ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গা সঙ্কটে দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশের পাশে থাকার ওয়াদা

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

রোহিঙ্গা সঙ্কটে দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশের পাশে থাকার ওয়াদা

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশের পাশে দৃঢ়ভাবে থাকার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সুইজারল্যান্ড। দেশটি রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ১২ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঙ্ক ( প্রায় ১০৮ কোটি টাকা) অনুদানের ঘোষণা দিয়েছে। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে সুইস প্রেসিডেন্ট আঁলা বেরসে এই অনুদান ঘোষণা দেন। এদিকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে আজ মঙ্গলবার কক্সবাজার যাচ্ছেন সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট। ঢাকায় সফররত সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট সোমবার বেলা তিনটায় গণভবনের করবী হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতি দেন দুই শীর্ষ নেতা। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বেরসের বৈঠকের পর বিকেলে তার সঙ্গে সাক্ষাত করেন জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। সুইস প্রেসিডেন্টের সফরকালীন আবাসস্থল হোটেল সোনারগাঁওয়ে এ সাক্ষাত অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন বেরসে। পরে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির দেয়া নৈশভোজে অংশ নেন তিনি। বঙ্গভবনে বেরসের সম্মানে রাষ্ট্রপতি হামিদের দেয়া নৈশভোজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যোগ দেন। এছাড়া সোমবার বাংলাদেশ-সুইজারল্যান্ড ব্যবসায়ী ফোরাম আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দেন সুইস প্রেসিডেন্ট। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ের করবী হলে তার সঙ্গে যৌথ বিবৃতিতে রোহিঙ্গা সঙ্কটে বাংলাদেশের মানবিক আচরণের ভূয়সী প্রশংসা করেন সফররত সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আঁলা বেরসে। এ সময় রোহিঙ্গাদের সহায়তায় আরও ১২ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঙ্ক অনুদানের ঘোষণা দেন তিনি। আঁলা বেরসে বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটে বাংলাদেশ যে মানবিক ভূমিকা পালন করছে, সেটাকে সাধুবাদ জানাচ্ছে সুইজারল্যান্ড। এই সঙ্কটের সঙ্গে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের প্রশ্ন জড়িত। মানবতা, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থে এই সঙ্কটের সমাধানে বাংলাদেশের পাশে থাকবে সুইজারল্যান্ড। সহায়তায় সুইজারল্যান্ড এর আগে ৮০ লাখ ফ্রাঙ্ক দিয়েছে জানিয়ে দেশটির রাষ্ট্রপতি বলেন, এ দফায় আমরা আরও ১২ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক দেব বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তায়। তিনি আজ মঙ্গলবার রোহিঙ্গাদের দেখার জন্য কক্সবাজার যাবেন বলেও জানান বিবৃতিতে। বাংলাদেশের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের সম্পর্কের বিষয়ে সুইস প্রেসিডেন্ট বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে দু’দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ সফর আমাদের দুই দেশের সম্পর্ককে আরও সংহত করবে বলে আশা করছি। যৌথ বিবৃতিতে সুইস প্রেসিডেন্ট বলেন, অনেক বাধার পরও বাংলাদেশ গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করাসহ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, সুইজারল্যান্ড তাকে গুরুত্ব দেয়। কারণ গণতন্ত্র ও আইনের শাসন দুই দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি। তিনি বলেন, দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যমান। এই সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে সুইজারল্যান্ড প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। উন্নয়ন ও বাণিজ্য খাতে বাংলাদেশের সঙ্গে আরও গভীর সম্পর্ক গড়তে চাই। দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট। এছাড়া বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়েও আগ্রহ দেখিয়েছেন তিনি। আর রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিি কোফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নেরও তাগিদ দেন। যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তি ইতিবাচক দিক। তবে সুইস প্রেসিডেন্ট প্রত্যাশা করেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নিরাপত্তা, স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন ও মর্যাদাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সোমবার বেলা তিনটার দিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসেন সফররত সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আঁলা বেরসে। তার আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের টাইগার গেটে পৌঁছালে বেরসেকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান শেখ হাসিনা। টাইগার গেটের আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শিমুল হলে একান্ত বৈঠকে বসেন দুই নেতা। এ বৈঠকের পর কার্যালয়ের চামেলী হলে দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন শেখ হাসিনা ও বেরসে। বৈঠক শেষে করবী হলে যৌথ বিবৃতি দেন প্রধানমন্ত্রী ও সুইস প্রেসিডেন্ট। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের টাইগার গেটে পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন বেরসে। আজ মঙ্গলবার সকালে সুইস ফেডারেল কাউন্সিলের বিশেষ বিমানে কক্সবাজার যাবেন প্রেসিডেন্ট বেরসে। সকাল ১০টার দিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাবেন তিনি। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাবেন বেরসে। সেখানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলার পর কুতুপালং ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলনে আসবেন তিনি। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি ঢাকায় পৌঁছাবেন। বুধবার দুপুরে তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন। সুইস ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান ॥ সফররত সুইস ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট আঁলা বেরসে সোমবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁয়ে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে অংশ নেন। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত বাংলাদেশ-সুইজারল্যান্ড ব্যবসায়ী ফোরাম অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন সুইস প্রেসিডেন্ট। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী আমিনুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ, বাংলাদেশ-সুইজারল্যান্ড ব্যবসায়ী ফোরামের প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের তরফে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর জোর দেয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা আরও জোরদার করা এবং সুইস ব্যবসায়ীদের এদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়। বক্তারা বলেন, ২০১০ সালের তুলনায় বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এ বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বাড়ানো প্রয়োজন। অনুষ্ঠানে সুইস প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের অব্যাহত অগ্রগতিতে সুইজারল্যান্ডের সহযোগিতার প্রশংসা করে বলেন বাংলাদেশ-সুইজারল্যান্ড দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক নতুন যুগে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রশসংনীয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে শ্রদ্ধা নিবেদন ॥ সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বাংলাদেশ সফররত সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আঁলা বেরসে। সোমবার বেলা ১১টায় সড়ক পথে তিনি স্মৃতিসৌধে পৌঁছালে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক, স্থানীয় সংসদ সদস্য এনামুর রহমান, গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, ঢাকা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন ও পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান তাকে স্বাগত জানান। প্রেসিডেন্ট বেরসে প্রায় ২০ মিনিট স্মৃতিসৌধে অবস্থান করেন। স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় তিন বাহিনীর একটি দল তাকে গার্ড অব অনার দেয়। পরে শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন তিনি। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রেসিডেন্ট বেরসে স্মৃতিসৌধের পরিদর্শন বইতে স্বাক্ষর করেন এবং স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে একটি নাগেশ্বর গাছের চারা রোপণ করেন। পরে ঢাকায় ফিরে ধানম-ির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদেন করেন বেরসে। উল্লেখ্য, সুইজারল্যান্ডের বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে রবিবার বেলা দেড়টায় বাংলাদেশে পৌঁছান সুইস প্রেসিডেন্ট। এসময় রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ তাকে স্বাগত জানান। চার দিন সফর শেষে আগামীকাল বুধবার দুপুরে তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন।
×