামে বরবরই সহিংসতা আর নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। তারা আন্দোলনের নামে জ¦ালাও-পোড়াওসহ ধ্বংসাত্মক কর্মকা- পরিচালনা করে। এছাড়াও বিএনপি নেতা-কর্মীরা সবার আগে টার্গেট করে পুলিশ সদস্যদের। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের হাজিরাকে কেন্দ্র করে লোক সমাগম ঘটানোর নামে নাশকতা ও সহিংসতা ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি। বেগম খালেদা জিয়ার আদালত থেকে ফেরার পথে সচিবালয়ের সামনে পুলিশ সার্জেন্টের মোটরসাইকেল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। গত সপ্তায় পুলিশ ভ্যানে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও পুলিশ সদস্যদের মারধর করে। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রাজপথে পরিবহনে পেট্রোলবোমা মেরে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করেছে, রাজপথে নাশকতা, নৈরাজ্য সৃষ্টি করে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির চেষ্টা করেছে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। এখন আবার দুর্নীতির মামলায় আদালতের রায়কে ঘিরে তারা আবারও ওই ধরনের সহিংস সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালানোর পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিন সরকারের আমলের মামলা ॥ আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি ’১৮ সালে যে দুর্নীতির মামলার রায় ঘোষণা করা হচ্ছে তা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলের দায়ের করা মামলা নয়। সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রাজধানীর রমনা থানায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বহুল আলোচিত সেই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার জন্য আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছে আদালত। বিএনপি-জামায়াত জোটের ২০০১-২০০৬ মেয়াদের সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের এ মামলার প্রধান আসামি। বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে মামলার অপর আসামিরা হলেন- সাবেক এমপি কাজী সলিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সাবেক সচিব ড. কামালউদ্দিন সিদ্দিকী, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মোমিনুর রহমান।
×