ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ইংরেজী প্রথম পত্রের প্রশ্নও ফাঁস, বহিষ্কার ১২ শিক্ষক

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ইংরেজী প্রথম পত্রের প্রশ্নও ফাঁস, বহিষ্কার ১২ শিক্ষক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি, অপরাধীদের ধরতে পুরস্কার ঘোষণার পরেও পরীক্ষা পুরোপুুরি রাহুমুক্ত করা যায়নি। আগের পরীক্ষাগুলোর মতো ব্যাপক অভিযোগ না উঠলেও পরীক্ষার চতুর্থ দিন সোমবার ইংরেজী প্রথম পত্র পরীক্ষাতেও অভিযোগ উঠেছে প্রশ্ন ফাঁসের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক ভুয়া প্রশ্ন আসলেও একটি প্রশ্নের সঙ্গে মূল প্রশ্নের মিল পাওয়া গেছে। এদিকে প্রশ্ন ফাঁসসহ যে কোন অনিয়মের বিরুদ্ধে এদিন কঠোর ছিল প্রশাসন। প্রশ্ন ফাঁসের অপচেষ্টাসহ পুরাতন সিলেবাসে পরীক্ষা নেয়ায় চার শিক্ষক আটক ছাড়াও বহিষ্কার হয়েছেন অন্তত ১২ শিক্ষক। এর আগে বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার প্রায় এক ঘণ্টা আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ আসে। পরীক্ষার আগ মুহূর্তে কিছু ফেসবুক আইডি থেকে প্রশ্ন ছড়ালে তা শিক্ষার্থীদের হাতে না গেলেও সরকারকে সমালোচনার মুখে ফেলছে একটি বিশেষ গ্রুপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা পরিষ্কার যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে কাজ করছে অপরাধীরা। প্রশাসন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারবিরোধীরা পরিকল্পিতভাবেই এ ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে পরীক্ষার ঠিক আগ মুহূর্তে হলেও সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজরদারি করতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যর্থতাকে কাজে লাগিয়েই সরকারবিরোধীরা সফল হচ্ছে। এছাড়া প্রশ্ন ফাঁসের এমন সঙ্কটের মধ্যে সকল বোর্ডে অভিন্ন প্রশ্ন করায় ফাঁসের ঝুঁকি আরও বেড়ে গেছে বলেও বলছেন বিশেষজ্ঞরা। জানা গেছে, সোমবার ইংরেজী প্রথম পত্রের প্রশ্নও ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। পরীক্ষা শুরুর আগে সকাল ৮টা ৪ মিনিটে ইংরেজী প্রথম পত্রের ‘ক’ সেটের প্রশ্ন হোয়াটসঅ্যাপের একটি গ্রুপে ফাঁস করা হয় বলে অভিযোগ মিলেছে। যার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। প্রশ্নপত্রটি হোয়াটসঅ্যাপের ‘ঊহমষরংয ১ংঃ ঢ়ধৎঃ ২০১৮’ নামের একটি গ্রুপে পাওয়া গেছে। এরপর ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্নটি ছড়িয়ে যায়। পরীক্ষা শেষে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া প্রশ্নের সঙ্গে ওই প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া যায়। তবে প্রশ্ন ফাঁসের কোন সত্যতা নেই বলে দাবি করেছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার। আগের পরীক্ষা বাতিলের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিই এ বিষয়ে কাজ করবে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে রবিবার গঠন করা তদন্ত কমিটি সোমবার সকাল থেকেই কাজ শুরু করেছে। এ কমিটি এবারের পুরো পরীক্ষা চলাকালে মনিটরিং করবে। কমিটির এক সদস্য বলেছেন, আমরা কাজ শুরু করেছি, মিডিয়ায় আসা তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করছি, এরপর আমরা একসঙ্গে বসব, বসে সিদ্ধান্ত নেব। কী করব না করব। এদিকে রাজধানীর শ্যামপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে পুরাতন সিলেবাসের (অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য) প্রশ্নপত্র দিয়ে ৩০ মিনিট পরীক্ষা নেয়ার অভিযোগে কেন্দ্র সচিব ও প্রধান শিক্ষকসহ ৪ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষকের নাম ওলিউর রহমান। এছাড়া বহিষ্কার করা হয়েছে কক্ষ পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা ৩ শিক্ষককে। জানা গেছে, ৩০ মিনিট পর বিষয়টি নজরে আসলে নতুন সিলেবাসে পরীক্ষা নেয়া হয়। এজন্য অতিরিক্ত ৩০ মিনিট সময় দেয়া হয় পরীক্ষার্থীদের। বিষয়টি সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার। এদিকে ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে নকলের সহায়তার অভিযোগে ৪ শিক্ষককে আটক করা হয়েছে। এছাড়া একজন কেন্দ্র সচিব ও হল সুপারকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আমাদের ফরিদপুর সংবাদদাতা জানিয়েছেন, বোয়ালমারী সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের কেন্দ্রে পরীক্ষা শুরু হওয়ার কিছু সময় পরে কেন্দ্র সচিবের রুমে বসে ওই বিদ্যালয়ের খ-কালীন দুই শিক্ষক রইচ উদ্দিন ও সালমান মাহমুদ প্রশ্নপত্রের উত্তর প্রস্তুত করছিল। তখন কেন্দ্র পরিদর্শক উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুদীপ বিশ্বাস তাদের আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে এবং কেন্দ্র সচিব বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এটিএম চুন্নু মিয়াকে পরবর্তী পরীক্ষাসমূহের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এছাড়া বোয়ালমারী জর্জ একাডেমি কেন্দ্রের পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা পরে সাতৈর উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক প্লাবন ঘোষ ও শাহিন ফকির হল সুপারের কক্ষে বসে প্রশ্নপত্রের উত্তর প্রস্তুত করার সময় আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। হল সুপার ইয়াকুব আলী চৌধুরীকে পরবর্তী পরীক্ষাসমূহের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রওশন আরা পলি চার শিক্ষককে আটকের কথা স্বীকার করে বলেন, তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলার প্রস্তুতি চলছে। কুমিল্লার চান্দিনায় পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে নানা অনিয়মের কারণে পাঁচ শিক্ষককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি ও এক পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। উপজেলার চান্দিনা পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় ও চান্দিনা আল আমিন ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। অব্যাহতি পাওয়া শিক্ষকেরা হলেনÑ কুটুম্বপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের রুহুল আমিন ও দিলীপ ভৌমিক, বাড়েরা উচ্চ বিদ্যালয়ের সারওয়ার জামান, করতোলা উচ্চ বিদ্যালয়ের দেব প্রসাদ রায় ও মাধাইয়া বাজার ছাদিম উচ্চ বিদ্যালয়ের ছিদ্দিকুর রহমান। বহিষ্কার হওয়া পরীক্ষার্থী জুয়েল আহমেদ উপজেলার দোতলা ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার ছাত্র। জামালপুর থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানিয়েছেন, সদর উপজেলার মেষ্টা ইউনিয়নের হাজিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়কসহ পরীক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত চারজন শিক্ষককে বহিষ্কার করা হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আকাশ কুমার সকালে ইংরেজী প্রথমপত্র বিষয়ের পরীক্ষা চলাকালে নিজেদের বিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীদের অনৈতিক সুবিধা প্রদানের দায়ে তাদেরকে বহিষ্কার করেন। বহিষ্কৃত শিক্ষকেরা হলেন- হাজিপুর উচ্চ বিদ্যালয় এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র তত্ত্বাবধায়ক ও আলিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক সুলতান হোসেন, ওই কেন্দ্রের কক্ষ পরিদর্শক আলীমুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল্লাহেল কাফি, হাজিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সুজাত আলী, ডেফুলিবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হামিদুল হক এবং হাজিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মুনতা হেনা। বেসরকারী হাসিল উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের সবাইকে ওই কেন্দ্রের একটি কক্ষে বসিয়ে অনৈতিক সুযোগ করে দেয়ার দায়ে তাদেরকে চলতি এসএসসি পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। জানা যায়, পরীক্ষা কেন্দ্রে হাসিল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দু’টি কক্ষে একই সঙ্গে বসানো হয়। এতে পরীক্ষা হলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এই অনৈতিক সুবিধা প্রদানের দায়ে হল সুপারসহ চার শিক্ষককে বহিষ্কার করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আকাশ কুমার কুন্ডু। হাজিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও এসএসসি কেন্দ্র সচিব মোঃ সাজেদুল ইসলাম পাঁচ শিক্ষককে বহিষ্কার প্রসঙ্গে বলেন, পরীক্ষা কেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তত্ত্বাবধায়কসহ পাঁচজন শিক্ষককে বহিষ্কাররের আদেশ দেন। সেই আদেশের প্রেক্ষিতে আমি তাদেরকে নোটিশ দিয়ে বহিষ্কারের বিষয়টি অবহিত করেছি। বগুড়া অফিস থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানিয়েছেন, বগুড়া দি সিটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের পুরাতন সিলেবাসের প্রশ্নপত্র বিতরণ নিয়ে বিভ্রাট সৃষ্টি হয়। তবে প্রশ্নপত্র বিতরণের কিছু পর বিষয়টি ধরা পড়লে কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাহার করে পুনরায় চলতি সিলেবাসের প্রশ্নপত্র বিতরণ করেন। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি তদন্তে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বগুড়া সিটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে এসএসসি পরীক্ষায় বগুড়া সদর এলাকার ৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৪শ’ ৭৯ জন পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। এটি মূল কেন্দ্রের আওতায় উপকেন্দ্র। ভেন্যু সচিব হিসেবে দায়িত্বে থাকা সিটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ মোশারফ হোসেন জানান, পরীক্ষা শুরুর নির্ধারিত সময়ে ১ নং কক্ষে ভুল করে পুরাতন সিলেবাসের (২০১৭) প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খুলে ১৫/২০ জন পরীক্ষার্থীকে তা বিতরণের কিছু পরেই বিষয়টি ধরা পড়ে। মাত্র ২/১ মিনিটের ঘটনা বলে তার দাবি। ওই কক্ষে মোট ৭৫ জন পরীক্ষার্থী ছিল। এর পরেই তারা সেগুলো তুলে নিয়ে নতুন সিলেবাসের (২০১৮ সালের) সিলেবাসের প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা গ্রহণ করেন। এ নিয়ে বড় কোন সমস্যা হয়নি বলে তিনি জানান। প্রধান শিক্ষক আরও জানান, যেসব পরীক্ষার্থী আগের বছর কোন বিষয়ে ফেল করে থাকলে তারা ওই বিষয়ে শুধু পরীক্ষা দিতে পারেন। তাদের পুরাতন বা নতুন যে কোন সিলেবাসে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ রয়েছে। বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আব্দুস সামাদ জানান, ওই ভেন্যুতে ২ জন অনিয়মিত পরীক্ষার্থী ছিল। তাদের প্রশ্নপত্র সরবরাহ করতে গিয়েই এই ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে তারা জানতে পেরেছেন। বিষয়টি তদন্তে সহকারী কমিশনার মোঃ তাজউদ্দিনকে প্রধান করে ১ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
×